কানাডার নাগরিকত্ব রেখেই ডব্লিউএইচওতে যান সায়মা
Published: 10th, February 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশের পাশাপাশি কানাডারও নাগরিক। যদিও তিনি বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, মনোনয়নকালে তিনি কানাডার নাগরিক ছিলেন।
দ্বৈত নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করে সনদ নেওয়া যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সায়মা ওয়াজেদ সেই সনদ নেননি। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না, তিনি দ্বৈত নাগরিক কি না। যদিও ২০০৮ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কানাডার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রশ্নটি নৈতিকতার। সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে। ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক পদে বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে তাঁর মনোনয়নই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন কানাডার নাগরিকত্ব থাকার বিষয়টিও সামনে এল।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি যদি দ্বৈত নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মনোনয়নে ডব্লিউএইচওতে যান, সেটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
ডব্লিউএইচও নিজেদের কোড অব এথিকসে (নৈতিকতার নীতিমালা) কর্মীদের উদ্দেশে বলেছে, তারা সততাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সায়মা ওয়াজেদকে মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে। খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট–এ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘এ ধরনের স্বজনপ্রীতি ডব্লিউএইচওর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মারাত্মক ক্ষতি করবে।’ যদিও বাংলাদেশ সরকার সেই সমালোচনাকে পাত্তা দেয়নি। সায়মা ওয়াজেদ ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নেপালের প্রার্থী শম্ভু প্রসাদ আচার্যকে হারিয়ে আঞ্চলিক পরিচালক হন। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি দায়িত্ব নেন। সেই থেকে তিনি ওই পদে রয়েছেন।
ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি যদি দ্বৈত নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মনোনয়নে ডব্লিউএইচওতে যান, সেটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামাননেপাল মনোনীত শম্ভু প্রসাদ আচার্য তখন ডব্লিউএইচওর সদর দপ্তরে একজন পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সায়মা ওয়াজেদের চেয়ে অনেক বেশি বলে তখন বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, শম্ভু প্রসাদের ডব্লিউএইচওতে ৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জনস্বাস্থ্যে একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে সায়মা ওয়াজেদের কানাডার নাগরিকত্বের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কানাডা সরকার তাঁকে একটি পাসপোর্ট দেয়। ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৮ সালে। ২০২৩ সালে তাঁর নামে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করা হয়, অর্থাৎ আবার দেওয়া হয়। এই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩৩ সালে। পাতা শেষসহ বিভিন্ন কারণে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করা হতে পারে।
সায়মা ওয়াজেদ ঠিক কোন বছর কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তা জানা যায়নি। তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করেন ২০২১ সালের ৩১ মে। এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০৩১ সালের ৩০ মে। কানাডায় নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ লাগে কি না জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নবায়নের ক্ষেত্রে এই সনদ চাওয়া হয় না।
সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তির জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বড় পদে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। প্রশ্নটি নৈতিকতার।সায়মা ওয়াজেদের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও অন্যান্য বিষয়ে জানতে চেয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয়ে ই-মেইল করা হয়েছিল। তবে গতকাল (৯ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।
দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন, তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তির জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বড় পদে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। প্রশ্নটি নৈতিকতার। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন সরকারপ্রধানের পরিবারের কেউ হন, তখন স্বজনপ্রীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দেখা দেয়।
দুদকের চিঠিদুদক সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের বিষয়ে নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাতে গত ২১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সায়মা ওয়াজেদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে প্রদত্ত তথ্যাদি যথাযথ ছিল না। তিনি কানাডার নাগরিক। সায়মা ওয়াজেদের ভোটাভুটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদল যায়, যা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
দুদক আরও বলছে, সায়মা ওয়াজেদ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এবং তাঁর পরিবারিক রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্পের কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠা আয়তনের প্লটের বরাদ্দ নেন। এ নিয়ে দুদক মামলা করেছে। এ ছাড়া সায়মা ওয়াজেদ ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে নিজে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন রয়েছে। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রভাব বিস্তার করে সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে প্রাপ্য অর্থ করমুক্ত করেন।
সায়মা ওয়াজেদের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে প্রদত্ত তথ্যাদি যথাযথ ছিল না। তিনি কানাডার নাগরিক। সায়মা ওয়াজেদের ভোটাভুটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচওর ৭৬তম সম্মেলনে (২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদল যায়, যা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিঠিটি পেয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যসচিব সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বহির্বিশ্বে এ ধরনের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা থাকে। বিষয়টি দেখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, অবহিতকরণ চিঠিটি তাঁরা পেয়েছেন। কানাডার নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগ তুলে ডব্লিউএইচও থেকে সায়মা ওয়াজেদের অপসারণ চাইলে সফল হওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে যখন দ্বিপক্ষীয় বিষয় আসবে, তখন সায়মা ওয়াজেদ কাকে প্রতিনিধিত্ব করবেন, এটাই প্রশ্ন। তাই দ্বৈত নাগরিক হয়ে রাষ্ট্রীয় মনোনয়নে বৈশ্বিক সংস্থার কোনো পদে যাওয়া অনৈতিক।
ডব্লিউএইচওর এ ধরনের উঁচু পদে নিশ্চয়ই সবাই নৈতিকভাবে প্রশ্নহীন কাউকে দেখতে চাইবে। সংস্থাটি নিজেও নৈতিকতার চর্চা করে। সায়মা ওয়াজেদের উচিত হবে নিজেই দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া।সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবিরনতুন সরকারের অবস্থানজুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার সায়মা ওয়াজেদের মাধ্যমে ডব্লিউএইচওর সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী নয়। গত ৩০ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর সাংবাদিকদের বিষয়টি বলেছিলেন।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউএইচওর এ ধরনের উঁচু পদে নিশ্চয়ই সবাই নৈতিকভাবে প্রশ্নহীন কাউকে দেখতে চাইবে। সংস্থাটি নিজেও নৈতিকতার চর্চা করে। সায়মা ওয়াজেদের উচিত হবে নিজেই দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল র র য গ যত স ল র ৩০ ন ত কত র এ ধরন র র মন ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কক্সবাজারের মেয়েটি
কক্সবাজার ট্যুরে আমাদের খুবই অল্প সময় হাতে নিয়ে কিছু জায়গায় ঘোরা হয়েছিল। এর মধ্যে আমরা একটা জায়গায় শুধু ‘সিএনজি মামার’ অনুরোধে ঘুরতে যাই। সেখানে পৌঁছাই খুব ভোরে। তখনো পার্কের গেট খোলার সময় হয়নি।
আমরা ফিরে যাব ভাবছি, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন ডাক দিলেন। তাকিয়ে দেখি, গেটের পাশেই কোনোমতে কয়েকটা ভাঙাচোরা কাঠ আর বাঁশের খুঁটির ওপর টিকে থাকা একটা চায়ের দোকান। সেখান থেকেই মাথা বের করে একজন ভদ্রমহিলা জানালেন, পার্কের দায়িত্বরত গাইড এখনো আসেননি। তবে আমরা চাইলে তিনি তাঁর মেয়েকে পাঠাবেন আমাদের গাইড করার জন্য।
রিজার্ভ করা সিএনজি মামার চোখের ইশারায় আস্থা পেয়ে আমরা সময়টুকু আর নষ্ট করতে চাইলাম না।
তখনো পার্কের কাউন্টার খোলেনি। সিএনজি মামা স্থানীয় লোক। তাই টাকা রেখে নিরাপত্তাকর্মীরা ঢুকতে দিলেন।
ভেতরে যাওয়ামাত্রই কেউ একজন সালাম দিল আমাদের।
‘আমি রুবা।’
স্বাভাবিক কুশলাদি বিনিময় হলেও আমাদের সবার মধ্যে কেমন এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। ১২–১৩ বছর বয়সী হবে মেয়েটা। পরিবারের সঙ্গে পার্কের ভেতরেই একটি ছোট্ট আশ্রয় ওদের।
মেয়েটির স্মিত হাসি, স্পষ্ট উচ্চারণ, নেই কোনো আঞ্চলিকতা। মুগ্ধ করার মতো। আমাদের সময়স্বল্পতা বুঝেই সে বেশ দ্রুততার সঙ্গে ভেতরের দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে গেল। সেই জায়গাগুলোর চমৎকার সব ইতিহাস শোনাল। আমরা মেয়েটিকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলাম। কেননা তার বাচনভঙ্গি, চলাফেরা প্রথমেই সবার নজর কেড়েছে।
পার্কের ভেতরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমরা অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছিলাম। দূরে পাহাড়ের বুকে ছোট্ট কিছু আবাস চোখে পড়ল। রুবা হাত উঁচিয়ে দেখাল, ওখানেই ওরা একসময় থাকত। পাহাড়ের সবুজের মাঝে, গুটিকয় বাড়ি, তাদের জন্যই গড়ে ওঠা চার–পাঁচটা দোকানের সমন্বয়ে ছোট্ট একটি বাজার। জীবনের কী অদ্ভুত রূপ!
