ঘুরেফিরে সেই প্রশাসন ক্যাডারে সুনজর
Published: 11th, February 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে সুনজরে ছিলেন আমলারা। বাড়ি, গাড়ি, পদোন্নতিসহ অনেক সুবিধা বাগিয়েছেন তারা। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও প্রাধান্য বিস্তার করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ফলে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তা পেয়েছেন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি। এর মধ্যে ১১৯ জন হয়েছেন সচিব। এ পদোন্নতির ঘটনায় এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
পদোন্নতি তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮১ ব্যাচ থেকে সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন চারজন, ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের ৩৫ জন, ১৯৮২ (বিশেষ) ব্যাচের ১০ জন, ৫ম ব্যাচের ১৬ জন, সপ্তম ব্যাচের ১৭ জন, অষ্টম ব্যাচের ৮ জন, নবম ও দশম ব্যাচে দু’জন করে, ১১তম ব্যাচের চারজন এবং ১৩তম ব্যাচের তিনজন। অন্য ক্যাডারের মাত্র ১৮ কর্মকর্তা সচিব হতে পেরেছেন। এর মধ্যে দু’জন ১৯৮১ ব্যাচের, ৫ জন ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের। অন্যান্য ব্যাচে আছেন ১১ জন। এতে ১৯৮২ সালের নিয়মিত ও বিশেষ ব্যাচে পদোন্নতি পেয়েছেন ৫০ জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া গ্রেড-১ (সচিবের সমমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন ও উপসচিব পদে চারজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, এবারও অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৯৮২ (বিশেষ) এবং ১৯৮৫ ব্যাচের মৃত দুই কর্মকর্তা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেলেও ১৯৮২ (নিয়মিত) ব্যাচের তালিকায় মৃত আবুল হোসেন ও মৃত আবুল কাশেমের নাম নেই।
বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বাছাই কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে যেসব কর্মকর্তা ৫ থেকে ৩ বছর ওএসডি ছিলেন এবং পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। এ ছাড়া যেসব মেধাবী কর্মকর্তা সচিব হতে পারেননি, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে।
খরচ হবে ৪৬ কোটি টাকা
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ২৪ ডিসেম্বর জানিয়েছিলেন, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির জন্য বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ৪২ কোটি টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া তাদের পেনশন বাবদ বছরে অতিরিক্ত ৪ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে গত রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারা এখন পদোন্নতি পাওয়া পদ অনুযায়ী মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা পাবেন। এই কর্মকর্তাদের চাকরিতে ফিরতে হবে না। নতুন পদে এক দিনও কাজ করতে হবে না। শুধু আর্থিক সুবিধা পাবেন। মোট আর্থিক সুবিধার অর্ধেক পাবেন আগামী ৩০ জুনের মধ্যে। বাকিটা পাবেন আগামী অর্থবছরে। সরকারি কর্মকর্তারা ২৫ বছর চাকরি করলে মূল বেতনের ৯০ শতাংশের সমপরিমাণ পেনশন পান। এর অর্ধেক এককালীন দেওয়া হয়।
বাকিটা দেওয়া হয় মাস হিসেবে। পাশাপাশি তাদের আনুতোষিক, ভবিষ্য তহবিলসহ বিভিন্ন অবসর সুবিধা রয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে (গ্রেড-২) মূল বেতন ৬৬ হাজার টাকা থেকে ৭৬ হাজার ৪৯০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সচিব পদে নির্ধারিত মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা যাতে দ্রুত বকেয়া টাকা পেয়ে যান, সে জন্য জিও জারি করা হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে ‘বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো’ কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষ সুযোগ-সুবিধাসহ পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করে এ-সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি। গত ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড.
কমিটি নিয়ে বিতর্ক
প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের শীর্ষ কমিটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে এ কমিটিতে সদস্য থাকেন জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, অর্থসহ ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ সচিব। শীর্ষ এ কমিটি বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের ব্যাচ ভেঙে পদোন্নতি, নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি না দেওয়া, ভারপ্রাপ্ত সচিবের পদ সৃষ্টি ও বিলুপ্তি, এক দিন চাকরি থাকলেও সচিব পদে পদোন্নতি, আবার পদোন্নতির সময় যে কর্মকর্তা কমপক্ষে দুই বছর সচিব পদে চাকরি করতে পারবেন তাদেরই পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্তসহ অসংখ্য অলিখিত নিয়মে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কাজ করে এই কমিটি। এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এবার সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছেন অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিব পদের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এমন কমিটি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
ঘুরেফিরে ৮২ ব্যাচ
বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মন্ত্রণালয়ের সচিব ৮২ ব্যাচের।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২তম নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তারা। এই ব্যাচে কর্মকর্তা ছিলেন ১৯১ জন। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিব সুরাইয়া বেগম এই ব্যাচের মেধাতালিকায় ১৭৮তম হয়েও জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। একই সঙ্গে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইএমইডি, পরিসংখ্যান বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ চারটি মন্ত্রণালয়-বিভাগে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চাকরি থেকে অবসরের পর আরেক দফা প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন। পরে তথ্য কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্বও পালন করেন।
৮২ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা শফিউল আলম রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও ভূমি সচিবের পর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে চুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (কর্মসূচি), তথ্য, সংস্কৃতি ও বিমানের সচিব ছিলেন। আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ, ইআরডি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও মুখ্য সচিব ছিলেন। পরে তাঁকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের পদ সৃষ্টি করা হয়। সর্বশেষ তিনি এমপি হয়ে সংসদেও যান। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী তথ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। ৮২ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক খান সড়ক ও রেলওয়ে, স্বরাষ্ট্র এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। অবসরে যাওয়ার আগে পাঁচ বছরের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার করা হয় তাঁকে।
মানুষের দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ঢাকা যেন দাবি আদায়ের নগরে পরিণত হয়েছে। চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, রিকশাচালক সবাই দাবি আদায়ের চেষ্টায় তৎপর। তবে তাদের দৃশ্যমান বড় কোনো দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন পরপর সচিবালয়ে সামনে আসছেন। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি প্রেস ক্লাবের সামনে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেন। অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতির জন্য দাবি জানালেও তাদের দাবি আমলে নেওয়া হয়নি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল গ সরক র র আমল ন মন ত র উপদ ষ ট র জন য কম ট র আওয় ম সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
পদোন্নতি পেলেন ১১৯ সচিবসহ প্রশাসনের ৭৬৪ জন সাবেক কর্মকর্তা
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১৬ বছরে জনপ্রশাসন থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত এই পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ১১৯ জন সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
আজ রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে। সচিব ছাড়াও গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন ও উপসচিব পদে চারজনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়। সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের আমলে ২০০৯ সাল থেকে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সরকারি চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এবং এ সময়ের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন সাবেক অর্থসচিব এবং বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক জাকির আহমেদ খান। কমিটি ১০ ডিসেম্বর তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়।
কমিটির কাছে মোট ১ হাজার ৫৪০টি আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদন ছিল। যাচাই-বাছাই করে কমিটি ৭৬৪ জনের ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করে।
ওই ৭৬৪ কর্মকর্তার মধ্যে কমিটি ৯ জনকে চার ধাপ, ৩৪ জনকে তিন ধাপ, ১২৬ জনকে দুই ধাপ ও ৫৯৫ জনকে এক ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন দেওয়ার পর এখন প্রজ্ঞাপন জারি করল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা পদোন্নতির তারিখ থেকে প্রাপ্যতা অনুযায়ী সব আর্থিক সুবিধা পাবেন। তাঁরা তাঁদের বকেয়া বর্তমান অর্থবছরে ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ পরবর্তী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) পাবেন।