বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ বলিয়া পরিচিত তিস্তা নদী ঘিরিয়া বহুল আলোচিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেইভাবে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে, উহা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। তিস্তাতীরবর্তী জনসাধারণের উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ হইতে বাধ্য। রবিবার রংপুরে তিস্তা রেলসেতু এলাকায় জেলা প্রশাসন আয়োজিত গণশুনানি অনুষ্ঠানে জনসমাগমেই উহা স্পষ্ট। কেবল সশরীতে উপস্থিতির ক্ষেত্রে নহে, গত কয়েক বৎসর ধরিয়া ঐ অঞ্চলের মানুষ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে উহার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করিয়া আসিতেছে। মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনও কম অনুষ্ঠিত হয় নাই। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারও উহার পক্ষে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ লইয়াছিল। প্রকল্পের প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের সহিত চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পৃক্ত থাকিবার কারণে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারই শেষ মুহূর্তে কীভাবে পিছাইয়া আসিয়াছিল, আমরা জানি। এমনকি ঐ সরকারের পক্ষে যেইভাবে চীনের পরিবর্তে ভারতকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিবার মাধ্যমে মহাপরিকল্পনাটি যে কার্যত ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়ছিল, উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ উৎসাহব্যঞ্জকই বটে।
আমরা জানি, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হইতে বাংলাদেশে নামিয়া আসা নদীটির বর্তমান দশা ঐ জনগোষ্ঠীর জন্যই অধিকতর দুর্যোগময়। বর্ষা মৌসুমে বিপুল প্রবাহ যদ্রূপ প্রবল বন্যা ও করাল ভাঙনের সৃষ্টি করে; শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহস্বল্পতা এমনকি প্রবাহশূন্যতা তদ্রূপ সেচ, নৌ চলাচল ও মৎস্যসম্পদে বিরূপ প্রভাব ফেলিয়া থাকে। স্বীকার্য, তিস্তার ন্যায় পার্বত্য নদীতে মৌসুমভেদে প্রবাহের তারতম্য স্বাভাবিক। কিন্তু নদীটিতে এইরূপ বৈপরীত্যের প্রধান কারণ যতখানি না প্রাকৃতিক, তাহার তুলনায় অধিকতর মনুষ্যসৃষ্ট। কারণ, তিস্তার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যদ্রূপ গজলডোবা নামক এলাকায় একটি ব্যারাজ তথা পানি প্রত্যাহারকারী স্থাপনা রহিয়াছে, তদ্রূপ আরও উজানে সিকিম রাজ্যে স্থাপিত হইয়াছে আক্ষরিক অর্থেই কয়েক ডজন ড্যাম তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। উভয় প্রকার স্থাপনার ক্ষেত্রেই ভাটির দেশ বাংলাদেশের ভাগ্যে পানিশূন্যতা ব্যতীত আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশের নীলফামারীর ডালিয়া নামক এলাকায় যদিও অপর একটি ব্যারাজ রহিয়াছে; উজানে পানি প্রত্যাহার ও চক্রায়নের ফাঁদে পড়িয়া উহার সচলতা নামমাত্র। এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনের প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু ২০১১ সাল হইতে উহাও রহিয়াছে ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। ভারতীয় পক্ষ হইতে তিস্তা বাহিয়া বৎসর বৎসর কেবল প্রতিশ্রুতিই গড়াইয়াছে; পানি নহে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা মনে করিয়াছি, বর্ষার বিপুল প্রবাহ ধারণ করিবার জন্য জলাধার এবং শুষ্ক মৌসুমে স্বল্পপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাব্য রক্ষাই হইতে পারে সমাধান। আলোচিত তিস্তা মহাপরিকল্পনাতে এইরূপ সমাধানই নির্দেশ করা হইয়াছিল। অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা ইহাও একাধিকবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছি– কেবল একপক্ষীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা সংকটের সমাধান সম্ভব নহে। ভাটিতে ‘ব্যবস্থাপনা’ নিশ্চিত করিতে হইলে উজানে ‘প্রাপ্যতা’ নিশ্চিতকরণের বিকল্প নাই। যেই কারণে চীনের প্রযোজনায় যখন মহাপরিকল্পনা গ্রহণের তোড়জোড় চলিতেছিল, তখন আমরা বলিয়াছিলাম, দ্বিপক্ষীয় নহে, প্রকল্পটি হইতে হইবে বহুপক্ষীয়। সেই ক্ষেত্রে চীনের সহিত ভারত তো বটেই, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ন্যায় আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলিকেও সম্পৃক্ত হইতে হইবে। আর প্রকল্পের পূর্বেই অববাহিকার দেশগুলি তথা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে অববাহিকাভিত্তিক অধিকার নিশ্চিত করিতে হইবে। অন্যথায় প্রকল্প হইলেও সুফল অনিশ্চিত থাকিয়া যাইবার আশঙ্কা ষোলআনা থাকিয়া যাইবে।
