ডায়েটিশিয়ান নাকি নিউট্রিশনিস্ট, কখন কার কাছে যাবেন
Published: 11th, February 2025 GMT
দেশে দেশে এই শব্দ দুটির প্রয়োগ এক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ডায়েটিশিয়ান হলেন স্বীকৃত খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ। তাঁরা চিকিৎসার মাধ্যমে পুষ্টি থেরাপি ও পরামর্শ দেন। কিছু রাজ্যে ডায়েটিশিয়ানরা নিজেদের নিউট্রিশনিস্ট (পুষ্টিবিদ) হিসেবে পরিচয় দেন। অর্থাৎ সব জায়গায় এর অর্থ এক নয়।
তাহলে কোনটার সংজ্ঞা কী?ডায়েটিশিয়ান
বিভিন্ন দেশে ডায়েটিশিয়ানরা সাধারণত পুষ্টি ও খাদ্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত। এর মধ্যে থাকে খাদ্যবিজ্ঞান, পুষ্টি ও মানবজীবনে খাদ্যের প্রভাব। বিস্তৃত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডায়েটিশিয়ানরা মেডিকেল নিউট্রিশন থেরাপি ও পুষ্টিগত পরামর্শ দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করেন। দিতে পারেন কিছু ওষুধও।
নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান হতে সরকারের ঠিক করা মানদণ্ড মেনে উত্তীর্ণ হতে হয়। তার আগে এই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্জন করতে হয় স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি। জীববিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণরসায়ন, অজৈব রসায়ন, শারীরতত্ত্ব (ফিজিওলজি) ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষায়িত বিষয়ে পড়েও এই পেশায় আসা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ডায়েটিশিয়ান হতে প্রয়োজন পড়ে স্নাতকোত্তরের।
ডায়েটিশিয়ানদের কাজের ক্ষেত্র প্রধানত চারটি—ক্লিনিক্যাল, খাদ্য পরিষেবা ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি ও গবেষণা। ক্লিনিক্যাল ও বহির্বিভাগের ডায়েটিশিয়ানরা পুষ্টি শিক্ষা দিতে হাসপাতালে কাজ করতে পারেন।
আরও পড়ুনখাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে এই সাত ভুল কথা খুবই জনপ্রিয়০৩ নভেম্বর ২০২৩নিউট্রিশনিস্ট
কিছু দেশে ডায়েটিশিয়ান না বলে বলা হয় নিউট্রিশনিস্ট। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাঁরাও ডায়েটিশিয়ানদের মতোই। যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিউট্রিশনিস্ট’ শব্দটি দিয়ে এমন ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যাঁদের পুষ্টিবিদ্যার ওপর বড় পরিসরের যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ আছে। তবে অনেক রাজ্যেই পুষ্টিবিদ হতে বিশেষ কোনো শর্ত নেই। পুষ্টি বা খাদ্য সম্পর্কে আগ্রহী হলেই এই পরিচয় দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে এই নিউট্রিশনিস্টরা মেডিকেল নিউট্রিশন থেরাপি ও পুষ্টি পরামর্শ দিতে পারেন না।
আরও পড়ুনযেসব পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিতে ওজন বাড়তে পারে২২ এপ্রিল ২০২৪কার কাছে যাবেনবাংলাদেশে পুষ্টিসংক্রান্ত বিষয়ে স্নাতক করার পর ডায়েটিশিয়ান পেশায় কাজ করা যায়। তবে সাধারণত উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁরা পুষ্টিবিদ পরিচয়ে সেবা দেন। তাই আপনার খাদ্যাভ্যাসসংক্রান্ত পরামর্শের প্রয়োজন হলে ডায়েটিশিয়ানের কাছে যেতে পারেন। আর শারীরিক পুষ্টিসংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে যেতে পারেন চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত নিউট্রিশনিস্টের কাছে।
আরও পড়ুনমিষ্টি-রসমালাই খেয়েও ৪০ কেজি ওজন কমিয়েছেন এই ইউটিউবার, কীভাবে?০৯ ডিসেম্বর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিজয় যখন কড়া নাড়ছে
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
আত্মসমর্পণের আগে
ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।
এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।
ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।
বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।
ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।
সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।
যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।
গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন
দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত