অবাক কুতুহলে ঢাকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখল উপকূলের মেয়েশিক্ষার্থীরা
Published: 10th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের উপকূলের পিছিয়ে পড়া মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ঢাকায় আয়োজিত হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্থান পরিদর্শনমূলক আয়োজন ‘অবাক কুতুহলে’। স্টেম অ্যান্ড আইসিটি স্কিলস ফর দ্য গার্লস অব কোস্টাল এরিয়া প্রকল্পের আওতায় গত শুক্র ও শনিবার (৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি) দিনভর ঢাকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীরা।
সফটওয়্যারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্রেইনস্টেশন ২৩ ঘুরে যারপরনাই খুশি খুলনার রূপসা উপজেলার কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মা সাদিয়া ঝিলিক। তার মতে, আজ সে এই অফিস পরিদর্শনে এলেও কোনো একদিন নিশ্চয়ই সে এ রকম প্রতিষ্ঠানের কর্মী হয়ে ঢাকায় ফিরবে। প্রতিষ্ঠানটির নারী কর্মীদের গল্প বেশ অনুপ্রাণিত করে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শহীদ আলী আহম্মদ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়া সুলতানা শাকিলাকে। সে বলে, ‘আমি গ্রামে যেটুকু পড়াশোনা করি, ভাবতাম সেটাই অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের আপুদের গল্প শুনে মনে হয়েছে, আমার এলাকার বাইরেও একটা বিস্তৃত জগৎ রয়েছে, যেখানে প্রবেশ করতে আমাকে আরও অনেক বেশি পরিশ্রম আর সাধনা করতে হবে।’
ঝিলিক ও শাকিলার মতো প্রায় ৩৬ শিক্ষার্থী ৬ ফেব্রুয়ারি বাসযোগে ঢাকা আসে রাজধানী শহর ঢাকা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। তিনটি ভিন্ন এলাকার ছয়টি পৃথক বিদ্যালয় থেকে এলেও পুরো সফর তাদের একক বন্ধনে মিলিয়ে দেয়। তারা নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয় এবং পুরো আয়োজনটি পরস্পরের সহযোগিতায় আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে। ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে তাদের ঢাকা পরিদর্শন শুরু হয়। কলা ভবনের অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের সামনে থেকে কলা ভবন, শহীদ মিনার, টিএসসি, কার্জন হল হয়ে তারা যায় তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে। এরপর বিকেলে যায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান ব্রেইনস্টেশন ২৩–এর কার্যালয়ে। সেখানে নিজেদের কাজ ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নারী কর্মীরা। তাঁদের কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে শিক্ষার্থীরা.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
যন্ত্র যখন বিশ্বস্ত সহকর্মী
শেষবার কবে আপনি আপনার ফোনের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে আবহাওয়ার খবর জানতে চেয়েছিলেন? অথবা টেক্সট বার্তায় কোনো বানান ভুল ঠিক করতে অটোকরেক্টের সাহায্য নিয়েছিলেন, তা কি মনে আছে? সেই মুহূর্তে যন্ত্রটি আর নিছক একটি নিষ্ক্রিয় সরঞ্জাম ছিল না। সেটি যেন এক সহায়ক সহকর্মীর মতোই আপনার ছোট্ট একটি কাজে সাহায্য করেছিল। বিশ্বজুড়ে এবং বাংলাদেশেও এখন এমন ঘটনা ক্রমেই বেশি দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ডিজিটাল যন্ত্র সাধারণ হাতিয়ার থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। অর্থাৎ, মানুষ এখন যন্ত্রকে আর শুধু ব্যবহারই করছে না, বরং তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে বন্ধু ও সহযোগীর মতো।
মানব–ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে যন্ত্র ছিল বাধ্য কর্মচারীর মতো। আমরা বোতাম চাপতাম আর যন্ত্র নির্দিষ্ট একটি কাজ করত। যেমন ক্যালকুলেটর শুধু সংখ্যা গণনা করত, কম্পিউটারও নির্দিষ্টভাবে প্রোগ্রাম করে দেওয়া কাজটাই করত। অন্য যন্ত্রগুলোকেও শুধু কী করতে হবে বললে হতো না; কীভাবে করবে, প্রতিটি ধাপ বলে দিতে হতো। কিন্তু আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতির ফলে যন্ত্রগুলো শেখার ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এর মানে, আগেকার বাধ্য কর্মচারী মতো ধাপে ধাপে নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা না করে যন্ত্র এখন একটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং পারস্পরিক ও পারিপার্শ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা শিখছে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও এআই হাত বাড়িয়ে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিক্ষা সফটওয়্যার (ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম) প্রতিটি শিশুর জন্য উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে শিশুর ব্যক্তিগত সক্ষমতার স্তর অনুযায়ী প্রতিটি বিষয় সাজিয়ে দিতে পারে। এর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক হচ্ছে শিশুটি যত বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা সফটওয়্যারটির ব্যবহার করবে, সফটওয়্যারটিও শিশুটির বিষয়ভিত্তিক সক্ষমতার স্তরগুলো অধিকতর বিশ্লেষণ করে তার জন্য বিশ্বস্ত ও চাহিদা অনুযায়ী উপযোগী হয়ে উঠবে।
যন্ত্রগুলো সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক সুযোগও নিয়ে আসছে। এগুলো একঘেয়ে বা বিপজ্জনক কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে। সেকেন্ডের মধ্যে বিশাল ডেটা সেট বিশ্লেষণ করতে পারে। এমনকি সৃজনশীল ধারণাও দিতে পারে। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং উদ্ভাবনে গতি সঞ্চার হয়।
