গ্রেপ্তার সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম দুই মাস আগে শ্রীপুরে ভাড়া বাড়িতে ওঠেন
Published: 10th, February 2025 GMT
গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের মাটির মসজিদ এলাকার একটি বাড়ি থেকে গতকাল রোববার রাতে সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) চয়ন ইসলামকে (৬১) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এর আগে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা বাড়িটি ঘিরে রাখেন। সংগঠনটির কর্মীরা জানান, পাঁচতলা ওই ভবনের চতুর্থ তলায় দুই মাস ধরে ছিলেন চয়ন ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী।
চয়ন ইসলাম সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে যান। নভেম্বরে চাঁদাবাজির অভিযোগে আদালতে চয়ন ইসলামসহ পাঁচজনের নামে মামলা হয়। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলি করে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
উপজেলার ইউনিয়নের মাটির মসজিদ এলাকার খাইরুল ইসলামের বাড়ি থেকে চয়ন ইসলামসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যজনের নাম জাহাঙ্গীর আলম (৫০)। তাঁর কাছ থেকে ইয়াবা বড়ি ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। জাহাঙ্গীর শ্রীপুরের টেংরা পশ্চিমপাড়া এলাকার হোসেন আলীর ছেলে। তিনি শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
সাবেক সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুর জেলার আহ্বায়ক সদস্য আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বিশ্বস্ত সূত্র গতকাল এ বিষয়ে আমাদের তথ্য দেয়। দ্রুত খোঁজখবর করে ওই বাড়িতে সাবেক এমপির থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হই। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীপুর থানায় আমরা খবর দিই। পুলিশ রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওই বাড়িতে আসে। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আসেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ এসে বাড়ি ঘেরাও করেন।’
সেখান থেকে দিবাগত রাত ১২টার দিকে চয়ন ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আশরাফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা পুলিশের সঙ্গে বাড়ির মূল ফটকে প্রবেশ করেন। চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে বেশ কিছুক্ষণ দরজা নক করি। এক পর্যায়ে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেন চয়ন ইসলামের স্ত্রী পরিচয়ে এক নারী। দরজা খুলতেই সেখানে চয়ন ইসলামকে দেখা যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজের পরিচয় দেন।’
শ্রীপুর পৌর ছাত্রদলের আহ্বায়ক মামুন আকন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা খোঁজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি পুলিশ ও স্থানীয় ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের জানান। সবার উপস্থিতিতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
আরও পড়ুনগাজীপুরের শ্রীপুর থেকে আটক সিরাজগঞ্জ -৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য চয়ন ইসলাম১৫ ঘণ্টা আগেনাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, চয়ন ইসলামের ছেলে গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। একই প্রতিষ্ঠানে পড়েন ওই বাড়ির মালিক ও একসময় শ্রমিক লীগের রাজনীতি করা খাইরুল ইসলামের ছেলে। খাইরুল ও জাহাঙ্গীর পরস্পরের পরিচিত। সেই সুবাদে দুই মাস আগে ওই বাড়িতে ওঠেন চয়ন ইসলাম, সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন।
গাজীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়াকৈর সার্কেল) আফজাল হোসেন খান বলেন, ‘চয়ন ইসলামের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় দুটি মামলা আছে। আমরা তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করেছি। তাঁকে শাহজাদপুর থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চয়ন ইসল ম র গ র প ত র কর ল ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
বিজেপির হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুস্তান নীতির ‘বিপদ’
তৃতীয় দফার শাসনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে দুটি সমস্যা। একটি তাঁর সরকারের তৈরি ত্রিভাষা নীতি, যার মধ্য দিয়ে তিনি তামিলনাড়ুসহ অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয় হিন্দি ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে চান। অপরটি সংসদীয় কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাস ও লোকসভার বহর বাড়ানো।
দুটি সমস্যাই প্রাচীন। বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশজুড়ে ত্রিভাষা নীতি আজও রূপায়িত হয়নি। হিন্দিকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়নি, ‘রাষ্ট্রভাষার’ মর্যাদাও পায়নি, সরকারি বা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তা–ও একা নয়, ইংরেজি ‘দোসর’। অন্য সমস্যাটি, অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের আইনসভার বহর বাড়ানোর বিষয়টি, অর্ধশতাব্দী ধরে ধামাচাপা দেওয়া রয়েছে।
আগামী বছর সরকারকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রবল গোলমাল তা নিয়েও। তামিলনাড়ু দাবি জানিয়েছে, আরও ৩০ বছর সংসদের বহর অপরিবর্তিত থাকুক। এই দাবিতে তারা দাক্ষিণাত্যকে জোটবদ্ধ করতে চাইছে। সমর্থন পাওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার।
বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টায় মোগলদের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকেও তেমনই অলঙ্ঘনীয় বাধার মোকাবিলা করতে হবে যদি তিনি জবরদস্তি এই দুই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন। প্রতিরোধের জন্য দাক্ষিণাত্য কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ত্রিভাষা নীতি, হিন্দির আগ্রাসন ও দাক্ষিণাত্যহিন্দি ভাষাকে ভারতে সর্বজনীন করে তোলার প্রচেষ্টা বহুকালের। স্বাধীনতার আগে থেকেই সেই প্রচেষ্টা নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক হয়েছে। অহিন্দিভাষী রাজ্য আপত্তি জানিয়েছে। প্রতিবাদী হয়েছে দক্ষিণের রাজ্যগুলো। সবচেয়ে বেশি সক্রিয় প্রতিরোধে শামিল হয়েছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি।
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সরকারি স্কুলে হিন্দি ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল তীব্র আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইরোড ভেঙ্কটাপ্পা রামাস্বামী ‘পেরিয়ার’। তিনি মনে করতেন, গান্ধী, নেহরু ও কংগ্রেসের হিন্দিপ্রেম তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে। দক্ষিণ হয়ে যাবে উত্তরের দাস।
পেরিয়ারের সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল দ্রাবিড় জাত্যভিমানের—যা আজও প্রবল। তিন বছর পর ১৯৪০ সালে শান্তি ফিরেছিল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের সময় হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা যায় কি না, সেই বিতর্ক নতুন করে শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, হিন্দি হবে সরকারি ভাষা। কিন্তু হিন্দির পাশাপাশি সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হবে ইংরেজিও। তার মেয়াদ থাকবে পরবর্তী ১৫ বছর—১৯৬৫ সাল পর্যন্ত।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মাদ্রাজে নতুনভাবে শুরু হয় তীব্র হিন্দিবিরোধী আন্দোলন। শঙ্কা ছিল, মেয়াদ শেষে হিন্দিই হবে একমাত্র সরকারি ভাষা। হিন্দি আগ্রাসন রুখতে ঘটে যায় প্রভূত রক্তপাত ও প্রাণহানি।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী জানিয়ে দেন, অহিন্দিভাষী রাজ্য যত দিন চাইবে, তত দিন পর্যন্ত হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিও থাকবে সরকারি বা দাপ্তরিক ভাষা। সেই ঘোষণায় শান্তি ফিরেছিল।
সংবিধানপ্রণেতারা শিক্ষাকে রেখেছিলেন রাজ্যতালিকায়। ১৯৭৫ সালে তা নিয়ে আসা হয় যুগ্ম তালিকায়। দেশ যত এগোতে থাকে, ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও তত অনুভূত হয়।
সরকারি স্কুলে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান হলেও বেসরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষার চল বাড়ে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আকর্ষণও বাড়তে থাকে সত্তরের দশক থেকে।
নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণ সেই প্রবণতায় গতি আনে। রাজ্যে রাজ্যে ঢল নামে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের। মাতৃভাষার পাশাপাশি হু হু করে বেড়ে যায় ইংরেজি শিক্ষার কদর।
