‘ডেভিল হান্ট’ কি ছিনতাইকারীদের ‘হান্ট’ করবে
Published: 10th, February 2025 GMT
চল্লিশ বছর আগে, ১৯৮৫ সালে কাজী আনোয়ার হোসেন সৃষ্ট কালজয়ী চরিত্র মাসুদ রানা সিরিজের একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘চারিদিকে শত্রু’ নামে। চার দশক আগের এই বইয়ের নামটি কীভাবে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সেই কথায় আসছি, তবে তার আগে সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারের শিরোনামটাও তুলে ধরছি, ‘আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী’।
নাহিদ ইসলাম সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাঁর চিন্তার জায়গাটি নিশ্চয়ই ভিন্ন, পরিসর অনেক ব্যাপক। তবে আমাদের মতো আমজনতার উদ্বেগটাও নীতিনির্ধারকেরা একটু ভেবে দেখতে পারেন, কারণ এই বিষয়টিও একেবারে ফেলনা নয়। এখন ঘরে-বাইরে চারদিকে এমন এক অস্বস্তিকর অনুভব, যেন চারদিকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করছি। এবং বলাই বাহুল্য, এই লড়াইয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শত্রুর জয় নিশ্চিত হচ্ছে।
ফেসবুকে ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ নামে একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে নিয়মিত ট্রাফিক পরিস্থিতির আপডেট পাই। কোন রাস্তা কখন বন্ধ, কোথায় আকস্মিক আন্দোলনের ভোগান্তি চলছে, কোথায় দীর্ঘ যানজট ইত্যাদি। তবে কয়েক মাস ধরে নগরীর ট্রাফিক পরিস্থিতি ছাপিয়ে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে রাজপথের নিরাপত্তাহীনতা, অরাজকতা আর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
কয়েক দিন আগে এই প্রথম আলোতেই আমরা দেখেছি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ভয়াবহ চিত্র। পাঠকদের অবগতির জন্য ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ গ্রুপে দেওয়া ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় কিছু ঘটনা তুলে ধরছি:
ঘটনা এক: অঞ্জন আহমেদ সানভী ৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া একটি পোস্টে বলেছেন, ‘মাওয়া থেকে আসার পথে পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে নেমে মোচড়েই মোবাইল ছিনতাই করা হচ্ছে বাস থেকে টান দিয়ে! আমাকে ভিডিও করতে দেখে মোবাইল টান দিয়ে ভেগেছে অন্যদিক দিয়ে! সবাই একটু সাবধান থাকবেন প্লিজ! আর এদের কাছে চাপাতি থাকে তাই একা কেউ যেয়েন না সামনে দয়া করে!’
এই পোস্টের সঙ্গে ছিনতাইকারীর ছবিও যুক্ত করেছেন তিনি।
ঘটনা দুই: জুনায়েদ আহমেদ নামের আরেকজন ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘খুব বাজে একটা অবস্থা এয়ারপোর্ট থেকে কাওলা পর্যন্ত! আমি জ্যামের কথা বলছি না! আমি বলছি ছিনতাইকারীর কথা। আজকে সময় ৭:২০ (রাত) এয়ারপোর্ট ফ্লাইওভার থেকে নামতেই দেখলাম ৬ জন একসাথে মাঝখান দিয়ে হাঁটতেসে, অবাক হইয়া দেখলাম কী করে। হঠাৎ ৬ জনের একজন একটা গাড়িকে টার্গেট করে বাকিদের ডাক দিল যাতে অ্যাটাক করে। এখন বলতে পারেন সবাই আমি কেন আটকাইলাম না! কারণ, আমি একা ছিলাম কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি, ঠিক ১০০ গজ সামনেই ২ জন পুলিশ দাঁড়ানো ছিল রেকার নিয়ে, আমি সামনে গেলাম পুলিশকে বললাম কাহিনি, বলতেসে উনার সময় নাই। মেজাজ খারাপ হয়ে গেসিলো পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়ায় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলাম বাট লাভ হলো না, ওরা চুপ ছিল! আমিও বুঝলাম আসলে ওদেরকে বলে লাভ নাই। মনে কষ্ট নিয়া চলে আসছি বাসায়। আপনারা চাইলে আমাকে কমেন্টে গালাগালি করতে পারেন ফর নট স্টপিং দ্য থাগস (দুষ্কৃতকারীদের না থামানোর জন্য)! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করেন আমিন!’