তবু বিশ্লেষকদের মতে, এআই এখনো কোনো একটি কাজ শতভাগ করার মতো কৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি। সে শুধু আংশিক কাজই করতে পারে। একটি গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রযুক্তি দিয়ে মোট কাজের মাত্র ৫ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব। অধিকাংশ পেশায় এখনো কাজের বড় অংশের জন্য প্রয়োজন হয় মানুষের সরাসরি হস্তক্ষেপ। তবে মানুষের বিকল্প হিসেবে যন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত করা বা যন্ত্রের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরিতে ব্যস্ত প্রযুক্তিবিদেরা।
অবশ্য যন্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতায় উদ্বেগ অনেক। যেমন জবাবদিহির প্রশ্নে যদি কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ভুল করে, তবে দায় কার ওপর পড়বে? এ ধরনের প্রশ্ন এখনো আলোচনা ও বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে। মানব-রোবট সহযোগিতার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম্যাথিয়াস ক্লাম্প উল্লেখ করেছেন, ‘বিপুল হারে চাকরি হারানোর ব্যাপারে অতিরিক্ত ভয় আমাদের দৃষ্টিতে যথার্থ নয়।’ তাঁর বিশ্বাস, এআই চাকরি বিলুপ্ত না করে বরং কাজের প্রকৃতি পরিবর্তন করবে। রুটিন কাজগুলো এআই দিয়ে করানো যাবে। আর মানুষ মনোযোগ দেবে সেই কাজগুলোয়, যেগুলো যন্ত্র ভালো পারে না।
সৃজনী শক্তির কথাই ধরুন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত ভালো কাজই করুক না কেন, মানুষের চেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে পারেনি। আর এটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মানুষের সক্ষমতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্যরেখা টেনে দেয়। এ জন্য এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কিছু চিন্তা করা ও ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়ার জন্য সৃজনশীল কর্মীর সন্ধান করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কাজের একক সমাধান হলেও মানবমস্তিষ্কের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা সংযোজন করতে পারলে তা নিশ্চয়ই চমৎকার হবে। তবে সেটি পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে মানুষের সহকারী হিসেবে কাজ করবে। আবার জটিল চিন্তাশক্তির ক্ষেত্রে তা কেমন হতে পারে, তা ভাবার বিষয়।
চারপাশে তথ্য-উপাত্তের কোনো কমতি নেই। কিন্তু সেগুলো যাচাই-বাছাই করে বিশ্বস্ত উৎস নির্বাচন করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই। সর্বত্র যখন মিথ্যা, প্রতারণা ও গুজবের ছড়াছড়ি, তখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই জটিলভাবে চিন্তা করে সঠিকতা খুঁজে বের করার জন্য এমন দক্ষ কর্মী চায়, যারা তথ্যের গুণগত বিষয় যাচাই করে নির্ভুল উৎস বাছাই করার ক্ষমতা রাখে। জটিল চিন্তার দক্ষতা মানে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পরিবর্তে বিশ্বস্ততাকে বোঝায়। আর এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে এখনো আশা করা যায় না।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করা গেলেও কোন তথ্য দিয়ে কী নির্দেশ করে, তা বিচার করার ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে। তথ্য বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্তের প্রভাব সমাজের প্রেক্ষাপটে সুফল বয়ে আনবে, তা যন্ত্র বা সফটওয়্যার বুঝবে না। ঠিক একইভাবে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নৈতিকতার মানদণ্ডে কতটুকু ইতিবাচক, তা জানার জন্য মানুষের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই।
সিদ্ধান্ত প্রায়ই জটিল হয়ে যায়। তাই নির্দিষ্ট তথ্য দ্বারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ফলাফল বাতলে দিলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন তথ্য যুক্ত করার ফলে পুনঃসিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা আছে কেবল মানুষের। অন্যদিকে মানুষের আবেগ সচেতনতা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশ করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে আলাদা বিশেষত্ব বহন করে। সামাজিক ও মুঠোফোনপ্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণের ফলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়কে ভিন্ন করেছে। যার ফলে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি মানুষের আবেগিক বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি কমিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মানবশক্তি অগ্রাহ্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে—এমনটা ভাবা ভুলই বটে।
আবার দেখুন, মানুষের মধ্যে রাগ, ভয়, ঘৃণা, ভালোবাসার মতো অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু রোবট মানুষের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সৃষ্ট। তারা মানুষের মতো দেখতে ও কথা বললেও এর মধ্যে অনুভূতি বলে কিছু নেই। সে চিন্তা করবে কীভাবে? এটি চলে প্রোগ্রাম দিয়ে। এর ভেতর যতগুলো প্রোগ্রাম সেট করা থাকে, ততটুকুই সে করবে। এর বাইরে কিছুই না। অর্থাৎ একজন মানুষ হয়তো একটি আদর্শ রোবট বানাতে পারে, কিন্তু একটি রোবট একজন আদর্শ মানুষ বানাতে পারবে না।
তবু যন্ত্রের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে কাজে লাগাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়াই হবে ভবিষ্যৎ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাই স্কুলগুলোয় কেবল মৌলিক কম্পিউটার দক্ষতাই নয়, এআইয়ের সঙ্গে কাজ করার কৌশলও রপ্ত করাতে হবে। কারণ, যন্ত্র আর নিছক বুদ্ধিহীন যন্ত্রপাতি নয়। মানুষ ও যন্ত্র পরস্পরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে কাজ করার এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন ‘মানুষ বনাম যন্ত্র’ নয়, বরং ‘মানুষ ও যন্ত্র একসঙ্গে’, একে অপরের বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে পরিগণিত হয়।
ড. মতিন সাদ আবদুল্লাহ অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়