নদীর দুই পাড় ঘেঁষে হাঁটা পথ। সেই পথে হেঁটে চলছেন সাড়ে তিনশ থেকে চারশ কিষান-কিষানি। প্রত্যেকের মাথায় দুধভর্তি সিলভারের কলস। তাদের গন্তব্য মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার গোপালপুর বাজার।
প্রতিদিন এই বাজারে ২৫০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হয়। প্রতি লিটার দুধের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বাজারটিতে দিনে আট থেকে ৯ লাখ ও মাসে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার দুধ বেচাকেনা হয়।
উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নে ধলেশ্বরী নদীর পূর্ব পাড়ে গোপালপুর বাজারটি অবস্থিত। নদীর পশ্চিম পাশে রাজৈর, কাকর্দাসহ আরও কয়েকটি গ্রাম। গ্রামগুলো থেকে কিষান-কিষানির পাশাপাশি তাদের সন্তানরাও গোপালপুর বাজারে নিয়ে দুধ বিক্রি করে। এসব দুধ কিনে ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সাটুরিয়ার রাজৈর, বরাইদ, ধুনট, কাকরাইদ, গালা, তিল্লির চর, নাটুয়াবাড়ীসহ আশপাশের ১৫ গ্রামের প্রায় বাড়িতেই গরু লালনপালন করা হয়।
যেভাবে গড়ে ওঠে বাজার
আশির দশকের শুরুর দিকে গোপালপুর গ্রামের আশপাশে চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাজার ছিল না। নিজেদের ফসল ও গরুর দুধ বিক্রি করতে গোপালপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোর কৃষকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। নৌকায় করে তাদের উপজেলা সদরে ফসল ও দুধ বিক্রি করতে যেতে হতো। পরে গোপালপুর গ্রামে বাজার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে বরাইদ ইউপি চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ আব্দুল হাই গোপালপুর গ্রামে কিছু জমি কেনেন। পরে সে বছর ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ওই জমিতে হাট বসানোর পরিকল্পনা করা হয়। গ্রামের লোকজন তাদের উৎপাদিত ফসল, দুধ ও কৃষিপণ্য এই বাজারে নিয়ে বিক্রি শুরু করেন। ধীরে ধীরে কয়েক গ্রামের মানুষও এই বাজারে বেচাকেনা শুরু করেন। শুরুতে গোপালপুর ও আশপাশের মানুষই এসব দুধের ক্রেতা ছিলেন। ফলে তারা আশানুরূপ দাম পেতেন না। নব্বই দশকের শুরু থেকেই এ বাজারে বিপুল পরিমাণ দুধ বেচাকেনা শুরু হয়। স্থানীয় পাইকাররা এসব দুধ কিনে মিষ্টির দোকানগুলোতে সরবারহ করেন।
ইউপি চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, তিনি জমি কিনে সেখানে বাজার বসিয়েছেন। পরে এসব জমি দান করে দেন। দুধের বাজার হিসেবে এখন গোপালপুর বাজারের পরিচিতি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
আয়ের অন্যতম উৎস গরু পালন
রাজৈর, কাকরাইদ, বরাইদ ও গোপালপুর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ দিনমজুর ও কৃষিজীবী। তারা ভুট্টা, ধান, পাট ও সর্ষের আবাদ করেন। তবে এখানকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস গরু পালন। গ্রামগুলোর প্রায় প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে দুই থেকে ১০টি পর্যন্ত গরু লালনপালন করা হয়। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে কয়েকশ কিষান-কিষানি দুধভর্তি কলস নিয়ে গোপালপুর খেয়াঘাটের পশ্চিম পাশে আসেন। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর গোপালপুর বাজারে পৌঁছান। বাজারে যাওয়ার পরপরই পাইকারি ব্যবসায়ীদের লোকজন দুধ পরিমাপ করে প্লাস্টিকের ড্রামে ভর্তি করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যায় দুধ বিক্রি। পরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা পিকআপভ্যানে করে ড্রামভর্তি দুধ নিয়ে যান।
সম্প্রতি সকাল ৭টার দিকে কাকরাইদ গ্রামের কয়েকজন কৃষকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকের বাড়িতেই রয়েছে গোয়ালঘর। গোয়ালঘরগুলোতে বাঁধা গাভিগুলোকে খাবার খাওয়াচ্ছেন বাড়ির কিষান-কিষানি। এরপর শুরু হয় দুধ দোহানোর কর্মযজ্ঞ। বাড়ির উঠানে গাভির খামার করেছেন কাকরাইদ গ্রামের কৃষক মো.
