প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বৃদ্ধি, বিদ্যালয়কে লাল, হলুদ ও সবুজ শ্রেণিতে ভাগ করার সুপারিশ
Published: 10th, February 2025 GMT
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এক ধাপ বৃদ্ধি এবং সহকারী শিক্ষকের বিদ্যমান পদ বিলুপ্ত করে নতুন পদবির সুপারিশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটি। এই কমিটি শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিও করতে বলেছে।
পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শতাধিক সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শেখাতে শ্রেণির ভেতরে ও বাইরে সহায়তার ব্যবস্থা রাখা, অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ‘প্যারা শিক্ষক’ নিয়োগ, মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোকে লাল (পিছিয়ে পড়া), হলুদ (মধ্যম) ও সবুজ (ভালো)—এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। পরার্শক কমিটি প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত উন্নয়নেও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি’ আজ সোমবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে।
পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন অধ্যাপক মনজুর আহমদ। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পরামর্শক কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, তা মানার নৈতিক দায় আমাদের আছে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তাদের কিছু সুপারিশ আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারব। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে অন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করব। আর কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত দরকার। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জীবনের মানোন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদার উন্নয়নে ইতিবাচক।’
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সাবেক সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খোন্দকার মো.
বেতন বৃদ্ধি ও পদ পরিবর্তন
বর্তমানে সারা দেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌনে চার লাখের মতো শিক্ষক আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১তম। আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩তম। এখন পরামর্শক কমিটি ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ বিলুপ্ত করে শুরুর পদ ‘শিক্ষক’ করার সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ‘শিক্ষক’ হিসেবে শুরুতে বেতন গ্রেড হবে ১২তম (শুরুর মূল বেতন হবে ১১ হাজার ৩০০ টাকা, এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যোগ হবে)। এরপর দুই বছর পর চাকরি স্থায়ীকরণ ও আরও দুই বছর পর তাঁরা ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হবেন। তখন তাঁদের বেতন গ্রেড হবে ১১তম।
পরামর্শক কমিটি বলেছে, প্রধান শিক্ষকদের বর্তমান বেতন গ্রেড ১১তম হলেও তাঁদের ১০ম গ্রেডে পদায়নের দাবি উচ্চ আদালতের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে রিভিউ আবেদন করেছে। এ ক্ষেত্রে এই রিভিউ আবেদন প্রত্যাহার করে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
কমিটি সব প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষক পদে ৬৫ শতাংশ নিয়োগ হয় পদোন্নতির মাধ্যমে। আর ৩৫ শতাংশ নিয়োগ হয় সরাসরি।
পরামর্শক কমিটি বলেছে, ‘শিক্ষক’ ও প্রধান শিক্ষকেরা নিয়মানুযায়ী উচ্চতর স্কেল পাওয়ার যোগ্য হবেন। এ ছাড়া নিয়োগবিধিতে থাকা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ বৃদ্ধি করে ‘সিনিয়র শিক্ষকদের’ মধ্য থেকে দায়িত্ব ভাতাসহ এসব পদে পদায়ন করতে বলেছে। প্রাথমিক শিক্ষার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে পদোন্নতিযোগ্য পদ ও শূন্য পদগুলো আশু পূরণ, পারস্পরিক বদলি, আঞ্চলিক অফিস স্থাপন এবং প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসের সুপারিশ করেছে পরামর্শক কমিটি।
লাল, হলুদ ও সবুজ শ্রেণিতে বিদ্যালয়
পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বা এ ধরনের পরীক্ষার পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (এনএসএ) আদলে মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়কে লাল, হলুদ ও সবুজ—এই তিন শ্রেণিতে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছে। এরপর লাল ও হলুদ তালিকাভুক্ত বিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন করে যাতে সবুজ শ্রেণিতে যেতে পারে, সে জন্য কর্মপরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
