চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাম্ভিক কথাবার্তা, অনুশোচনাহীন মনোভাব ও ‘তালগাছটি আমার’ যুক্তিবোধ অক্ষুণ্ন রেখেছেন। বারকয়েক টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস, ভার্চুয়াল সভায় বক্তৃতায় তা স্পষ্ট হয়েছে। সর্বশেষ গত ৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের ঘোষণার পর গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। রাত ৯টায় বক্তব্য প্রদানের দুই ঘণ্টা আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ভাঙচুর শুরু হয়। ভাঙচুরে প্রচলিত সামগ্রীর পাশাপাশি এবারই প্রথম বুলডোজার প্রয়োগের দেখাও মেলে। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি টানা ১৫ ঘণ্টার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে এক্সক্যাভেটর, ক্রেন ও বুলডোজার ব্যবহার করে ইতিহাসের অন্যতম সূতিকাগার বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তেও হামলা, ভাঙচুর শুরু হয়। দুই দিনে গাজীপুর, বরিশালসহ অন্তত ৩৫ জেলায় আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের অন্তত ৩৩টি বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয় (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি)। বাড়িঘরের পাশাপাশি ম্যুরাল, নামফলক, ভাস্কর্যও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এবারই প্রথম বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুরে বুলডোজার ব্যবহার করা হয়, যাকে ‘বুলডোজার শোভাযাত্রা’ অভিহিত করেছেন উৎসাহীরা। 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ৬ মাস পূর্তি হলো ৮ ফেব্রুয়ারি। সংবাদমাধ্যমে যখন এই সরকারের কর্মতৎপরতার অর্ধবার্ষিক খতিয়ান দেখবার ব্যাপারে আমরা উৎসুক ছিলাম, তার তিন দিন আগে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বুলডোজার শোভাযাত্রা শুরু এবং দেশব্যাপী তা ছড়িয়ে গেল!

অভ্যুত্থানের পরপরই বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তৎকালীন বাস্তবতায় সেটি বিক্ষুব্ধ জনতার কার্যক্রম হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। ছয় মাস পর কেন বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার তাণ্ডব শুরু হলো, ভেবে দেখতে হবে। জনতা দুই ঘণ্টা আগেই জেনে গিয়েছিল, শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেবেন? তিনি যে এভাবে কথা বলেন, তা দেশের মানুষ জানেন। এমনকি শেখ হাসিনাসহ তাঁর অনুগতরা যে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন ও প্রচার করেন, এটিও কারও অজানা নয়। তবে শেখ হাসিনা ও তাঁর অনুগতরা অন্যায় আচরণ করলেই তাদের স্থাপনাসহ যাবতীয় ভাস্কর্য-ম্যুরাল-নামফলক বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে– এটি কোনো সভ্য সমাজের আচরণ হতে পারে না। 

স্তম্ভিত হয়ে দেখতে হয়, দেশের ইতিহাসের অন্যতম আঁতুড়ঘর– ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ক্রুদ্ধ জনতার হাতে বুলডোজার আর ক্রেন দিয়ে দু’দিন ধরে ভাঙা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার থাকে। এরপরও আমাদের দেশকে সভ্য দাবি করব? এরপরও এই রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ তৈরি হবে না? বুলডোজার কি একটি কোদাল যে, একজন মানুষ ইচ্ছা করল আর হাতে নিয়ে রওনা দিল আরেকজনের বাড়ি ভাঙতে! সিটি করপোরেশনের বুলডোজার ভাঙচুরের জন্য উত্তেজিত জনতার হাতে পৌঁছল কীভাবে?
এভাবে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটবার পর সরকারের দায়িত্ববোধ নিয়েই প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন জাগে। একটি দেশে সরকার থাকে কেন? আইনের শাসন সমুন্নত রাখবার জন্য– এই সরল সত্যের প্রতি আর আস্থা থাকে না সাম্প্রতিক এই ঘটনায়।

২.


কেন এই ঘটনা ঘটল? শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছেন। বেশ; তিনি যদি আবার বক্তৃতা দেন, এরপর কোন বাড়ি ভাঙবেন উত্তেজিত ছাত্র-জনতা? তারপর আবার যখন বক্তৃতা দেবেন? এভাবে একের পর এক ভাঙচুর চলতেই থাকবে, নাকি শেখ হাসিনা যে অন্যায় আচরণ ও অযৌক্তিক কথা বলছেন, যুক্তিসম্মত ভাষা ও উপায়ে তা সকলকে জানিয়ে দেওয়াই উপযুক্ত কর্তব্য হতে পারে বা পারত? 
যারা বাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন, তারা যে এই কথা জানেন না, তা-ও সম্ভবত নয়। তাহলে ভাঙচুর হচ্ছে কেন? পানি ঘোলা করে আগামী সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো মাছ শিকারের জন্য? দেশব্যাপী অরাজকতা তৈরি হলে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, এটা যারা জানেন; তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতেই পারেন। সেটি যে শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া অনুচরেরাও করছেন না, তা যেমন আমরা বলতে পারি না; আবার উগ্রবাদী কোনো গোষ্ঠী– দেশের অস্থিতিশীলতাই যাদের চূড়ান্ত মোক্ষ; তারা যে এটি তৈরি করবার চেষ্টা করছেন না, তা-ও আমরা বলতে পারি না।