ভারতে ত্রিভাষা নীতি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। তাতে হিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দি ও ইংরেজির সঙ্গে অন্য কোনো ভারতীয় ভাষা শেখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। অহিন্দিভাষী রাজ্যে আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি চিহ্নিত হয় তৃতীয় ভাষা হিসেবে। নীতি গৃহীত হলেও তার বাস্তবায়ন ছিল কঠিন। বিতর্কও দেখা দেয় রাজ্যে রাজ্যে।
কার্যত দেখা যায়, নীতি মানার চেষ্টা শুধু সরকারি ও সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতেই। বেসরকারি ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল চলতে থাকে নিজস্ব সুবিধামতো। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোয় স্থানীয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজিই প্রাধান্য পেতে থাকে। হিন্দি থাকে প্রায় অচ্ছুত। এতটাই যে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে নবোদয় বিদ্যালয় খুলতেও তৎকালীন মাদ্রাজ (অধুনা তামিলনাড়ু) সরকার অস্বীকার করেছিল।
নতুন শিক্ষানীতি ও শিক্ষামন্ত্রীর হুমকিঅপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে বিজেপি বরাবর অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নোট বাতিলের মতো ‘হারাকিরি’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন করেছিলেন, সেই রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিত। সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে মধ্যরাত্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কেনই–বা তিনি তড়িঘড়ি জিএসটি রূপায়ণ করেছিলেন, তা–ও অজানা। এই দুই সিদ্ধান্তে কার কতটা লাভ হয়েছে, সেই অনুসন্ধান আজও অব্যাহত।
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন (সিএএ) কিংবা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) দেশের কোন উপকারে এসেছে বা আসবে, তা কেউ জানে না। এসব সিদ্ধান্ত মানুষকে ভীত করে তুলেছে। অশান্তি সৃষ্টি করেছে রাজ্যে রাজ্যে। সন্দেহ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। একশ্রেণির নাগরিকদের মনে ক্রোধের সঞ্চার করেছে। এই অর্থহীন মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের সাম্প্রতিক মন্তব্যে, যা নতুন করে উসকে দিয়েছে তামিল জাত্যভিমান।
মোদি সরকার ২০২০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে। সেই নীতিতে দেশের সব রাজ্যের সরকারি স্কুলে ত্রিভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের বারানসিতে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তামিলনাড়ুকে দেশের সংবিধান মানতে হবে। রাজ্যে ত্রিভাষা শিক্ষা চালু করতেই হবে। না করলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সমগ্র শিক্ষা প্রকল্পের’ প্রাপ্য টাকা তাদের দেওয়া হবে না।
ওই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ রাজ্যের। তামিলনাড়ু সরকারের অভিযোগ, সেই বরাদ্দের প্রাপ্য ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না।
ধর্মেন্দ্র প্রধানের মন্তব্যের ভিডিও ট্যাগ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন অভিযোগ করেন, ‘হিন্দির প্রসারে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী তামিলনাড়ুকে ব্ল্যাকমেল করছেন। কিন্তু হুমকির কাছে তামিলনাড়ু মাথা নোয়াবে না।’
শুরু হয়েছে নতুন ভাষাযুদ্ধ। তামিল অস্মিতা রক্ষায় বিজেপির নেতৃত্ব ছেড়েছেন রঞ্জনা নাচিয়ার। ভাষাযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণের অন্য রাজ্যেও।
কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায়ও দাবি উঠেছে ত্রিভাষা নয়, দ্বিভাষা শিক্ষার। স্ট্যালিন তুলে ধরেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উদাহরণ। রাশিয়ার ভাষা আগ্রাসন কীভাবে সোভিয়েতের পতন ঘটিয়েছে, সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছেন বিজেপিকে। হুমকিটা প্রচ্ছন্ন, কিন্তু স্পষ্ট।