বর্তমানে চীনের সহিত মিলিয়া নূতন করিয়া তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আমরা পুরাতন সতর্কতা উচ্চারণ করিতে চাহি; প্রকল্পটি বহুপক্ষীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাহাতে চীন, ভারতের সহিত বিশ্বব্যাংক ও এডিবি যুক্ত হইবার মধ্য দিয়া বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল পাইবার মাধ্যমে রংপুরবাসীর উৎসাহ সার্থক হইয়া উঠে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র সহ ত উৎস হ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ কাম্য
আলু লইয়া কৃষক এইবারও দুর্দশায় নিপতিত হইল। রবিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন বলিতেছে, এক কেজি আলুর উৎপাদন ব্যয় ১৪ হইতে ১৬ টাকা হইলেও কৃষককে উহা বিক্রয় করিতে হইতেছে মাত্র ১০-১২ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি আলুতে কৃষককে লোকসান গুনিতে হইতেছে ৫ টাকা অবধি। শুধু উহাই নহে, লোকসান হইতে বাঁচিতে বর্তমানে বিভিন্ন এলাকার কৃষকের হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও নূতন সংকট সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমত, দেশে চলতি বৎসর আলু উৎপাদন ১ কোটি ২০ লক্ষ টন হইবে বলিয়া ধারণা করা হইতেছে। কিন্তু বিদ্যমান হিমাগারসমূহের মোট ধারণক্ষমতা মাত্র ৪৫ লক্ষ টন। সেই হিসাবে বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারের বাহিরে থাকিবে। দ্বিতীয়ত, গত বৎসর অপেক্ষা এইবার কেজিতে ১ টাকা বৃদ্ধি করিয়া হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হইয়াছে, যাহা বহন করা বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু, পূর্বে এক বস্তায় ৭০-৮০ কেজি আলু রাখা গেলেও এইবার ৫০ কেজির অধিক রাখা যাইবে না বলিয়া হিমাগার মালিক সমিতি জানাইয়া দিয়াছে। এইদিক হইতেও আলু সংরক্ষণে কৃষকের ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাইবে। মোদ্দা কথা, আলু লইয়া কৃষকদের উভয় সংকটে পড়িতে হইতেছে। হিমাগারে না রাখিতে পাইলে উহা একেবারে জলমূল্যে বিক্রয় করিতে হইবে; আর হিমাগারে রাখিলেও উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যয় মিলাইয়া প্রতি কেজিতে কৃষকের ব্যয় এতই বৃদ্ধি পাইতে পারে, যাহা উসুল করা ভীষণ ত্রুটিযুক্ত বিদ্যমান বিপণন ব্যবস্থায় অসম্ভব হইতে পারে।
দেশে বাৎসরিক আলুর চাহিদা প্রায় ৯০ লক্ষ টন। সেই হিসাবে এইবার আলুর বাম্পার ফলন হইয়াছে, বলা যায়। দেশের প্রধান সবজির বাম্পার ফলন নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। কিন্তু পরিস্থিতি বলিতেছে, আলুর এই বাম্পার ফলন কৃষকের জন্য তো বটেই, ভোক্তাদের জন্যও এক দুঃস্বপ্ন হইতে চলিয়াছে। এই কথা বলিবার কারণ, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একদিকে কৃষককে সস্তা দরে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফল বিক্রয় করিয়া দিতে হইবে, অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা সমুদয় আলু ক্রয় করিয়া মৌসুম অন্তে বাজারে তাহাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিতে পারে। ফলে বর্তমানে সাময়িক সময়ের জন্য ভোক্তারা স্বল্প দরে আলু ক্রয় করিতে পারিলেও মৌসুম অন্তে অতি উচ্চমূল্যে তাহাদের অপরিহার্য এই সবজিটি ক্রয় করিতে হইবে, যেই পরিস্থিতি সাম্প্রতিক অতীতেও দেখা গিয়াছে। যাহা অধিকতর আশঙ্কার, অমানুষিক পরিশ্রমের সহিত রীতিমতো ধারকর্জ করিয়া এহেন বাম্পার ফলনের পর কৃষকদের যদি লোকসান গুনিতে হয়, তাহা হইলে একসময়ে হতাশ হইয়া কৃষক আলু চাষই বন্ধ করিয়া দিতে পারে, যাহা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করিবে।
বাম্পার ফলনের কারণে আলুচাষির দুর্দশা এই বৎসরই নূতন নহে। আলু, তৎসহিত ধান এবং অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও প্রায়শ সমপরিস্থিতি দৃশ্যমান। কিন্তু দুঃখজনক, অতীতের কোনো সরকার বিষয়টি লইয়া গভীর কোনো ভাবনা ভাবে নাই। বিশেষজ্ঞরা বহু বৎসর যাবৎ উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণের উপর গুরুত্ব দিলেও খুব একটা পাত্তা পায় নাই। বিশেষত রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদন ও বিপণনের পথে যেই সকল বাধা ইতোমধ্যে চিহ্নিত, সেইগুলি দূরীকরণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নাই। তবে ইচ্ছা করিলে সরকার আলু সংরক্ষণ প্রশ্নে কৃষকের পার্শ্বে সহজেই দাঁড়াইতে পারে বলিয়া আমরা মনে করি। এই লক্ষ্যে সরকার বিশেষত প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণ ব্যয় লইয়া হিমাগার মালিকদের সমিতির সহিত আলোচনায় বসিতে পারে। প্রয়োজনে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, বর্ধিত ব্যাংক ঋণের সুদ, বীমা ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে তাহাদের উদ্বেগ হ্রাসে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে। জাতীয় স্বার্থেই দ্রুত এই সকল পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।