জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক ১৫ ফেব্রুয়ারি
Published: 10th, February 2025 GMT
সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে এ তথ্য জানান তিনি।
শফিকুল আলম বলেন, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শরিকরা বৈঠকে অংশ নেবেন।
এসময় ডেপুটি প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর ও সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি উপস্থিত ছিলেন।
বিএইচ
.উৎস: SunBD 24
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় ঐকমত্য সমঝোতা স্মারকে যা থাকতে পারে
আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট গভীর, তা সমাধানের জন্য ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কারপ্রক্রিয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এই ঐকমত্য গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা বা কঠোর ‘প্রথমে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ বা ‘আমার পথই একমাত্র পথ’ ধরনের অনমনীয় মনোভাব সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। এর পরিবর্তে দরকার ‘ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির একটি নকশা’।
সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি মৌলনীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমে, রাজনৈতিক নেতারা জরুরি সংস্কার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির ইস্যুগুলো নির্ধারণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এজেন্ডাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইস্যুভিত্তিক প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন। সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে সর্বসম্মত ন্যূনতম ঐকমত্য খুঁজে বের করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা যায়। এর দুটি ধাপ থাকতে পারে। নির্বাচনের আগে এবং পরের ধাপের সংস্কার কার্যক্রম চিহ্নিত করা যায়।
জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতায় আন্তরিক থাকলে এই পদ্ধতিতে ‘সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি’ সমঝোতা স্মারকে পৌঁছানো সম্ভব। সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি সর্বরোগের ওষুধ নয়। এটি স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিতকরণ এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম পদক্ষেপ। এর কেন্দ্রে তিনটি মূল বিষয় থাকতে পারে। ক. শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর; খ. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গ. প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো। এগুলো কেবল রাজনৈতিক আদর্শ নয়; বরং বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য জরুরি প্রয়োজনীয়তা।
জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান প্রচলিত ব্যবস্থাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সমতা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দাবি এখন জাজ্বল্যমান। সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা ও পুলিশি কার্যক্রম নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো ঐকমত্য গঠনের জন্য ভিত্তি হতে পারে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কীভাবে সংলাপে সম্পৃক্ত হতে পারে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া হলো।
শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: একদলীয় আধিপত্যের চক্র ভাঙাক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের অভাব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। জনগণের আস্থা চুরমার করেছে। নির্বাচন তদারকির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন দেশীয় কায়দায় তৈরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতার অদলবদল ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া এবং হস্তান্তরকালে সহিংসতা বা বাধাবিঘ্ন থেকে বিরত থাকার জন্য একটি বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারেও সম্মত হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলোতে সার্বিক সম্মতি থাকলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন দল ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার ও সংসদের ভারসাম্য, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও মেয়াদসীমা নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য দৃশ্যমান। বিশেষভাবে নারীদের সংসদে অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব সীমিত এবং প্রচারাভিযান তহবিলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘প্রচারাভিযান তহবিল প্রবিধান’–এর বিষয়ে সম্মত হতে পারে। তদুপরি ছোট দলসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও হতে পারে সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন: ভোটারের আস্থা পুনঃস্থাপনবর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে বায়োমেট্রিক ভোটার যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু, ভুতুড়ে ভোটার দূর ও ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিশ্চিতি অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে পুনর্গঠন বিষয়ে জনগণের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে।
কমিশনারদের একটি স্বচ্ছ, বহুদলীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ‘রাতে ভোট’, ‘ভোটের আগেই প্রার্থী নির্বাচিত’ এবং ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার রোগ সারাতে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় আনার পরিষ্কার আইনি কাঠামো দরকার। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাষ্ট্র ও বেসরকারি মিডিয়ায় সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতি এবং নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে খ্যাতিমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর সংবিধির প্রয়োজন।
প্রতিনিধিত্বশীল শাসনকাঠামো: গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা একধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতি, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং বিচারকদের নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠছে। এ ধরনের সংস্কার জন–আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা, স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি মামলার স্বাধীন তদন্তের জন্য দুদককে পর্যাপ্ত সম্পদ ও কর্তৃত্ব প্রদান জরুরি।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করাও নাগরিকতন্ত্র গঠনের জন্য জরুরি। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনকাঠামোর জন্য তা অপরিহার্য। পুলিশ বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত করা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি নাগরিক সেবার জন্য আবশ্যিক শর্ত।
পুলিশের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ এবং তাদেরকে কমিউনিটির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাও একটি সম্ভাব্য সংস্কার পদক্ষেপ হতে পারে। এই সংস্কারগুলো আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাহী ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আদালতের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভাব্য ঐকমত্যের আরেকটি ক্ষেত্র।
এখনই সময় কথাকে কাজে পরিণত করারঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে অনুষ্ঠিত সংলাপ বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। রাজনৈতিক নেতারা যখন জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তাঁদের সে অনুযায়ী কাজও করতে হবে।
সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য নিখুঁত সংস্কার নয়; বরং সম্ভবপর সংস্কার বাস্তবায়ন করা। বর্ণিত ম্যাক্স-মিন পদ্ধতি (Max-min principle), তথা সর্বাধিক দলের ন্যূনতম জরুরি সংস্কারে একমত হওয়া একটি বাস্তবসম্মত পথ তৈরি করতে পারে। আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও স্থিতিশীলতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মূল সংস্কারে ঐকমত্য সম্ভব।
এই সংলাপকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিত রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক, ধৈর্যশীল, কার্যকর ভূমিকা পালন জরুরি। জনস্বার্থে সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বিদ্বৎসমাজেরও বিশাল ভূমিকা আছে।
সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি শেষ লক্ষ্য নয়। এটি বরং একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত মূল সংস্কার নিঃসন্দেহে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত তৈরি করবে।
এরপর একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী আরও ব্যাপক সংস্কার কার্যকর করতে পারবে। এর চেয়ে কম কিছু বাংলাদেশের জনগণ প্রাপ্য নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতির জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক