গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পিছটান দিচ্ছে
Published: 10th, February 2025 GMT
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩ সালে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক হয়ে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিলে যশোর অঞ্চলের যেসব শিক্ষার্থী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, তাঁদের আর কষ্ট করে সিলেটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতে হবে না। আবার সিলেট অঞ্চলের যাঁরা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চান, তাঁদেরও কষ্ট করে যশোরে যেতে হবে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যৌথভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের এটিই ছিল প্রথম উদ্যোগ। কিন্তু সে সময় উদ্যোগটি সফল হয়নি। কারণ, যৌথভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের বিরুদ্ধে ওই সময় সিলেটে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, এভাবে ভর্তি পরীক্ষা হলে সিলেট অঞ্চলের খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন। বাইরের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ার বেশি সুযোগ পাবেন। তাতে সিলেটের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অনেকেই সে সময় বুঝে না–বুঝে সিলেটের এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
এর প্রায় আট বছর পর ব্যর্থ সেই উদ্যোগ জাতীয়ভাবে সফলতার মুখ দেখেছিল। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে হয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে, যেটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত। গত বছর গুচ্ছ পরীক্ষায় অংশ নেয় ২৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট ছিল বরাবরই গুচ্ছের বাইরে।
এ ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছের বাইরে চলে গেছে, পরিস্থিতি ভালো হলে ভবিষ্যতে তাদের আবার গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগও রয়েছে। একই সঙ্গে গুচ্ছ পরীক্ষা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদারকি সেখানে বাড়াতে হবে।গুচ্ছের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এর ইতিবাচক দিক নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের সময়, যাতায়াতের ভোগান্তি লাঘব এবং আর্থিক বিবেচনায় গুচ্ছ পরীক্ষার বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর বাইরে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বারবার নির্দেশনা ছিল গুচ্ছ থেকে কেউ যেন বের না হয় এবং স্বতন্ত্র পরীক্ষা না নেয়। এরই মধ্যে দৈনিক প্রথম আলো গত ২১ ডিসেম্বর ‘গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তিতে আবারও বাড়বে ভোগান্তি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে গুচ্ছ পদ্ধতির ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও মূলত আর্থিকভাবে বিপুল লাভের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম বিক্রি বাবদ বিপুল আয়ের বড় অঙ্কই শিক্ষকসহ ভর্তির কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পেয়ে থাকেন।
ওই প্রতিবেদনে বিশেষ যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে আর্থিক বিষয়ের দিকটি বেশি বিবেচনা করছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী কারণে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয় নিয়ে ভালো কোনো প্রতিবেদন কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ প্রবর্তন হওয়ার ফলে এর কী রকম প্রভাব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে, সেই বিষয়টি নিয়েও কোনো প্রতিবেদন এর আগে দৃষ্টিগোচর হয়নি। সেই বিষয় এ লেখায় তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তিকে কেন তারা ‘তুচ্ছ’ মনে করছে২২ ঘণ্টা আগেগুচ্ছ পদ্ধতিতে সারা বছর ধরে ভর্তি কার্যক্রম চলে। মাইগ্রেশন বা বিভাগ পরিবর্তনও চলে একই তালে। গত বছরের ভর্তি কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যে নতুন বছরের ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী, ৩ ক্রেডিটের ১টি কোর্সে ১ সেমিস্টারে (বছরে ২টি সেমিস্টার) ৩৬টি ক্লাস হওয়ার কথা। সেমিস্টারের একদম শেষের দিকে কয়েকটি ক্লাস বাকি থাকতে চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী একটি বিভাগের ক্লাসে যোগ দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে বলা হলো তাঁদের ব্যাপারে নমনীয় হতে হবে। অর্থাৎ ক্লাস ও টার্ম টেস্ট না দিয়েই ওই শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র দিতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দশমবার মাইগ্রেশনের আহ্বান জানিয়েও ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আসন খালি রয়েছে। স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন খালি থাকার ঘটনা একেবারই কম। কোনো কোনো শিক্ষক এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিও দিয়েছেন। গুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের মতামত পাওয়া গেছে।
গুচ্ছ পরীক্ষা একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় অনেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিযোগ রয়েছে, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ‘ইচ্ছাপূর্বক’ অবহেলা করে। দেখা যাচ্ছে, ক্লাসের একটি বেঞ্চে সাত থেকে আটজন গাদাগাদি করে পরীক্ষা দিচ্ছেন। অথচ সেই বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুজন স্বাভাবিকভাবে বসে পরীক্ষা দিতে পারেন। দেখাদেখি করে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছেন।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বেশি সুযোগ দেওয়ার জন্য দেখাদেখি করে পরীক্ষা দেওয়া কিংবা নকলের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে তুলনামূলক কম মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন এবং আঞ্চলিক শিক্ষার্থীরা বেশি ভর্তি হচ্ছেন। অনেক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, গুচ্ছের আগে যে ধরনের শিক্ষার্থী পাওয়া যেত, এখন কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থী পাওয়া যায়।
গুচ্ছ থেকে বের হওয়ার দাবিতে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, গুচ্ছতে দুর্ভোগ বেশি। এখানে ভর্তির খরচও অনেক বেশি। গুচ্ছবহির্ভূত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তির দ্বিগুণের বেশি টাকা খরচ হয় গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। এ ছাড়া গুচ্ছতে বিভাগ পছন্দের মারপ্যাঁচে অনেক শিক্ষার্থী নিজের পছন্দমতো বিভাগ পান না—এটি নিয়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে একধরনের হতাশা।
ভর্তির কার্যক্রমে অংশ নিয়ে পরিশ্রমের তুলনায় খুব বেশি পরিমাণ সম্মানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পান না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে শিক্ষক–কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক লোকবলের প্রয়োজন হয়। টাকার চেয়ে দায়িত্ব পালনই এখানে শিক্ষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষকেরা বেশি সম্মানী পান এবং গুচ্ছতে ভর্তি পরীক্ষায় কম সম্মানী পান—বিষয়টি মোটেই সে রকম নয়।
উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করলে উপলব্ধি করা যায়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সারা বছর ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম চলে, তাহলে সেখানকার অবস্থা কেমন হতে পারে? ৫০ জনের ভর্তির জন্য যে জনবল প্রয়োজন, ৫০০ জনের ভর্তির জন্যও একই জনবলের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ সারা বছরই নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ভর্তি পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। মোটাদাগে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক শৃঙ্খলার ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পড়াশোনার মানও সেখানে অনেকাংশে নিম্নগামী। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে ছাত্র ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে।
অন্যদিকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছভুক্ত না হওয়ায় গুচ্ছ ভর্তি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া গুচ্ছ পরীক্ষা আয়োজনের হিসাবনিকাশও অস্বচ্ছ বলে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়গুলো তদন্তের দাবি রাখে। এরপরও ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পরীক্ষা নিতে রাজি হয়েছে, এটি একটি ইতিবাচক দিক। উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে, বিশেষ করে সারা বছর ভর্তি কার্যক্রম চালু না রেখে, নির্দিষ্ট কয়েক মাস ছাত্র ভর্তি করে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে এ বিষয়ের সমাধান কিছুটা হতে পারে।
এ ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছের বাইরে চলে গেছে, পরিস্থিতি ভালো হলে ভবিষ্যতে তাদের আবার গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগও রয়েছে। একই সঙ্গে গুচ্ছ পরীক্ষা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদারকি সেখানে বাড়াতে হবে।
এতে হয়তো গুচ্ছ পরীক্ষার ভাবমূর্তি–সংকট কিছুটা কাটানো সম্ভব। গুচ্ছ পরীক্ষা আরও কার্যকর হোক, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হোক—সে প্রত্যাশা সবার।
● ড.
মো. সাহাবুল হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ চ ছ পর ক ষ স বতন ত র পর ক ষ র পর ক ষ য় ব ষয়গ ল ব র হয় হওয় র প রথম ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানে ট্রেন অপহরণে জড়িত কারা এই সশস্ত্র যোদ্ধা
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সাম্প্রতিক ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। মঙ্গলবার জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটি কোয়েটা থেকে পেশাওয়ার যাওয়ার পথে বেলুচিস্তানের একটি পাহাড়ি টানেলের কাছে সশস্ত্র বিএলএ যোদ্ধারা ট্রেনটি হাইজ্যাক করে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কয়েক ঘণ্টার সামরিক অভিযানের পর ট্রেনের ৩৪৬ যাত্রীকে উদ্ধার করে এবং ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জেনারেল আহমেদ শরীফ জানায়, এই অভিযানে ২৭ জন সাধারণ নাগরিক, ট্রেনের চালক এবং একজন আধা-সামরিক বাহিনীর সেনা সদস্য নিহত হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএ তাদের হামলার মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে সংগঠনটি ১৫০টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ও চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে। তবে এই ট্রেন হাইজ্যাক ছিল সংগঠনটির অন্যতম বড় ও প্রকাশ্য হামলা।
বিএলএ কী এবং কেন এই হামলা?