ঘটনা তিন: ৫ ফেব্রুয়ারিতেই দেওয়া আরেকটি পোস্টে শাহারিয়ার পিয়াস বলছেন, ‘চৌরাস্তা, গাজীপুর রাত ৩.
পোস্টের সঙ্গে তিনি গাড়ির সামনে লাগানো ক্যামেরায় রেকর্ড করা ভিডিও যুক্ত করেছেন, যেখানে যেখা যাচ্ছে একটি অটোরিকশার দুই পাশ থেকে দুজন দ্রুত সরে যাচ্ছেন। ভিডিওতে তাদের হাতে থাকা লম্বা ধারালো অস্ত্রটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ঘটনা চার: একই দিনে শাহানা পারভীন শিখা একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, ‘রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী কুতুবখালী দাগু খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে রাস্তায় রাতের চিত্র।’
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে চারজন যুবক একজন লোককে জবরদস্তি করে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। এ সময় ছিনতাইকারীদের একজনকে চাপাতি হাতে লোকটিতে একটি কোপ দিতেও দেখা যায়।
ঘটনা পাঁচ: মো: রউফুল ইসলাম ৪ ফেব্রুয়ারির একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘সিলেট থেকে লাশ নিয়ে যাওয়ার পথে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে ডাকাতি।’
পোস্টের সঙ্গে দেওয়া ভিডিওতে ডাকাতি–পরবর্তী অবস্থায় বিপর্যস্ত মানুষগুলোকে দেখা যাচ্ছে।
ফেসবুকে এ রকম আরও অনেক গ্রুপের মধ্যে মাত্র একটি গ্রুপের তিন দিনের কয়েকটি পোস্টের চিত্র এটি। পরিসংখ্যানবিদ না হয়েও ধারণা করা যায়, সামগ্রিক চিত্রটি আসলে কতটা ভয়াবহ। একটু খুঁজলেই এমন আরও অনেক উদাহরণ মিলবে। সেই তালিকা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক।
এই খণ্ডচিত্র থেকেই আমাদের সড়ক-মহাসড়কের বর্তমান অবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের বোঝা না–বোঝায় কিছুই যায়–আসে না। কোনো কালেই, কোনো সরকারের আমলেই তা যায়–আসেনি। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, কতটা আমলে নিচ্ছেন, জননিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় কত নম্বরে…এমন অনেক বিষয়ের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর করদাতাদের ভাগ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার কথার জবাবে বলেছেন, সরকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর ডেটা (উপাত্ত) সংগ্রহ করছে। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা শফিকুল আলমের বক্তব্যে আস্থা রাখতে চাই। আমরা জানতে চাই, সেই উপাত্ত কী বলছে? তার ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? আমাদের জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, গত শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। মূলত গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পরদিনের পত্রিকায় দেখলাম গাজীপুরে ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে ৪০ জনকে (রোববার পর্যন্ত সারাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৩০৮ জন) আটক করা হয়েছে। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেছেন আটক ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোক। আমরা চাই ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজনের পাশাপাশি ছিনতাইকারী-সন্ত্রাসীদেরও ধরা হোক, যারা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে দুঃসহ করে তুলছে।
আগেও আমরা দেখেছি, ছিনতাই-ডাকাতি বা সন্ত্রাসী হামলার মতো বিষয়গুলোকে আমলে না নিয়ে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিতে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, মানুষের মনের কষ্ট, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাগুলো জানার-বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের কথা শুনুন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিষয় আপনারা আমলে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। সেটা পুরস্কার প্রদানই হোক, বা কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর মতো সিদ্ধান্তই হোক। এখন নিরাপত্তাহীন মানুষের শঙ্কার কথাগুলো শুনুন। সরাসরি সম্ভব না হলে অন্তত ফেসবুকে চোখ রাখুন। এটুকুই অনুরোধ।
