অনেকেই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কেবল একটি চাকরির জন্য শিক্ষকতায় পেশায় যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকতায় আগ্রহ নেই। তাই ভালো সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন ও সুযোগ পেলে চলে যান। আর না হলে অনাগ্রহ নিয়েই শিক্ষকতার পেশায় থাকেন। এর ফলে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতায় এলেও অনেকেই তাঁর আসল কাজ অর্থাৎ পাঠদান ঠিকমতো দেন না। এতে শিখনঘাটতি নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে উঠছে শিক্ষার্থীরা। আর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিটি দুর্বল থাকায় শিক্ষার পরবর্তী ধাপেও দক্ষতার ঘাটতি থাকছে। যার প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রে।

এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি থাকা ব্যক্তিরা যাতে প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটি। এ জন্য কমিটি ‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’ চালু করতে বলেছে। এটি ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কোর্স হতে পারে। দেশের সব কটি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) এই প্রোগ্রাম চালুর পরামর্শ দিয়ে কমিটি বলেছে প্রাথমিকভাবে এই ডিগ্রি বা ডিপ্লোমাধারীদের শিক্ষক নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর ‘প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’ পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান প্রশিক্ষণে প্রায়োগিক বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শতাধিক সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর মধ্যে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এক ধাপ বৃদ্ধি এবং সহকারী শিক্ষকের বিদ্যমান পদ বিলুপ্ত করে নতুন পদবির সুপারিশ করেছে। কমিটি শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিও করতে বলেছে। পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত উন্নয়নেও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছে।

কমিটির বিস্তারিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি’ গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে। এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের এ পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি (এপিএসসি) অনুযায়ী দেশে এখন সরকারি বেসরকারি মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় (ইবতেদায়ি মাদ্রাসাসহ) ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩০টি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। বিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২ কোটি। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে প্রায় এক কোটির বেশি। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট শিক্ষক আছেন সাড়ে ৬ লাখের মতো। তাঁদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৮৪ হাজারের মতো। যদিও শিক্ষকের পদ আছে ৪ লাখ ২৭ হাজারের বেশি।

আরও পড়ুনপ্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বৃদ্ধি, বিদ্যালয়কে লাল–হলুদ ও সবুজ শ্রেণিতে ভাগ করার সুপারিশ১৬ ঘণ্টা আগে‘প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’

দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ের মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ প্রশিক্ষণ সব শিক্ষকের জন্যই বাধ্যতামূলক। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অনেক শিক্ষককে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করার পর এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। একসময় এই প্রশিক্ষণ কোর্স ছিল এক বছর মেয়াদি। তখন প্রশিক্ষণ কোর্সটির নাম ছিল সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড)। পরে ১৮ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় কোর্সের নাম দেওয়া হয় ডিপিএড। কিন্তু ২০২২ সালে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে কমিয়ে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ (বিপিটিটি)। অভিযোগ আছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছায় অপরিকল্পিত এই কোর্সকে সংকুচিত করা হয়। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এ রকম পরিস্থিতিতে এখন শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত কমিটি। এ বিষয়ে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে প্রাথমিক শিক্ষক পদে যোগদানের জন্য একটি ‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’ চালু করা অপরিহার্য। প্রাথমিকভাবে এই ডিগ্রি বা ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক নিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যায়ক্রমে তা বাধ্যতামূলক করা যায়। পিটিআইতে এই কোর্স চালুর জন্য সব শূন্য পদ পূরণ এবং নতুন পদ সৃষ্টি করা ছাড়াও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ তদারকি করে) সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পিটিআইয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।

‘প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’ পূর্ণাঙ্গরূপে চালুর আগপর্যন্ত বিদ্যমান প্রশিক্ষণকালে প্রশিক্ষণার্থীরা যাতে পর্যাপ্ত সময় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকেন, তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে অভিন্ন প্রশিক্ষণ পঞ্জি প্রণয়ন না করে উপজেলা পর্যায় থেকে চাহিদার ভিত্তিতে অবিলম্বে একটি তালিকা করে সে অনুসারে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা এলাকাভিত্তিক বার্ষিক প্রশিক্ষণ পঞ্জি তৈরি করা যেতে পারে। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রণীত মডিউল অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

‘প্রিসার্ভিস একাডেমিক প্রোগ্রাম’ চালু করে শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া গেলে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন প্রধান শিক্ষক সমিতির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন এখন অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিক্ষক হন। ফলে আন্তরিকতা থাকে না। অনেকে শিক্ষক হিসেব যোগ দিলেও শুরু থেকেই অন্য চাকরির জন্য চেষ্টা করেন। সুযোগ পেলেই চলে যান। আবার বিদ্যমান পিটিআইগুলোয় প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অনেককে যোগদানের বেশ পরে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া গেলে এবং বেতনকাঠামো আকর্ষণীয় করা হলে অনেক মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চাইবেন। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রাথমিক শিক্ষায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই ব্যবস্থা আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প র স র ভ স এক ড ম ক প র গ র ম স প র শ কর ছ শ ক ষকদ র শ ক ষকত পর য য় র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রান্স ন্যাশনাল ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

ট্রান্স ন্যাশনাল ইসলাম বিদ্বেষীদের হয়ে সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে দাবি করে সরকারকে এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ।

দলটির দাবি, সোমবার অমর একুশে বইমেলায় দুই জন ছাত্রকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মারধর করে উল্টো জঙ্গিবাদের অপবাদ ছড়িয়ে মুসলমানদের বিমানবিকীকরণের অপরাধ করা হয়েছে। যার সঙ্গে ট্রান্স ন্যাশনাল ইসলামবিদ্বেষীদের বয়ান ও অপপ্রচারের হুবহু মিল আছে। ফলে বইমেলার ঘটনাকে বাংলাদেশের মুসলমানদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র গণ্য করা সময়ের দাবি।

মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) জুলাই বিপ্লবে সম্পৃক্ত ছাত্রজনতা গঠিত প্রথম দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সহকারী সদস্য সচিব গালিব ইহসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অমর একুশে বইমেলার ১২৮ নম্বর স্টলে সব্যসাচী প্রকাশনী কুখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী ও জুলাই গণহত্যা সমর্থক তসলিমা নাসরিনের ‘চুম্বন’ নামে একটি বই বিক্রি করে আসছিল। সচেতন তরুণ নাগরিকরা এটি জানতে পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বই মেলার মাঠের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সব্যসাচী প্রকাশনীর প্রকাশক মেহরান সানজানাকে তসলিমা নাসরিনের বই সরিয়ে নিতে বলেন।

কিন্তু মেহরান সানজানা নিজের অপরাধকে আড়াল করতে ফেসবুকে মতলবি প্রচারণা চালান। সেখানে তিনি সব্যসাচী প্রকাশনীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি স্টল থেকে তসলিমা নাসরিনের বইও সরাননি। ফলে সোমবার সন্ধ্যায় কয়েকজন ছাত্র মেলায় গিয়ে দেখতে পান, সব্যসাচী প্রকাশনী তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রি করছে।

তখন তারা জিজ্ঞেস করেন, একজন স্বঘোষিত নাস্তিক ও জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতাকারী, নিয়মিত শহীদ ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্যকারীর বই কেন আপনাদের স্টলে জায়গা পায়? এর জবাবে সব্যসাচীর প্রকাশনীর স্টলে থাকা মেহরান সানজানার স্বামী শতাব্দী ভব ছাত্রদের তুই তুকারি সম্বোধন করেন এবং বলেন, ‘তসলিমার পক্ষে আমি একাই লড়ে যাব।’ একপর্যায়ে তিনি দুইজন মাদ্রাসা ছাত্রকে কিল-ঘুষি দেন এবং ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ছাত্রদের জঙ্গি ও মৌলবাদী সম্বোধন করেন।

এতে উপস্থিত ছাত্র-জনতা শতাব্দী ভবের ঔদ্ধত্যের জবাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং বিতর্কিত ১২৮ নম্বর স্টল বন্ধ রাখে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, মুসলমানদের উস্কানি দিয়ে, উত্তেজিত করে উল্টো তাদের বিমানবিকীকরে করে হত্যাযোগ্য করা আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে পরিচিত ইসলাম বিদ্বেষী বর্ণবাদের বহুল ব্যবহৃত একটি ধরণ। সোমবার বইমেলার ঘটনায় একই ধরনের বর্ণবাদ চর্চা করা হয়েছে। একদিকে প্রচার করা হয়েছে, ‘তৌহিদি জনতা বইমেলায় হামলা করেছে’। আরেকদিকে ভারতের কুখ্যাত মুসলিম বিদ্বেষী পত্রিকা আনন্দবাজার এ সব্যসাচী প্রকাশনীর প্রকাশক মেহরান সানজানার বরাতে প্রচার করেছে ‘বইমেলা জঙ্গিদের’।

ফলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, মুসলমানদের বিমানবিকীকরণের মধ্য দিয়ে হত্যাযোগ্য করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বাংলাদেশেও ঘনীভূত হচ্ছে। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। আর অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোন ঘটনার বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধান করে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে জাতিকে সঠিক তথ্য অবহিত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