ভবনের ছাদ, টিনশেডের চালা অথবা বিভিন্ন সড়কের পাশে ঝুলে রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন। এসব লাইনের অধিকাংশই স্থানীয়দের নাগালের মধ্যে, যার সংস্পর্শে যে কোনো মুহূর্তে যে কারও প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রবল।
এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে দেওয়া পল্লী বিদ্যুতের ঝুলন্ত সঞ্চালন লাইনের কারণে। যথাযথভাবে দেখভাল না করা এবং সঞ্চালন দেওয়ার সময় লাইনের তার ঝুঁকিমুক্তভাবে স্থাপন না করায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। রীতিমতো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর পল্লী বিদ্যুতের এসব ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয়েছে জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার সাতজন বাসিন্দার। এর আগে ২০২২ সালে ঝুঁকিপূর্ণ পল্লী বিদ্যুতের লাইনের কারণে এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকার চার শতাধিক স্থানে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ঝুলন্ত সঞ্চালন লাইন রয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২৪ সালের ২৫ মার্চ বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন জুড়ী উপজেলায় টিনের 
চালে বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২৩ মে বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের খলাগাঁওয়ে প্রবাসীর বসতঘর ছোঁয়া বিদ্যুতের মেইন লাইনে জড়িয়ে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে পল্লী বিদ্যুতের দাসেরবাজার অভিযোগ কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জের গাফিলতিতে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা কখনোই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ করার পরেও এসব বিদ্যুৎ লাইন নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেন না তারা। সঞ্চালন দেওয়ার সময়ই এসব লাইনের বেশির ভাগই অপরিকল্পিতভাবে টানানো হয়। দুর্ঘটনার পর কিংবা গণমাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে কয়েকদিন তালিকা তৈরির (ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের) তোড়জোড় চলে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বন্ধ হয়ে যায় এ কার্যক্রম। 
গ্রাহকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন ও খুঁটির বিষয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে অবগত করলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এতে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন এলাকাবাসী। গ্রাহকদের কয়েকজন জানান, ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের বিষয়ে অফিসে জানালে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। কোনো ব্যাপারে অভিযোগ করলে উল্টো গ্রাহকদের ভোগান্তি দেন তারা। বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা একটি দালাল চক্র গ্রাহক হয়রানিতে জড়িত।   
বড়লেখা উপজেলার বর্ণি, দাসেরবাজার, নিজবাহাদুরপুর, বড়লেখা সদর, তালিমপুর ও দক্ষিণভাগ ইউনিয়ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ও বেশ কিছু খুঁটি। এই কার্যালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকার চার শতাধিক স্থানে এমন ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন রয়েছে। 
উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়নের পকুয়া গ্রামের সত্যেন্দ্র বিশ্বাস জানান, অনেক দিন আগে তার বাড়ির সামনে থাকা পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইনের ব্যাপারে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টদের। এরপর একাধিকবার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে চক্কর কেটেও সমাধান পাননি। এ বিষয়ে সম্প্রতি তিনি বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের এজিএম (ওঅ্যান্ডএম) আশরাফ হায়দারের কাছেও একাধিকবার গিয়েছেন। তবে এজিএমের কাছ থেকেও কোনো সমাধান পাননি।
সত্যেন্দ্র বিশ্বাসের অভিযোগ, লাইনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। হাতের নাগালে চলে আসছে। যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। অফিসে গেলে কর্মকর্তারা ধমকের সুরে কথা বলেন। এক কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তার টেবিলে পাঠান। এভাবে চক্কর কাটাতে থাকেন সেবাগ্রহীতাদের। হয়তো বড় কোনো দুর্ঘটনার পরই তারা আসবেন।
বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মহদিকোনা গ্রামের শাহাবুদ্দিনের বাড়ির একটি বসতঘরের ছাদের ওপর দেখা যায় বিদ্যুতের ঝুলন্ত সঞ্চালন লাইন। তারগুলো হাত দিলেই ছোঁয়া যায়। প্রায় দুই বছর ধরে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও এর সমাধান পাননি। পরে নিজেই বাঁশের খুঁটি দিয়ে লাইনগুলো একটু উঁচু করে দিয়েছেন। এরপরও ছাদে গেলে সেগুলোর নাগাল পাওয়া যায়।
দাসেরবাজার ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের মতিন মিয়ার বাড়িতেও দেখা গেছে একই দৃশ্য। মতিন ও তাঁর প্রতিবেশীর বাড়ির ওপর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টানানো রয়েছে পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন তার। সেগুলো একেবারে নাগালের মধ্যে। ঝুঁকি এড়াতে এখানেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঁশ দিয়ে লাইনগুলো খানিকটা উঁচুতে তুলে রেখেছেন। পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় অভিযোগ কেন্দ্র ও বড়লেখা অফিসে একাধিকবার জানিয়েও সমাধান পাননি। 
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক খায়রুল বাকী খান জানান, ঝুঁকিপূর্ণ লাইনগুলো  এই মাসের মধ্যে চিহ্নিত করে নকশা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আগামী মাসেই এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঘর ত র ক প র ণ ল ইন ল ইন র ব উপজ ল র ন এল ক র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

