উচ্চ নীতি সুদহার বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করবে: ঢাকা চেম্বার
Published: 11th, February 2025 GMT
বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধেও (জানুয়ারি-জুন) সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রতিক্রিয়ায় তারা এ কথা বলেছে।
গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনটি বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কঠোর অবস্থান বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিনিয়োগের জন্য দেশের বেসরকারি খাত ব্যাংকগুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ঋণের উচ্চ সুদহার পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জানুয়ারিতে কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামলেও তা প্রত্যাশার চেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। এর আগে সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করা হয়।
ডিসিসিআই বলছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত বেসরকারি খাতকে কিছুটা আশাহত করেছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথমার্ধে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও তা বেড়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। তা মোকাবিলায় সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন; না হলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকবে। বেসরকারি খাতের আস্থা ও ব্যবসায়িক কার্যকলাপ পুনরুদ্ধারে এই খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা দুই অঙ্কের ঘরে থাকা প্রয়োজন।
নিয়ন্ত্রণমূলক আর্থিক নীতিমালার কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ঢাকা চেম্বার ঋণের প্রবাহ বাড়াতে খাতভিত্তিক তহবিল এবং উদ্যোক্তা সহায়তা কর্মসূচি চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ঢাকা চেম্বার বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রয়োগ করা সত্ত্বেও আমদানি-রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন দরে, বিশেষত উচ্চ মূল্যে ডলার কিনতে হচ্ছে। এই অসংগতি অবশ্যই সমাধান করতে হবে।
তারল্যসংকট ও ক্রমবর্ধমান মন্দ ঋণ মোকাবিলায় আর্থিক খাতের প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার। তারা বলেছে, দেশের আর্থিক খাতে শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোর অনুপস্থিতি ও আইনি সমাধানের দীর্ঘসূত্রতায় ব্যাংক খাত আরও দুর্বল হবে। এতে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে।
নমনীয় মুদ্রানীতি ও ভারসাম্যপূর্ণ আর্থিক নীতি গ্রহণ এবং তার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার। তারা বলছে, এটা করা গেলে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামী দিনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব সরক র র জন য আর থ ক দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
প্রবৃদ্ধি নয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই জোর দিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বিনিময় হারের ওপর চাপ কমিয়ে রিজার্ভ ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে সরকারও সমর্থন দিচ্ছে। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সেটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭–৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে গতকাল সোমবার চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি–জুন) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আপাতত তাদের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতির কমিয়ে আনা। তাই এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে খুব বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না।
নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮% নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতির বিভিন্ন কৌশল তুলে ধরেন ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আগের মতোই ১০ শতাংশে রাখা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক দিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করলেও তা নিয়ন্ত্রণে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণও বিলম্বিত হয়েছে। এ জন্য মূল্যস্ফীতি কমেনি।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের অগ্রাধিকারে নেই। সরকার চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমরাও মনে করছি, অর্থবছর শেষে তা ৫ শতাংশের ওপরেই থাকবে। এরই মধ্যে দেশের চলতি ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হয়েছে। আগামী দিনে লেনদেন ভারসাম্যও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে, যা ডলারের ওপর চাপ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ মুহূর্তে তাদের সামনে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, রিজার্ভ বাড়ানো ও ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধি।
ভঙ্গি সংকোচনমূলক
মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ফলে সব ধরনের নীতি সুদহার আগের মতোই থাকবে। এবারের মুদ্রানীতির ভঙ্গি হবে প্রকৃত সংকোচনমূলক।
নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, আগামী জুন পর্যন্ত নীতি সুদহার বা রেপো রেট ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর নেওয়া ঋণের সুদ নতুন করে বাড়বে না। গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর জন্য চালু করা বিশেষ ধরনের ধার বা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা আগের মতো সাড়ে ১১ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে বহাল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কঠোর নীতির ধারাবাহিকতা ও অংশীজনদের সহযোগিতায় নিকট ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নেমে আসবে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে।
এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাকেও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে।
বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়বে
মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতেও একই লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর যা ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এ লক্ষ্যমাত্রার ফলে আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়, দেশে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। তাই খেলাপি ঋণের এ চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেশ কিছু ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত ও যথাযথভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। এসব নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।