স্বৈরাচারের দোসর হোক আর উগ্রবাদীরাই হোক– যারাই দেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চান, এটি তাদের কৌশল হতে পারে। দেশ অস্থিতিশীল হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সবাইকে জানানো ও বোঝানো যায়, গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গেছে। সরকারও পারছে না। তাদের স্বার্থ এতে সিদ্ধি হলেও হতে পারে; কিন্তু সরকার কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হতে দিচ্ছে? সরকার কেন নির্বিকার থাকতে পারল? কোথায় তখন আইনের শাসন? 

৩.
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর মাটির সঙ্গে মিশে যাবার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৭ ফেব্রুয়ারি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পত্তি এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আর কোনো হামলা হবে না– তা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব ব্যক্তি সম্পত্তির ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের ক্ষোভ বোঝা যায়, কারণ তারা এবং তাদের স্বজন শেখ হাসিনার শাসনামলে বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’

না, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। শেখ হাসিনার শাসনামলে যারা বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা চাইলেই ঘোষণা দিয়ে, বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিতে পারেন না। তাহলে রাষ্ট্র বা সরকারের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। যে কোনো ব্যক্তির সংক্ষুব্ধ হবার অবশ্যই অধিকার আছে, সেটি জানানোর প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত আছে– আইন ও আদালত। আইনের শাসন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন যে কোনো দেশের সরকারের প্রধান কর্তব্য। সেই কর্তব্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত দেখা গেছে সাম্প্রতিক বুলডোজার শোভাযাত্রায়। সরকারের এই নির্বিকারত্ব জাতির জন্য লজ্জা ও অপমানের।
একটি দেশে তিল তিল করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরম্পরা তৈরি হয়। শত বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। ষাট ও সত্তর দশকে এ দেশে প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার অন্যতম কেন্দ্র ধানমন্ডির ৩২ নম্বর। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান যেমন অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না, তেমনি এসব কিছুই আর শেখ হাসিনার পৈতৃক সম্পত্তি নয়। এসব জাতির চিরকালীন উত্তরাধিকার। ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়া অবশ্যই লজ্জা ও ধিক্কারজনক। এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করা তাই সংগত। 

বিশ্বজুড়ে ঐতিহাসিক স্থান ও কীর্তিগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত সাক্ষী কিংবা ঊনসত্তর-একাত্তরের উত্তাল মার্চের প্রতিটি মুহূর্তের অনশ্বর ধারক বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া শুধুই একটি স্থাপনা ধ্বংস নয়; জাতির ইতিহাস থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অপসারণের চেষ্টা। এসব কোনোটিই কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ৩২ নম্বর ও পরে দেশজুড়ে ভাঙচুরের ঘটনায় সরকারের নির্বিকারত্ব অবশ্যই অযুত প্রশ্নের উদ্রেককারী। সরকারকেই তৎপরতা ও সততার সঙ্গে এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর হাজির করতে হবে। 

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbub aziz01@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন সরক র র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোকেই নাড়া দেয়নি, বরং পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক কৌশলেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা ঐতিহ্য ও প্রথাগত কূটনৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রকৃত মিত্র ও প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এই পরিবর্তন অতীতের পরনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে জাতীয় মর্যাদা, আত্মসম্মান ও বৈশ্বিক পরিসরে সমান অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন কৌশল গ্রহণ করার।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে তার কূটনীতি পরিচালনা করে এসেছে। এটি তাত্ত্বিকভাবে মহৎ শোনালেও বাস্তবে সব সময় তা যে কার্যকর হয়নি, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধু বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে চলে না। বরং এটি স্বার্থ, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং কৌশলগত অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিশ্বপরিসরে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকেও বাস্তববাদী ও কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যা জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।

কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু দেশের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে একতরফা ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির কথা বলা যায়। ক্ষমতাচ্যুত সরকার ও তার পৃষ্ঠপোষক অর্থনীতিবিদরা দাবি করেছিলেন, এসব চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো বাণিজ্যিক হাব হয়ে উঠবে। বাস্তবে দেখা গেছে, এতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের লাভই বেশি। 
গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করে সরকার এখন কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হচ্ছে। তাই সামনে চলে এসেছে নতুন পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনীয়তা। নীতিগতভাবে ও তাত্ত্বিক দিক থেকেও একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল আত্মমর্যাদা, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মর্যাদা। কিন্তু গত কয়েক দশকে আমাদের কূটনীতি ক্রমেই আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে নতিস্বীকারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই ভুলগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে এমন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস হবে না। সেদিকে এগোনোর সময় তাই লক্ষ্য রাখতে হবে কিছু বিষয়।
প্রথমত, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করাই হতে হবে নতুন কূটনৈতিক কৌশলের মূলনীতি। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে শ্রমিক, পেশাজীবী ও উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। তাদের অধিকার, সুরক্ষা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই সমান মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বপরিসরে নতজানু ভঙ্গির বদলে শক্তিশালী ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে হবে।

তৃতীয়ত, গণঅভ্যুত্থান শিখিয়েছে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কেবল সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; জনগণের মতামত বিদেশনীতি নির্ধারণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে। অতীতে বিদেশি শক্তির সঙ্গে চুক্তি করার সময় জনমতের গুরুত্ব খুব বেশি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা স্পষ্ট করেছে, জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করা হলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে– এ কথা বলাই বাহুল্য।
বর্তমান সরকার বুঝতে পারছে, শুধু বড় দেশগুলোর সমর্থনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র কাকে সমর্থন করবে, তা তাদের নিজস্ব স্বার্থে নির্ধারিত হয়। অতীতে দেখা গেছে, প্রয়োজন পড়লে আন্তর্জাতিক মিত্ররাও নিজেদের স্বার্থে সম্পর্কের হিসাবনিকাশ বদলে ফেলে। তাই বাংলাদেশকে নিজের কৌশল নিজেকেই ঠিক করতে হবে, যেখানে জনগণের ইচ্ছা হবে প্রধান বিবেচ্য।

পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। চীন ১৯৭৮ সালে অর্থনৈতিক উন্মুক্ততা গ্রহণ করে; তুরস্ক একুশ শতকের গোড়ায় বহুমুখী কূটনীতির দিকে ঝুঁকেছিল; ফ্রান্স ১৯৬৬ সালে ন্যাটো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশ এতদিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করে চলছিল। এই নির্ভরশীলতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে অনেক সময় বাধ্য হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা নিজের স্বার্থের পরিপন্থি। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই পুরোনো ধাঁচের নীতি থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, সব দেশই সমান মর্যাদার অধিকারী। জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১(২) ও ২(১) অনুযায়ী এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সমান মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার। অতএব, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত এমন, যেখানে আমরা কারও তল্পিবাহক হয়ে থাকব না, বরং বিশ্বমঞ্চে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করব। সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস নয়।

পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথা নত করবে না। বর্তমানে সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে যে, কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশি শক্তির আশীর্বাদ কামনা তাদের চরিত্র নয়। বরং তারা জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
এই কৌশলগত পরিবর্তন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও দৃঢ় অবস্থান নিতে সাহায্য করবে। কূটনীতির ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হলে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, কূটনীতিকদেরও নতুনভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের প্রতিনিধিত্ব এমন হতে হবে, যেখানে আমরা অন্যদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল নই, বরং সমান শর্তে আলোচনা করতে পারি।
বাংলাদেশকে অবশ্যই তার পুরোনো পররাষ্ট্রনীতি ঝেড়ে ফেলে, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সময় এসেছে, যখন বাংলাদেশকে বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে না থেকে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে। 
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কেবল সরকারের জন্য নয়, কূটনীতির ক্ষেত্রেও এক শিক্ষণীয় অধ্যায় তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল ও সম্মানজনক  একটি পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন।

আলাউদ্দিন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, এনসিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তরুণরাই মোড় পরিবর্তনের দিশারি
  • সাংবাদিকদের বেতন বাড়াতে আরেকটি আন্দোলন করা উচিত: প্রেস সচিব
  • তিন দিন কর্মস্থলে আসছেন না এডিসি রাশেদ, ফোন বন্ধ
  • পুলিশের সেই এডিসি রাশেদ তিন দিন ধরে অফিসে আসছেন না
  • পুলিশের সেই এডিসি রাশেদ ‘আত্মগোপনে’
  • ‘কিংস পার্টি’ গঠনের তাত্ত্বিক বাস্তবতা
  • গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী শক্তি দেশ চালাচ্ছে: তথ্য উপদেষ্টা
  • সংবাদমাধ্যম কেন ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হতে পারছে না?
  • পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য
  • বিচার-সংস্কার দাবিতে দ্রুত রাজপথে নামার ঘোষণা এনসিপির