অন্তর্বর্তী সরকার গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। এ কারণে সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। জনগণের একটা বড় অংশ সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সরকারের ভূমিকায় মনে হচ্ছে অগ্রাধিকারভিত্তিতে যে কাজগুলো করার কথা, সেসবের দিকে তাদের মনোযোগ নেই।

আমাদের উদ্বেগ এই জায়গায়—কোনো কোনো ঘটনায় মনে হচ্ছে দেশে যেন সরকারের অস্তিত্ব নেই। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের যেমন কর্তৃত্ব আছে, তেমনি দায়িত্বও আছে। কিন্তু সরকারের কর্মকাণ্ডে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব—এই দুটি বিষয়ের মধ্যে অসংগতি রয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা, সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের ভাঙচুর, হামলা ইত্যাদি ব্যাপারেও তা দেখা গেল।

আরও পড়ুনসরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আমরা দেখলাম ঘোষণা দিয়ে ভাঙচুর শুরু হলো। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর হতে থাকল। সরকার প্রথমে কিছুই বলল না। যেভাবে ভাঙচুর হলো, বুলডোজারসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র যেভাবে ব্যবহার করা হলো; তাতে বোঝাই গেল যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে, তাদেরও কোনো ভূমিকা দেখা গেল না। 

যারা ভাঙচুরের আহ্বান জানাল, তাদের অনেকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠনের অংশ। ভাঙচুরের পরে প্রধান উপদেষ্টা বিবৃতিতে ভাঙচুর বন্ধ করতে বলেছেন। পুরো বিষয়টিতেই তিনটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে। একদিকে অমনোযোগ, সেই সঙ্গে আলস্য বা নিষ্ক্রিয়তা, আরেক দিকে রহস্য। রহস্য এই যে আসলে সরকারের সিদ্ধান্তটা কে নিচ্ছেন, কীভাবে নিচ্ছেন এবং কেন নিচ্ছেন?

ফেসবুকে সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত লোকজন নানাভাবে যে ধরনের যুক্তিগুলো দিচ্ছেন, উপদেষ্টারা যে ভাষায় কথা বলছেন, কোনো কোনো সময়ে সেসবের মধ্যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। এর পরিণতি হলো আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়ে করা এই কাজগুলো আসলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন কিংবা প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করছে।

সংস্কারের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব তো সরকারকে পালন করতেই হবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা এখন সরকারের প্রধান কাজ। তারা যত শিগগির একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, আমরা তত দ্রুত অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাব।

এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমাদেরও উদ্বেগটা এখানে, কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে? কখনো বাউলগান, কখনো মাজার, কখনো ভাস্কর্য—এগুলো নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো যারা আক্রমণ করছে, তারা কারা? তাদের ঠেকাতে সরকারের ভূমিকা কী?

গণ–অভ্যুত্থানে ব্যক্ত বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা, বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কি? বরং বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক রাজনীতি, জবরদস্তি করা, মানুষকে ভয় দেখানো, আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সৃজনশীলতার ওপরে আক্রমণ করার যে প্রবণতাগুলো তৈরি হচ্ছে, তা পুরো গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।

গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলো যে শেখ হাসিনা সরকার, তারা যদি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক হতো, তাহলে ভারত এভাবে বাংলাদেশের ওপর তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারত না। একমাত্র স্বৈরশাসনের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। এই স্বৈরশাসন ছিল ভারতের জন্য খুব বড় একটা আশীর্বাদ। বাংলাদেশ থেকে আধিপত্যের যে কাঠামোটা ভারত রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করেছিল, সেই কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ হলো শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেওয়া এবং বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার করতে দেওয়া। বাংলাদেশে যত ধরনের নৈরাজ্য কিংবা সহিংসতা তৈরি হবে, সেগুলো আসলে বিজেপি সরকারের একটা বড় ধরনের হাতিয়ার হবে।

শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের বক্তব্য ও ভূমিকা থেকে মনে হয় যে তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়নি। তারা যদি চক্রান্তের পথে যায়, বাংলাদেশের জনগণকে তা মোকাবিলা করতে হবে। সেই মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বই হচ্ছে প্রধান। কিন্তু সরকারের মনোযোগহীনতার কারণে এই সহিংসতা ও বৈষম্য বৃদ্ধির রাজনীতি যদি বাড়তে থাকে, বিভিন্নভাবে জনগণ যদি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়তে থাকে, তাহলে সেই চক্রান্ত মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। 

যে কাজগুলো সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার ছিল, যেমন জিনিসপত্রের দাম—সরকারের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। যদি এখানে সরকারের কোনো উদ্যোগ থাকত, তা যদি ব্যর্থ হতো, তাহলেও মানুষ সহানুভূতির চোখে দেখত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হামলা, ভাঙচুর—এসব ঘটনা কমছে না। এ কারণে সব পর্যায়ে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে জনসমর্থন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমছে। 

এখানে একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয় যে বিক্ষুব্ধ জনতা এসব সহিংসতা করেছে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা নিজে নিজে কিছু করেনি। কিছু লোক ও কিছু গোষ্ঠী পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই জনগণকে প্ররোচিত করেছে। এই রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা সৃষ্টির পেছনে দেশি–বিদেশি নানাজনের ভূমিকা থাকতে পারে। এটা চিহ্নিত করা, প্রতিহত করা এবং জনগণের সামনে স্পষ্ট করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। এই জায়গাটাতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখেই একটা উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রসঙ্গে যৌথ বাহিনীর পূর্বের ভূমিকার কথা মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বিভিন্ন সরকারের সময় যৌথ বাহিনীর এ ধরনের অপারেশনের রেকর্ড ভালো নয়। 

আওয়ামী লীগ আমলের পুরোনো যেসব ফর্মুলা ছিল আদালত, পুলিশ, যৌথ বাহিনী—এদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, এখনো সেই একই ধরনের তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কথাবার্তার ধরনও একই রকম। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব স্ববিরোধী কথাবার্তা বলা হচ্ছে, সেগুলোও আগের সরকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছাঁচ থেকে বেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু এই সরকার সেই ছাঁচকে যেন আরও শক্তিশালী করতে যাচ্ছে।

নাগরিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট চাওয়া থাকতে পারে। প্রথমত, সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে যে তারা আসলে কী চায়। সরকারের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে চিন্তার ঐক্য কিংবা অবস্থানের ঐক্য পরিষ্কার করা উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বিভিন্ন পক্ষ, রাজনৈতিক দলও অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কাজে যথেষ্ট সন্তুষ্ট নয়। এ বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত সরকারের। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন করছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও সমর্থন করছেন না। তাহলে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অদক্ষতা কিংবা অমনোযোগিতার কারণে। কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 

তৃতীয়ত, কোনো ধরনের বৈষম্য—তা নারী–পুরুষের মধ্যে হোক, জাতিগত হোক বা ধর্মীয় হোক, যেকোনো বৈষম্য উৎসাহিতকারী তৎপরতা, চিন্তা কিংবা সহিংসতা সরকার বরদাশত করবে না এবং তার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেবে। অতীতের মতো বিচারবহির্ভূত তৎপরতা, হয়রানি করা, ডিবি এসে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পুরোনোকালের মতো গল্প বানানো—এগুলোর কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। 

সরকার নিজের অবস্থান যদি ঠিক করে যে আমরা আগের প্রক্রিয়ায় আর চলব না, তাহলেই সমস্যার সমধানের দিকে এগোনো যাবে। দেশে যে সরকার আছে, তাদের ওপর যে দায়িত্ব আছে এবং তারা যে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনে রাখতে হবে।

সংস্কারের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব তো সরকারকে পালন করতেই হবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা এখন সরকারের প্রধান কাজ। তারা যত শিগগির একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, আমরা তত দ্রুত অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাব।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ভ ন ন ধরন র গ রহণয গ য ন সরক র র সরক র র ক সরক র র স সরক র র প পর স থ ত অবস থ ন র র জন মন য গ র জন ত র জন য র একট