কমিটি শিখন সময় বৃদ্ধির জন্য সব বিদ্যালয়কে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এক পালার (শিফট) বিদ্যালয়ে পরিণত করার পরামর্শ দিয়েছে। আর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত অনূর্ধ্ব ৩০ জন শিক্ষার্থীদের বিপরীতে একজন শিক্ষক নিশ্চিত করতে বলেছে। এ ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব ‘মিড–ডে মিল’ চালু, খাতা-কলম-ব্যাগ ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বর্ধিত হারে অর্থ-সাহায্য করতে বলা হয়েছে।
বাংলা-গণিতে পড়ানোর ওপর জোর
পরামর্শক কমিটি শিশুদের বাংলা ও গণিতের দক্ষতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলা শুধু একটি বিষয় নয়, এটি অন্য সব বিষয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। আর গণিতে মৌলিক দক্ষতা অর্জন না হলে শিক্ষার্থীরা শিখনে ক্রমাগত পিছিয়ে থাকবে। এ জন্য বাংলা ও গণিতে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭৫ মিনিট করে শিক্ষণ-শিখন সময় নির্ধারণ করতে বলেছে।
শিক্ষার ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে পরামর্শ কমিটি দেশের ১০ জেলায় ২০টি উপজেলায় পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পরীক্ষামূলক বা পাইলট প্রকল্প শুরুর সুপারিশ করেছে। আর বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা ও ঝরে পড়া শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ও দক্ষ এনজিওদের সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যকর মডেল তৈরি করতে বলেছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী সর্বজনীন প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মানসম্মত বিদ্যালয় শিক্ষার খাত পরিকল্পনা এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে পরামর্শক কমিটি। তারা বলেছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র শিক্ষা খাতের সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিতে ‘শিক্ষা পরামর্শক পরিষদ’ গঠন করা যেতে পারে। পরে এটি স্থায়ী কমিশনে রূপান্তরিত হতে পারে।
‘শিক্ষা সংস্কারে জাদু–সমাধান নেই’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, শিক্ষা সংস্কারে কোনো সহজ জাদু–সমাধান নেই। এসব সুপারিশ সম্পর্কে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সময়রেখা নির্ধারণ করে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আসন্ন পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারের বার্ষিক বাজেট হবে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রধান বাহন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক শ ক ষ র ম ন ন নয়ন উপ ন ষ ঠ ন ক শ ক ষ র স প র শ কর ছ র শ ক ষকদ র ব যবস থ র জন য কম ট র ও সব জ সরক র সহক র
এছাড়াও পড়ুন:
গাজীপুরে মোজাম্মেলের বাড়িতে আহতদের দেখতে হাসপাতালে হাসনাত ও সারজিস
গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গতকাল শুক্রবার রাতেই হাসপাতালে গেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম। গতকাল রাত তিনটার দিকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নিতে যান তাঁরা।
এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার প্রতিবাদে আজ শনিবার বেলা ১১টায় গাজীপুর জেলা শহরের রাজবাড়ি মাঠে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনো অভিযোগ বা মামলা হয়নি।
আরও পড়ুনগাজীপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন২ ঘণ্টা আগেএর আগে গতকাল রাত ৯টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর ধীরাশ্রম দক্ষিণখান এলাকায় সাবেক মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হকের বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী আহত হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গাজীপুরের নেতা-কর্মীরা বলেন, হামলায় আহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাইকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হামলায় আহতদের দেখতে গতকাল রাত তিনটার দিকে হাসপাতালটিতে যান হাসনাত ও সারজিস।
আরও পড়ুনগাজীপুরে মোজাম্মেলের বাড়িতে আহত ৫ জন ঢাকা মেডিকেলে, মাথায়-হাতে গুরুতর আঘাত২৪ মিনিট আগেবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দাবি, গতকাল রাতে কাছে খবর আসে, ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে। এটি শোনার পর প্রতিহত করতে শিক্ষার্থীরা রওনা হয়। দ্রুত ১৫ থেকে ২০ জন ঘটনাস্থলে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে লুটপাট হচ্ছে। এ সময় মাইকে ঘোষণা দিয়ে শত শত মানুষকে জড়ো করা হয়। অন্য শিক্ষার্থীরা আসার আগেই ওই শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে বাসার ছাদে নিয়ে পেটানো হয়। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে গেলে তাঁদেরও পেটায় স্থানীয় বাসিন্দারা।
গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বলেন, ওই ঘটনায় সকাল ১০টা পর্যন্ত কোনো অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি।
আরও পড়ুনগাজীপুরে মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা, মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক ডেকে মারধরে আহত ১৫৯ ঘণ্টা আগে