লুৎফর রহমান বলেন, ২৫ বছর ধরে তিনি বাড়িতে গাভি লালনপালন করছেন। বর্তমানে তাঁর খামারে ছয়টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে চারটি গাভি ও দুটি ষাঁড়। চারটি গাভি প্রতিদিন ৩২ থেকে ৩৫ লিটার দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধ বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়।
রাজৈর গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমানও বাড়ির সামনে উঠানে ছোট খামারে চারটি গাভি পালন করছেন। তিনি বলেন, চারটি গাভি প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩২ লিটার দুধ দেয়। দুধ বিক্রি করেই তাঁর সংসার চলে।
আছে কিছু সমস্যাও
গোপালপুর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীতে দীর্ঘদিন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকার লোকজন। সেতু না থাকায় কিষান-কিষানিদের দুধ নিয়ে বাজারে আসতে খেয়া নৌকার ওপর ভরসা করতে হয়। এতে বাজারে দুধ আনতে বেশি সময় লেগে যায়। এ ছাড়া ফসল ও কৃষিপণ্য নিতেও কৃষকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। রাজৈর গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে একটি সেতুর দাবি জানিয়ে আসছেন। সেতুটি হলে দুধ নিয়ে বাজারে যেতে কষ্ট করতে হতো না।
গোপালপুর বাজারের বণিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হয়। যার মূল্য ৮ লাখ টাকার বেশি। এ হিসাবে প্রতি মাসে বাজারটিতে প্রায় আড়াই কোটি টাকার দুধ বেচাকেনা হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা দুধ কিনে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র রহম ন ব যবস য় আশপ শ র
এছাড়াও পড়ুন:
বোয়ালমারীর বালুমহালের ইজারা বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৩
ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ঘোষপুর ইউনিয়নের গড়াই নদীর লংকারচর বালুমহালের ইজারা বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে তিনজন আহত হয়েছে। বুধবার রাতে দফায় দফায় এ সংঘর্ষ হয়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১০টার দিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আঁধারকোঠা গ্রামের একদল যুবক আক্রমণ চালায়। এ সময় মা ফার্মেসিতে আশ্রয় নেওয়া রাসেল আহমেদের ছোট ভাই ছাত্রদলের সাবেক নেতা রবিন মোল্যার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করে আক্রমণকারীরা। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে আহত হন রিয়াজ মৃধা। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। রিয়াজ মৃধাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিলেও রবিন মোল্যা বোয়ালমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বোয়ালমারী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মাহমুদুল হাসান বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিএনপি নেতা মিরাজ মৃধা বলেন, রাসেলের সঙ্গে জুয়েল বিশ্বাসের দেনাপাওনা নিয়ে ফোনে কথা-কাটাকাটি হয়, পরে সমঝোতার জন্য আমার ফার্মেসিতে আসেন জুয়েল। কথা বলার সময় তার কোমরে একটি ধারাল অস্ত্র দেখে লোকজন তা কেড়ে নেয়। এ সময় তিনি পালিয়ে গিয়ে কিছু সময় পর ২৫ থেকে ৩০ জনকে নিয়ে আমার ফার্মেসিতে এসে হামলা চালায়।