এছাড়াও পড়ুন:

রহস্য এই যে, সরকারের কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন

অন্তর্বর্তী সরকার গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। এ কারণে সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। জনগণের একটা বড় অংশ সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সরকারের ভূমিকায় মনে হচ্ছে অগ্রাধিকারভিত্তিতে যে কাজগুলো করার কথা, সেসবের দিকে তাদের মনোযোগ নেই।

আমাদের উদ্বেগ এই জায়গায়—কোনো কোনো ঘটনায় মনে হচ্ছে দেশে যেন সরকারের অস্তিত্ব নেই। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের যেমন কর্তৃত্ব আছে, তেমনি দায়িত্বও আছে। কিন্তু সরকারের কর্মকাণ্ডে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব—এই দুটি বিষয়ের মধ্যে অসংগতি রয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা, সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের ভাঙচুর, হামলা ইত্যাদি ব্যাপারেও তা দেখা গেল।

আরও পড়ুনসরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আমরা দেখলাম ঘোষণা দিয়ে ভাঙচুর শুরু হলো। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর হতে থাকল। সরকার প্রথমে কিছুই বলল না। যেভাবে ভাঙচুর হলো, বুলডোজারসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র যেভাবে ব্যবহার করা হলো; তাতে বোঝাই গেল যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে, তাদেরও কোনো ভূমিকা দেখা গেল না। 

যারা ভাঙচুরের আহ্বান জানাল, তাদের অনেকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠনের অংশ। ভাঙচুরের পরে প্রধান উপদেষ্টা বিবৃতিতে ভাঙচুর বন্ধ করতে বলেছেন। পুরো বিষয়টিতেই তিনটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে। একদিকে অমনোযোগ, সেই সঙ্গে আলস্য বা নিষ্ক্রিয়তা, আরেক দিকে রহস্য। রহস্য এই যে আসলে সরকারের সিদ্ধান্তটা কে নিচ্ছেন, কীভাবে নিচ্ছেন এবং কেন নিচ্ছেন?

ফেসবুকে সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত লোকজন নানাভাবে যে ধরনের যুক্তিগুলো দিচ্ছেন, উপদেষ্টারা যে ভাষায় কথা বলছেন, কোনো কোনো সময়ে সেসবের মধ্যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। এর পরিণতি হলো আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়ে করা এই কাজগুলো আসলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন কিংবা প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করছে।

সংস্কারের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব তো সরকারকে পালন করতেই হবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা এখন সরকারের প্রধান কাজ। তারা যত শিগগির একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, আমরা তত দ্রুত অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাব।

এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমাদেরও উদ্বেগটা এখানে, কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে? কখনো বাউলগান, কখনো মাজার, কখনো ভাস্কর্য—এগুলো নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো যারা আক্রমণ করছে, তারা কারা? তাদের ঠেকাতে সরকারের ভূমিকা কী?

গণ–অভ্যুত্থানে ব্যক্ত বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা, বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কি? বরং বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক রাজনীতি, জবরদস্তি করা, মানুষকে ভয় দেখানো, আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সৃজনশীলতার ওপরে আক্রমণ করার যে প্রবণতাগুলো তৈরি হচ্ছে, তা পুরো গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।

গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলো যে শেখ হাসিনা সরকার, তারা যদি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক হতো, তাহলে ভারত এভাবে বাংলাদেশের ওপর তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারত না। একমাত্র স্বৈরশাসনের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। এই স্বৈরশাসন ছিল ভারতের জন্য খুব বড় একটা আশীর্বাদ। বাংলাদেশ থেকে আধিপত্যের যে কাঠামোটা ভারত রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করেছিল, সেই কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ হলো শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেওয়া এবং বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার করতে দেওয়া। বাংলাদেশে যত ধরনের নৈরাজ্য কিংবা সহিংসতা তৈরি হবে, সেগুলো আসলে বিজেপি সরকারের একটা বড় ধরনের হাতিয়ার হবে।

শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের বক্তব্য ও ভূমিকা থেকে মনে হয় যে তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়নি। তারা যদি চক্রান্তের পথে যায়, বাংলাদেশের জনগণকে তা মোকাবিলা করতে হবে। সেই মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বই হচ্ছে প্রধান। কিন্তু সরকারের মনোযোগহীনতার কারণে এই সহিংসতা ও বৈষম্য বৃদ্ধির রাজনীতি যদি বাড়তে থাকে, বিভিন্নভাবে জনগণ যদি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়তে থাকে, তাহলে সেই চক্রান্ত মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। 

যে কাজগুলো সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার ছিল, যেমন জিনিসপত্রের দাম—সরকারের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। যদি এখানে সরকারের কোনো উদ্যোগ থাকত, তা যদি ব্যর্থ হতো, তাহলেও মানুষ সহানুভূতির চোখে দেখত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হামলা, ভাঙচুর—এসব ঘটনা কমছে না। এ কারণে সব পর্যায়ে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে জনসমর্থন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমছে। 

এখানে একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয় যে বিক্ষুব্ধ জনতা এসব সহিংসতা করেছে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা নিজে নিজে কিছু করেনি। কিছু লোক ও কিছু গোষ্ঠী পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই জনগণকে প্ররোচিত করেছে। এই রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা সৃষ্টির পেছনে দেশি–বিদেশি নানাজনের ভূমিকা থাকতে পারে। এটা চিহ্নিত করা, প্রতিহত করা এবং জনগণের সামনে স্পষ্ট করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। এই জায়গাটাতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখেই একটা উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রসঙ্গে যৌথ বাহিনীর পূর্বের ভূমিকার কথা মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বিভিন্ন সরকারের সময় যৌথ বাহিনীর এ ধরনের অপারেশনের রেকর্ড ভালো নয়। 

আওয়ামী লীগ আমলের পুরোনো যেসব ফর্মুলা ছিল আদালত, পুলিশ, যৌথ বাহিনী—এদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, এখনো সেই একই ধরনের তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কথাবার্তার ধরনও একই রকম। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব স্ববিরোধী কথাবার্তা বলা হচ্ছে, সেগুলোও আগের সরকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছাঁচ থেকে বেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু এই সরকার সেই ছাঁচকে যেন আরও শক্তিশালী করতে যাচ্ছে।

নাগরিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট চাওয়া থাকতে পারে। প্রথমত, সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে যে তারা আসলে কী চায়। সরকারের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে চিন্তার ঐক্য কিংবা অবস্থানের ঐক্য পরিষ্কার করা উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বিভিন্ন পক্ষ, রাজনৈতিক দলও অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কাজে যথেষ্ট সন্তুষ্ট নয়। এ বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত সরকারের। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন করছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও সমর্থন করছেন না। তাহলে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অদক্ষতা কিংবা অমনোযোগিতার কারণে। কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 

তৃতীয়ত, কোনো ধরনের বৈষম্য—তা নারী–পুরুষের মধ্যে হোক, জাতিগত হোক বা ধর্মীয় হোক, যেকোনো বৈষম্য উৎসাহিতকারী তৎপরতা, চিন্তা কিংবা সহিংসতা সরকার বরদাশত করবে না এবং তার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেবে। অতীতের মতো বিচারবহির্ভূত তৎপরতা, হয়রানি করা, ডিবি এসে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পুরোনোকালের মতো গল্প বানানো—এগুলোর কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। 

সরকার নিজের অবস্থান যদি ঠিক করে যে আমরা আগের প্রক্রিয়ায় আর চলব না, তাহলেই সমস্যার সমধানের দিকে এগোনো যাবে। দেশে যে সরকার আছে, তাদের ওপর যে দায়িত্ব আছে এবং তারা যে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনে রাখতে হবে।

সংস্কারের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব তো সরকারকে পালন করতেই হবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা এখন সরকারের প্রধান কাজ। তারা যত শিগগির একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, আমরা তত দ্রুত অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাব।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক

সম্পর্কিত নিবন্ধ