মাঠের বিদায় কেন ফেসবুকে

‘সব কিছু নিখুঁতভাবে শেষ হয় না। তার পরও একটা সময় শেষ বলে সামনে এগিয়ে যেতে হয়’– বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে দেওয়া অবসরের ঘোষণায় এই দুটি লাইনে মাহমুদউল্লাহর আক্ষেপটা টের পাওয়া যায়।

কী নিয়ে আক্ষেপ, সেটা সবার জানা। আর মাহমুদউল্লাহ একা নন; মাশরাফি মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম– বাংলাদেশের ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্ম হিসেবে খ্যাত এই পাঁচজনের একই আক্ষেপ। মাঠের বদলে তাদের অধিকাংশের বিদায় নিতে হয়েছে ফেসবুক থেকে! যাদের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সিংহভাগ অর্জন, তাদের এমন আক্ষেপভরা বিদায় কেন? দায়টাই বা কার?

মাশরাফি মুর্তজাকে দিয়ে এই পঞ্চপাণ্ডবের বিদায়ের সূচনা। ১২ মার্চ মাহমুদউল্লাহকে দিয়ে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। তবে মুশফিকুর রহিম এখনও টেস্ট থেকে অবসর নেননি। মাশরাফি অবশ্য অবসরের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। ২০০৯ সালে উইন্ডিজ সফরে চোট পাওয়ার পর থেকে তিনি আর টেস্ট খেলেননি। 

২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে অভিমান করেই টি২০ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়েন। এরপরই গুঞ্জন ওঠে মিরপুরে বিদায়ী ম্যাচ খেলতে চান মাশরাফি। বিসিবি থেকেও আয়োজনের কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কী এক কারণে সেই ম্যাচ হয়নি।  

সাকিব আল হাসান দেশের মাটি থেকে অবসর নেওয়া ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে কানপুরে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট শেষে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, শেষ টি২০ খেলে ফেলেছেন, দেশের মাটিতে টেস্ট থেকে অবসর নিতে চান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে ওয়ানডে ছাড়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন। কিন্তু দুটোর একটাও হয়নি। 

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার জেরে গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আর দেশে ফিরতে পারেননি। তাঁর নামে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে। তাই সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ বলেই ধরে নেওয়া যায়। 

তামিম ইকবালের অবসর নিয়ে নাটক হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জাতীয় দলে খেলবেন নাকি অবসর নেবেন, এ নিয়ে প্রায় দুই বছর নানা আলোচনার পর গত ১০ জানুয়ারি ফেসবুকে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম। ফলে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেটি জাতীয় দলের হয়ে তাঁর শেষ ম্যাচ হয়ে রইল। 
মুশফিকুর রহিম টি২০ বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের জেরে সমালোচনার শিকার হলে ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে কুড়ি ওভারের ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। সদ্য সমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও বাজ পারফরম্যান্সের কারণে সমালোচনা হলে ওয়ানডে থেকে তিনি অবসরের ঘোষণা দেন ৫ মার্চ। 

গত বুধবার মাহমুদউল্লাহর অবসরের পর একটা বিষয়ে জোরেশোরেই আলোচনা শুরু হয়েছে। কেন তারা মাঠ থেকে অবসর নিতে পারলেন না? মাঠ থেকে অবসর নেওয়ার সংস্কৃতি কী দেখা যাবে? 

এ বিষয়ে গতকাল কথা বলেছেন সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন, ‘ওদের (মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ) ক্যারিয়ারটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য উজ্জ্বল ব্যাপার। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় নিয়ে এসেছিল ওরা। আমি মনে করি মাঠ থেকে অবসর ওদের প্রাপ্য। কেন ওরা মাঠ থেকে অবসর নিল না, সেটা ওরাই ভালো বলতে পারবে।’ 

বিষয়টা নিয়ে আফসোস করেছেন আরেক সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারও, ‘মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারলে অবশ্যই ভালো হতো। সেটা তাদের প্রাপ্যও। বাংলাদেশ দলের জন্য যা করেছে, মাঠ থেকে নিতে পারলে খুব ভালো হতো। ভরা স্টেডিয়াম থেকে নিতে পারলে বিদায়টা প্রকৃত অর্থেই সুন্দর হতো।’ 

মাহমুদউল্লাহর বিদায় নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই বিষাদের একটি মুহূর্ত। প্রায় দুই দশক জাতীয় দলের অন্যতম প্রধান ভরসা ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। খেলার প্রতি তাঁর নিবেদন ও পারফরম্যান্স ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা মানদণ্ড তৈরি করেছে।’ তবে মাঠ থেকে বিদায় বিষয়ে কিছু বলেননি বিসিবি সভাপতি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