গোলাম কিবরিয়া গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র আম দ র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
পরপর তিন মেয়ের পর এক ছেলে, তাদের পর এলো জমজ
ছেলের আশায় পরপর তিনটি মেয়ে হয়েছে তানিয়া বেগমের। পরবর্তীতে ছেলেও হয়েছে। সেই ছেলের বয়স এখন তিন। ইচ্ছাপূরণের পর দরিদ্র স্বামী ইস্রাফিল মোল্লা বা তানিয়া– কারোই আর সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তবে বিধির লীলা বোঝা বড়ই ভার। তানিয়া নতুন করে যখন সন্তানসম্ভবা হন, তখন ভরসা রাখেন আল্লাহর ওপর। নড়াইলের এই গৃহবধূ সোমবার সকালে জন্ম দিয়েছেন জমজ ছেলের।
নড়াইল শহরের বেসরকারি মডার্ন সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড চিকিৎসা কেন্দ্রে সোমবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুই ছেলের জন্ম দেন তানিয়া। তাঁর স্বামী ইস্রাফিল মোল্লা সদরের মাইজপাড়া ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় ভ্যানচালক তিনি। ছেলেদের জন্মের পর মা তানিয়া তাদের নাম রেখেছেন– মোহাম্মদ ও আহম্মদ।
সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূকে নিয়মিত নড়াইল সদর হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন বলে জানান শিশুদের দাদি রেবেকা খাতুন। তিনি বলেন, তারা দরিদ্র মানুষ। ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিকভাবেই প্রসব করানোর। কিন্তু সোমবার সকাল ৬টার দিকে হঠাৎ করেই পুত্রবধূর ব্যথা ওঠে। তখন বাড়ি থেকে আসার সুবিধার কারণে ওই ক্লিনিকে ভর্তি করেন তানিয়াকে।
রেবেকার ভাষ্য, ‘পুতা (সন্তানের ছেলে) জন্ম হওয়ার পর প্রথমজনকে আমি কোলে নিই, আরেকজনকে কোলে নেয় বৌমার মা (শিশুদের নানি) তসলিমা বেগম।’ শিশুদের জন্মের সময় নববর্ষের দিনে পড়েছে কি-না এ বিষয়ে কেউই জানতেন না। তাদের কোলে নেওয়ার পর দাদি-নানিই তাদের কানে আজান দেন। তাদের বাবা বাড়িতে গিয়ে ওজু-গোসল সেরে আজান দিয়েছেন।
প্রতিটি শিশুর ওজনই দুই কেজি ৭০০ গ্রাম করে হয়েছে জানিয়ে রেবেকা খাতুন বলেন, ‘বাচ্চারা এখনো ঠিকমতো মায়ের দুধ পাচ্ছে না। দুধ পাবার চেষ্টা করতিছি।’
১৮ বছর আগে নড়াইল সদরের মাইজপাড়া ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের ইস্রাফিল মোল্যার সঙ্গে বিয়ে হয় সদরের বাঁশগ্রামের কিশোরী তানিয়া বেগমের। তখন তানিয়ার বয়স ছিল ১৩ বছর। প্রথম সন্তান মারিয়ার জন্ম হয় এর তিন বছর পর। সেই মেয়েটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়তো। ঈদুল ফিতরের তিনদিন পর বিয়ে হয়েছে এই কিশোরীর। তার স্বামীই জমজ শ্যালকদের জন্য সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি কিনে দিয়েছে বলে জানান ইস্রাফিল মোল্লা। তিনি বলেন, তাঁর মেঝ মেয়ে মরিয়ম (১০) ও ছোট মেয়ে হাবিবা (৮) বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ছেলে আব্দুর রহমানের বয়স ৩ বছর। ইস্রাফিলের ভাষ্য, ‘৬ সন্তান হলেও আমরা খুশি, আনন্দিত। এ সন্তান আল্লাহর দান।’
মডার্ন সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড চিকিৎসা কেন্দ্রে তানিয়ার অস্ত্রোপচারের নেতৃত্বে ছিলেন নড়াইল সদর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুব্রত কুমার। তিনি বলেন, ‘প্রসূতিকে সোমবার সকালে জরুরি অবস্থায় ভর্তি করা হয়। সবাই তাদের বিষয়ে আন্তরিক ছিলাম। নবজাতক ও তাদের মা সুস্থ আছে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর রাখছি।’