রুবা ওর বড় বোনের কথা বলল। বোনটি লেখাপড়া করত। এ রকমভাবে গাইড করত পর্যটকদের। পরে কিশোরী বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়।
রুবা যখন আমাদের নিয়ে সিঁড়ি কাটা পাহাড়ের ওপরে ওঠে, তখনই পেছন থেকে একটি কুকুর দৌড়ে এসে ওর গায়ে উঠতে থাকে। আমরা রীতিমতো ভয় পেয়ে যাই। ওদের আদর বিনিময় আমাদের নজর কাড়ে। রুবা ওকে কোনোমতে শান্ত করে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘ওর নাম টাইগার।’
এই পার্কের ভেতরে রুবার একমাত্র সাথি এই টাইগার। বাবা–মা দুজনই চায়ের দোকানে ব্যস্ত থাকেন। আর রুবা স্কুলের সময় বাদে বাকি সময়টা টাইগারের সঙ্গেই এই বিশাল এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। কী সুন্দর জীবন! পরিশুদ্ধ বাতাস, সবুজ প্রকৃতি, নেই কোনো কৃত্রিম আবেগ, প্রযুক্তির ছোবল।
যে কিশোর বয়সের সুন্দর সময়গুলো আমাদের শহরের ছেলেমেয়েরা মোবাইলের স্ক্রিনে মাথা গুঁজে হারিয়ে ফেলে। পাঁচজন মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপনের বেলায় ব্যক্তিত্বের চেয়ে পোশাক আর মেকআপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভেতরটা ফাঁপা রয়ে যায়। সম্ভবত এসব কারণেই রুবার সাধারণ জীবনের গল্প আমাদের এতটা বিমোহিত করছিল!
তবে দিনের যে সময়ে পর্যটকদের ভিড় থাকে, রুবার তখন এখানে আসা নিষেধ! নগরজীবন থেকে দূরে থাকলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর ঠিকই রাখেন রুবার মা–বাবা।
এলাকাটি ঘুরে দেখিয়ে রুবা আমাদের চমৎকার একটি স্থাপনার কাছে নিয়ে গেল। কক্সবাজারের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি স্থাপনা, যেখানে কাঁকড়া থেকে শুরু করে ঝিনুক, শামুক, ডাব— সবকিছুর টেরাকোটা করা হয়েছে।
ফেরার সময় রুবার মা–বাবা আমাদের যখন বিদায় দেন, ছোট্ট করে একটা অনুরোধ করলাম, ওকে যেন পড়াশোনার সুযোগ দেন, সে যত দূর পড়তে চায়।
কক্সবাজার থেকে আসার সময় আমরা ব্যাগ ভর্তি করে অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলাম, যেগুলো বাসায় এনে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে, একে–ওকে দিয়ে, খেয়ে শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু রুবার গল্পটা মনের মধ্যে নিয়ে আসায় এটা আর শেষ হয়নি।
ডা. মো. জাহিদুল আলম, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা