প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আপাতত নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকছে। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলে তখন নীতি সুদহার কমানো হবে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশ এবং পরের জুনে ৫ শতাংশে নামতে পারে। গতকাল চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন আশার কথা জানান গভর্নর ড.

আহসান এইচ মনসুর। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকাকে সাফল্য উল্লেখ করে শিগগিরই অস্থিতিশীলতার কোনো কারণ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে মুদ্রানীতির ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় অন্য তিন ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার, জাকির হোসেন চৌধুরী ও ড. কবির আহমেদ এবং বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকারে গভর্নরের দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। এটি ছিল তাঁর প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা।

নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ৯ দশমিক ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে একই লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা আগের মতোই ৮ দশমিক ৪০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আর বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান সরকারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ২৫ শতাংশের আশপাশে থাকার আশা করা হয়েছে। রিজার্ভ দীর্ঘদিন ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল হওয়া এবং পরিশোধের চাপ কমায় বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। অবশ্য আগের লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র বের হওয়ায় তা ৩০ শতাংশ ছাড়াতে পারে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে কোনো নীতি কাজ করতে একটা সময় দিতে হয়। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে, যা 

নীতি সুদহারের তুলনায় কম। এটি ইতিবাচক। তবে আগামী মাসে আবার এই মূল্যস্ফীতি বাড়তে বা কমতে পারে। তার মানে নীতি কাজ করছে না, তেমন না। তবে আগামী জুনে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের নিচে নামানো আমাদের একটা লক্ষ্য। ২০২৬ সালের জুনে এটি ৫ শতাংশের নিচে নামবে বলে আশা করি। একটা ইতিবাচক বিষয় হলো, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ভারসাম্য একটা স্বস্তির জায়গায় এসেছে। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল আছে। সামগ্রিক হিসাব ইতিবাচক হয়ে আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল প্রবৃদ্ধি অর্জনের বছর না। এ সময়ে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি তেমন হবে না, এটাই বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটা কারণ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিকে তুলনা করা অমূলক। কেননা, সেখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক; খাবার পাওয়া যায়নি, পেট্রোলের জন্য দীর্ঘ লাইন ধরতে হয়েছে। আমাদের এখানে এর কিছুই ঘটেনি।

বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতার শঙ্কা নেই
গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সবার আগে দরকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুটা সফল হয়েছে। শিগগিরই অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কা নেই। এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, রমজানে প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্য এরই মধ্যে আমদানি হয়ে গেছে। বোরো মৌসুমের প্রয়োজনীয় সারের বেশির ভাগই চলে এসেছে। হজের বাড়ি ভাড়াসহ বড় ধরনের খরচ পরিশোধ করা হয়েছে। আগের বকেয়ার বেশির ভাগই পরিশোধ করা হয়েছে। আবার রমজান ও কোরবানি ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স বাড়বে। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। এখন চিন্তা কেবল বিদ্যুৎ-জ্বালানির পরিশোধ নিয়ে। তবে রেমিট্যান্সে ২৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি আছে। রপ্তানিতে আছে ১৩ শতাংশের মতো। শেষ পর্যন্ত দুয়ে মিলে যদি ১২ বিলিয়ন ডলার বা এর বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে, তাতেও বিনিময় হারে কোনো চাপ তৈরি হবে না।
তিনি বলেন, এই সরকার আসার পর আইএমএফের ঋণের কোনো কিস্তি না পেয়েও রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ডলারের দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২২ টাকার একটি করিডোর ঠিক করে দিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল এটি তদারকি করা হচ্ছে। এ নিয়ে কথা থাকতে পারে। তাই বলে তো বিদেশি বড় এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর হাতে এটি তুলে দেওয়া হবে না। তারাই ডলারের যে দর বলবে, সেটাই ডলারের দর হতে পারে না; বরং আমরা যেটা বলব, সেটি হবে দর।

বড় কোন গ্রুপ কত টাকার ঋণ নিয়েছে, তারাই হয়তো জানে না
ব্যাংক লুট, কর ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়া ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের বিষয়ে ১১টি যৌথ তদন্ত দল কাজ করছে। এসব তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, দেশি-বিদেশি সম্পদ অ্যাটাচ করার কাজ শুরু হয়েছে। এখনও কে কত টাকার ঋণ নিয়েছে, তা জানা যায়নি। এরাই হয়তো জানে না, কে কত টাকার ঋণ নিয়েছে। তিনি বলেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের লন্ডনে সাড়ে তিনশ বাড়ি আছে। সে নিজেও বলতে পারবে না, কোন ঠিকানায় কোন বাড়ি কিনেছে। তবে সব তথ্যই বের করা হবে। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হয়তো সময় লাগবে। প্রথমে তাদের দেশের সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপর আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে কোনো পরিদর্শন হয়েছে কিনা, দেখা হবে। আবার যেসব অডিট ফার্ম এসব ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে, তাদের কী দায়দায়িত্ব ছিল তা-ও দেখা হবে। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক– দুই পক্ষেরই। তবে প্রথম দায়িত্ব নিতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে পর্যালোচনা হচ্ছে
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের জন্য পর্যালোচনা হচ্ছে। কোথায় কী সংশোধন দরকার, তার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, পরিচালকদের মেয়াদ কমানো উচিত। আবার পরিচালক সংখ্যার অন্তত অর্ধেক স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হবে। এই স্বাধীন পরিচালক মামু-খালুকে নিয়োগ দেওয়া যাবে, তেমন না; বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্যানেল থেকে নিয়োগ দিতে হবে। আবার ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য ২ শতাংশ শেয়ারের বাধ্যবাধকতা দরকার আছে কিনা, এসব দেখা হবে।

তারল্য সংকট দেখা দিলে আরও সহায়তা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
গভর্নর বলেন, তারল্য সংকটে ছিল– এ রকম কয়েকটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়েছে। প্রয়োজনে এসব ব্যাংককে আরও ধার দেওয়া হবে। তাই বলে কোনো ব্যাংক থেকে যেন ক্ষুদ্র আমানতকারী খালি হাতে না ফেরে, সেটি দেখা হবে। ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা এরই মধ্যে ঠিক হয়ে গেছে। তাদের আর তারল্য দিতে হবে না। তাই বলে যে আগের মতো শক্তিশালী অবস্থায় চলে গেছে, তেমন না। এ জন্য হয়তো তিন-চার বছর সময় লাগবে। বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে সুদৃঢ় অবস্থানে নেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তা করা হবে।
গভর্নর জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এরই মধ্যে ৯৯ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণ জোগানে কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি নিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে।

আগের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক ছিল না
ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান বলেন, আগের মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল না। এখন প্রকৃতপক্ষেই সংকোচনমূলক হয়েছে। যে কারণে অনেক দিন পর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি রেপো সুদহারের নিচে নেমেছে। এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে কোনো ঋণ দিচ্ছে না; বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের দায় থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হবে। এ জন্য আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একটা ইতিবাচক বিষয় হলো বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনে চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। আবার বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা রয়েছে। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি কমলে অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য পর শ ধ র বল ন দশম ক প রথম বছর র অবস থ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

পুলিশ-আদালত ঠিকমতো কাজ করলে মবের প্রকোপ কমবে: আইন উপদেষ্টা

সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

পুলিশ আর আদালত যখন ঠিকমতো কাজ করবে তখন মবের প্রকোপ কমবে বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ডক্টর আসিফ নজরুল।

মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজারবাগে আইন ও বিচার নিয়ে এক কর্মশালায় এ মন্তব্য করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকার চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বিচারকদের উদ্দেশে তিনি আহ্বান জানান, হুটহাট যাকে-তাকে যেন জামিন দেয়া না হয়। কেননা জামিনের পর ভয়াবহ অপরাধীরা বেরিয়ে আবারও অপরাধ করতে পারে।

কর্মশালায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে একই আহ্বান জানান। উপদেষ্টার অভিযোগ, পতিত সরকারের দোসররা পাচার করা অর্থ খরচ করে এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই অপারেশন ডেভিল হান্ট চলবে। এ অভিযান সফল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

এম জি

সম্পর্কিত নিবন্ধ