বেলুচিস্তান,পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কিন্তু সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ প্রদেশ যা বহু বছর ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রদেশটি খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে কয়লা, সোনা, তামা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। তবুও এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি।
বিএলএ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যা সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। সংগঠনটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০০০-এর দশকে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের দাবি, পাকিস্তান রাষ্ট্র বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে এবং স্থানীয় জনগণকে বঞ্চিত করছে।
বিএলএ-এর মূল দাবি ও লক্ষ্য
বিএলএ বরাবরই বলেছে যে তারা পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। যেখানে অন্যান্য বেলুচ জাতীয়তাবাদী দল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চায় সেখানে বিএলএ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে।
পাকিস্তান সরকারের কাছে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান দাবি করে। তারা চায় পাকিস্তানের অধীন থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করতে।
প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা। সংগঠনটির মতে, বেলুচিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদ যেমন তামা, সোনা, গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বেলুচ জনগণের হাতে থাকা উচিত।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) ও গওয়াদার প্রকল্পের বিরোধিতা করেও তারা কাজ করছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের যৌথ উন্নয়ন প্রকল্প বিএলএ-এর অন্যতম প্রধান শত্রু। তারা মনে করে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে বেলুচিস্তানের সম্পদ লুট করছে।
এবং পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের প্রতিশোধ নিতেও তারা বদ্ধ পরিকর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে, যার ফলে অনেক বেলুচ নাগরিক নিখোঁজ বা নিহত হয়েছে। বিএলএ এই দমননীতির জবাব সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে দিচ্ছে।
কারা দিচ্ছে বিএলএ-এর নেতৃত্ব?
প্রথম দিকে বিএলএ-এর নেতৃত্ব ছিল বেলুচ উপজাতির মাররি গোষ্ঠীর হাতে। তবে বর্তমানে সংগঠনটি শিক্ষিত বেলুচদের নেতৃত্বে চলছে। বিএলএ বর্তমান প্রধান বশির জায়ব বালোচ। যিনি ২০১৮ সালে আসলাম বালোচ নিহত হওয়ার পর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর যার নাম জানা যায় তিনি হলেন হাম্মাল রেহান। তিনি মজিদ ব্রিগেড নামক আত্মঘাতী ইউনিটের প্রধান, যা চীনা নাগরিক ও পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনা করে।
এবং রেহমান গুল যিনি বালোচ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। রেহমান বিদ্রোহীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন এবং তাদের আক্রমণের কৌশলগত দক্ষতা বাড়ান।
বিএলএ-এর অর্থায়নের মূলে কারা?
বিএলএ-এর অর্থায়নের মূল উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। মাদক পাচার ও চোরাচালান, কয়লা খনির থেকে অবৈধ টোল আদায়, বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচ অভিবাসীদের অনুদান, চীনা প্রকল্পের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়।
তবে পাকিস্তান সরকার বারবার অভিযোগ করেছে যে ভারত বিএলএ-কে সমর্থন ও অর্থায়ন করে। যদিও এই দাবির পক্ষে শক্ত কোন প্রমাণ নেই।
কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই বিএলএ?
বিএলএ স্বাভাবিকভাবে তরুণ বেলুচদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তারা উচ্চশিক্ষিত বেলুচদের সংগঠনে যুক্ত করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানি সরকারের অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেলুচ জনগণের প্রতি বঞ্চনামূলক নিপীড়ননীতি এই সংগঠনের প্রতি বেলুচদের সমর্থন বৃদ্ধি করছে। যদিও বেলুচ নিখোঁজ ব্যক্তিদের আন্দোলনের ফলে অনেক তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাচ্ছে। বিএলএ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়ভাবে প্রচার চালায় এবং তাদের হামলার ভিডিও ও বিবৃতি প্রকাশ করে তরুণদের মধ্যে নিজেদের সংগঠনের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
কেমন হতে পারে বিএলএ-এর ভবিষ্যৎ?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএ বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করেই চলেছে বাড়িয়েছে। তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছাড়াও চীনা প্রকল্পগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিএলএ দমনে কঠোর অভিযান চালাচ্ছে, যার ফলে সংগঠনটির অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠছে। তবে, পাকিস্তান সরকারের দমনমূলক নীতি অব্যাহত থাকলে এবং বেলুচিস্তানের জনগণের জন্য প্রকৃত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, বিএলএ-এর মতো সংগঠনের প্রতি সহানুভূতি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিএলএ বর্তমানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। এর আগে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএলএ বিদ্রোহীরা এক বাস থামিয়ে সাতজন পাঞ্জাবি যাত্রীকে হত্যা করে। ২০২৩ সালে সংগঠনের চালানো সমন্বিত হামলায় অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই জাতিগত পাঞ্জাবি ছিলেন। গত নভেম্বরে কোয়েটার প্রধান রেলস্টেশনে এক বোমা হামলার দায়ও বিএলএ স্বীকার করেছিল, যেখানে ১৪ জন সেনাসদস্যসহ মোট ২৬ জন নিহত হন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা এখন আরও সংগঠিত ও দক্ষতার সাথে হামলা চালাচ্ছে এবং চীনা নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোর অভিযানের মাধ্যমে সংগঠনটিকে নির্মূল করতে চাইছে। সেনাবাহিনীর দাবি তারা বিএলএ-এর শক্তি দুর্বল করতে সক্ষম হচ্ছে।
তবে যদি পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা এবং বেলুচ জনগণের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে বিএলএ-এর মতো সংগঠন আরও শক্তিশালী হতে পারে।