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯টি সিডিউল বিক্রি হলেও সাবেক সংসদ সদস্য ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুলের সহায়তায় মাত্র একটি সিডিউল জমার মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বালুমহাল ইজারা পান বোয়ালমারী যুবলীগের সদস্য মেসার্স রবিউল ট্রেডার্সের মালিক রবিউল ইসলাম। এই বালুমহাল ইজারার ১৯ জন সিডিউল ক্রেতার সঙ্গে কৃষকদল সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুলের নেতৃত্বে ইজারা দরপত্র (নিকো) বোর্ড করে একটি সিডিউল জমার মাধ্যমে রবিউলকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়। বাকি ১৮ জন ঠিকাদারকে ৪৫ হাজার টাকা করে নিকোর টাকা নির্ধারণ করা হয়। দৈনিক সমকাল পত্রিকায় এ বিষয়ে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বালুমহালের ইজারা পেলেন যুবলীগ নেতা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি তিনটি বালুমহালের দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক। এগুলো বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গায়। লংকারচর মহালের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ কোটি ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৪১৮ টাকা। ঘোষপুর ইউনিয়নে গড়াই নদীর এ মহালের আয়তন ৭৪ হাজার ১৪৭ একর। ৩৬ লাখ টাকা বেশি দিয়ে ইজারা নেন রবিউল।
স্থানীয় এক সিডিউল ক্রেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ও ডিসির কাছে দেওয়া অভিযোগকারী) জানান, ১৯টি দরপত্র বিক্রি হলেও ১৫ দরপত্র দাতাদের মাঝে এবং কৃষক দলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুলের সমঝোতার ভিত্তিতে গোপন নিলাম ডাকের মাধ্যমে কেনাবেচা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে দরপত্র দাতাদের মাঝে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ভাগাভাগির টাকা বণ্টনের দায়িত্ব দেন পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল আহমেদের ওপর। তবে জুয়েল বিশ্বাস নামে একজন দরপত্র ক্রেতা অভিযোগ করেন তার পাওনা টাকা না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে বুধবার রাতে বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদের সামনে মা ফার্মেসি মার্কেট চত্বরে সালিশ বৈঠকে বসেন পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল আহমেদ, বিএনপি নেতা মহসিন আলম চান, মিরাজ মৃধাসহ স্থানীয়রা।
বৈঠক শুনানির সময় দরপত্র দাতা আঁধারকোঠা গ্রামের মঈনুদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে জামায়াতে কর্মী জুয়েল বিশ্বাসের কোমরে থাকা একটি দেশীয় অস্ত্র দেখে ফেলে লোকজন। এ সময় অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে জুয়েল বিশ্বাসের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় স্থানীয়দের। পরে জুয়েলের নেতৃত্বে ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দল অস্ত্র নিয়ে মা ফার্মেসিতে আক্রমণ চালায়। এতে রবিন মোল্যা ও রিয়াজ মৃধা আহত হন।
জুয়েল বিশ্বাস জানান, বালুমহালের নিকোর ৪৫ হাজার টাকা জমা ছিল রাসেল আহমেদ ও মিরাজ মৃধার কাছে। সেই টাকা চাওয়ায় আমাকে মা ফার্মেসিতে ডেকে নেয় রাসেল আহমেদ। সেখানে গেলে তারা টাকা না দিয়ে টালবাহানা করে এবং আমার উপর আক্রমণ চালায়। খবর পেয়ে আমার গ্রামের লোকজন আমাকে উদ্ধার করতে ছুটে আসে। সেখানে রাসেল আহমেদের ভাই রবিন আঘাত পান।
এ বিষয়ে পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল আহমেদ বলেন, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী জুয়েল বিশ্বাস আমার কাছে চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে জানতে মহসিন আলম চান ও মিরাজ মৃধা তাকে ডাকলে তিনি পরিকল্পনা করে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোমরে অস্ত্র নিয়ে আসেন। লোকজন তা দেখে কেড়ে নিলে আগে থেকে ওঁতপেতে থাকা তার পক্ষের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়।