বিজেপি ও তার হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান নীতিমহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেসও হিন্দির প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু অহিন্দিভাষীদের স্পর্শকাতরতা উপেক্ষা করেননি। চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি থেকে নানা সময় পিছিয়ে এসেছেন। ভাষার বৈচিত্র্য ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ও সংঘ পরিবারের হিন্দি আধিপত্যবাদের কাছে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর স্পর্শকাতরতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই সন্দেহ জাগছে। নতুন শিক্ষানীতির ত্রিভাষা চরিত্র ও শিক্ষামন্ত্রীর হুমকি তারই প্রমাণ।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) ও জনসংঘের কাছে শুরু থেকেই হিন্দুস্তান, হিন্দু ও হিন্দি ছিল সমার্থক। যে হিন্দু সেই হিন্দুস্তানি এবং সে হিন্দিভাষী—এটাই ছিল তাদের পরিচয়। ক্রমেই ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির উত্থান তাদের বেপরোয়া করে তোলে। ক্ষমতায় এসেই সরকারি নির্দেশে ফরমান জারি করা হয়, সব কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং করপোরেশনের কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হয় হিন্দি, নয়তো হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিতে ব্যবহার করতে হবে।
তামিলনাড়ুসহ বহু অহিন্দিভাষী রাজ্য তখনো বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা কেন্দ্রকে হুঁশিয়ার করে জানিয়েছিলেন, রাজ্যে রাজ্যে আগুন জ্বললে তার দায় বিজেপিকেই নিতে হবে। সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিল কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী দলও। বলেছিল, ওই নির্দেশ অপ্রয়োজনীয়ই শুধু নয়, তা সরকারি ভাষা আইনেরও পরিপন্থী।
বিজেপি অবশ্য চেষ্টায় রাশ টানেনি। গত ১০ বছরে হিন্দির ব্যবহার ও বিকাশের জন্য নানাভাবে সচেষ্ট। ১০ বছরে যত আইন তারা পাস করেছে, প্রতিটির পরিচিতি দেওয়া হয়েছে হিন্দিতে।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের নতুন নাম ‘ভারতীয় ন্যায়সংহিতা’। দেশের নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তারা ‘ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে ‘ভারত’কে প্রাধান্য দিতে চেয়েছে। নতুন সংসদ ভবনের অভ্যন্তরের যাবতীয় নির্দেশিকা হিন্দি ও সংস্কৃতভিত্তিক। বোঝা যায়, ভাষা হিসেবে হিন্দি ও সংস্কৃতের প্রভুত্ব স্বীকারে দেশবাসীকে তারা বাধ্য করতে চায়।
হিন্দিভাষী রাজ্য ও ত্রিভাষা নীতির উপেক্ষাঅথচ বাস্তবে ত্রিভাষা নীতি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয়। কিংবা বলা যায়, হিন্দিভাষী রাজ্যে ত্রিভাষা নীতি রূপায়ণে কেন্দ্র যতটা আগ্রহী, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ তাদের অহিন্দিভাষী রাজ্য নিয়ে। বিশেষ করে তামিলনাড়ু, যেখানে সক্রিয় প্রতিরোধে রাজ্যবাসী সদা প্রস্তুত।
উদাহরণ হিসেবে রয়েছে উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়। এসব রাজ্যের সরকারি স্কুলে ত্রিভাষা তো দূরের কথা, দুটি ভাষাও সেভাবে পড়ানো হয় না। ভাষা একটাই—হিন্দি।
এসব রাজ্যের সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষাও শেখে না। কারণ, শিক্ষকের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ইংরেজি শিক্ষা যতটুকু তা বেসরকারি বিদ্যালয়ে।
পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো রাজ্যে হিন্দি আবার তৃতীয় ভাষা। এতে পড়ুয়াদের সুবিধা অনেক। খাটনি কম, নম্বর মেলে বেশি।
কংগ্রেসের তামিল নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম এ কারণেই পরামর্শ দিয়েছেন, অযথা হিন্দির প্রসারে ত্রিভাষা নীতি রূপায়ণে একবগ্গা না হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বরং দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখানোর ওপর জোর দিক। তাতে আখেরে দেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মই উপকৃত হবে।
কারও জাত্যভিমানে আঘাত না দিয়ে আসমুদ্রহিমাচলে হিন্দির বাধাহীন প্রসার ঘটিয়ে চলেছে হিন্দি সিনেমা ও তার গান। দেশব্যাপী হিন্দির বিকাশে আজও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অবিতর্কিতও।
এই সার সত্যটুকু না বুঝে অনর্থক জবরদস্তি তামিলনাড়ুতে বিজেপির দরজা আরও বহুদিনের জন্য বন্ধ করে দেবে। তামিলনাড়ুর শুরু করা ভাষাযুদ্ধের ‘দোসর’ হয়েছে সংসদের আসন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত, যা রুখতে কোমর বাঁধতে শুরু করেছে দাক্ষিণাত্য। জোড়া ‘টাইম বোমা’র টিকটিক বিপদঘণ্টি নরেন্দ্র মোদি কি শুনতে পাচ্ছেন?
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি