এখানে ঘুমিয়ে থাকলে বুকের ভেতর দিয়ে এক শ ট্রেন দৈনিক আনাগোনা করে। এক শই কি? বিতৃষ্ণা বলেই হয়তো কখনো সংখ্যাটা গুনে দেখোনি তুমি। অথচ একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তুমি ভাবতে, গণিতে খুব পাকা তুমি।
অবশ্য বিতৃষ্ণাকে আর অন্য কিছু দিয়ে তুলনা করা যায় না। যার একবার কোনো কিছুর প্রতি এটি জন্মে, সে আর ফিরতে পারে না। শৈশবে এক মহাজন চিনতে তুমি। ফটফটে চেহারা, কী সুন্দর হাসি.
লোকটাকে জানার পর থেকেই তুমি তার পিছু পিছু ঘোরো। সে কোথায় যায়, কেনই–বা যায়, কী করে—সব তোমার জানা চাই। অথচ দিন দশেকের মফস্সলি তদন্তেও লোকটার গতিবিধি জানা হয় না তোমার। সকালে সে বড় ইঁদারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, একদৃষ্টে কিছু একটা দেখে, কিন্তু কীই-বা দেখার আছে ওখানে? ইঁদারার সবচেয়ে বড় যে সৌন্দর্য, সেই পানিই নেই ভেতরে। বরং বাজারজুড়ে হাজারো ময়লা নিয়মিত জমা হচ্ছে ভেতরে। ক্রমেই ইঁদারাটা হয়ে উঠছে এক মহাভাগাড়। ভাগাড়ে মানুষের কী এমন থাকে?
অথচ দেখে মনে হয়, ওই মহাজনের কিছু না কিছু তো আছেই সেখানে।
দুপুরে লোকটা যায় সিঁড়িঘাটে। তুমি যাও তার পিছু পিছু। লোকটা তার বাড়তি লুঙ্গিটা পাথরের ওপর রেখে কোমরপানিতে নেমে যায়। অথচ গোসল করে না। ডুব দেয় না। তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে পানির দিকে। এদিকে তুমিও তাকিয়ে থাকো একইভাবে লোকটার দিকে।
আর লোকটা নাকি রাতের বেলা বের হয় ঘুরে বেড়াতে? কোথায় ঘুরতে যায়, তোমার দেখতে ইচ্ছা হয় খুব। কিন্তু তোমার সেই ক্ষমতা নেই। রাতের বেলা বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তোমার। তোমাকে ঘিরে ঘুমিয়ে থাকে তোমার পরিবার। অথচ তুমি আর তাদের মধ্যে থাকো না। তুমি মনে মনে ঘুরতে থাকো লোকটার পিছু পিছু।
এ রকম চলতে চলতেই এক রাতে তুমি আর ঘুমাও না। সারা রাত মনে মনে লোকটাকে খুঁজতে থাকো। কখনো বড় বাজার, কখনো গোলা মাঠ, কখনো বাবুদের নৌকার ওপর, কখনোবা কাজীপাড়ার আমবাগানে। এত দূরেই যেতে পারো তুমি মনে মনে...আর এতটুকুতেই তোমার একটা পুরো রাত ফুরিয়ে যায় ঘুমহীন। শুয়ে শুয়ে তুমি শুনতে পাও শিমুল ফুলের পড়ে যাওয়ার শব্দ, পাশের বাড়ির খোপে পায়রার খসখস করে হেঁটে চলা।
জীবনে প্রথম নির্ঘুম রাত কাটিয়ে তুমি যাও পুনর্ভবার কাছে। আর কী বিস্ময়! তুমি দেখতে পাও মহাজনও দাঁড়িয়ে আছে নদীর ওপর। ভোর বলেই হয়তো তুমি সাহস করো। সাহস করে এগিয়ে যাও তার দিকে। আর বলো, ‘আপনি ঘুমান না?’
লোকটা তাকায়। বলে না কিছুই। তুমি অনেকক্ষণ আর কিছু বলতে পারো না। তারপর জিজ্ঞেস করো, ‘আপনার ঘুম আসে না?’
লোকটা তবু নিরুত্তর।
তুমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না। ফিরে আসতে চাও। আর যখন ফিরে আসবে বলেই সিঁড়ি বাইতে থাকো, তখনই লোকটা খসখসে কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ঘুম আসে। কিন্তু ঘুমাই না। বিতৃষ্ণা লাগে!’
২.
সেই প্রথম ‘বিতৃষ্ণা’ শব্দটা শুনেছিলে তুমি। তখন তার মানে জানা ছিল না তোমার। কিন্তু শব্দটা শোনার পর থেকেই কী যেন হয় তোমার মধ্যে, কিছুই যেন আর ভালো লাগে না। কোথাও গিয়ে স্বস্তি হয় না। স্কুলে তোমার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না কোনো দিকে। খেলতে খেলতে তুমি কেমন যেন আটকে পড়ো নিজের ভেতরেই। অনেক অনেক বছর পর যখন তোমার সঙ্গে দেখা হয় নিত্রার, সে বলে, অর্থ না জেনেই তুমি সেই ছোটবেলায় বিতৃষ্ণার ভেতর ঢুকে গিয়েছিলে রাদিফ। সেখান থেকে আর কখনো বের হতে পারোনি।
‘আমার কোনো বিতৃষ্ণা নেই। কোনো কিছুতেই নেই।’
তোমার কথায় নিত্রা হেসেই ছিল শুধু। পরে বলেছিল, নিজেকে যদি এখন আয়নায় দেখতে পেতে তুমি, বুঝতে বিতৃষ্ণা আসলে দেখতে কেমন!
নিত্রা তোমার সঙ্গে অনেক দিন ছিল। তোমার মনে হয়েছিল, নিত্রা বোধ হয় সারা জীবনই তোমার সঙ্গে থেকে যাবে। ব্যাপারটা তোমাকে মাঝেমধ্যেই অস্বস্তিতে ফেলত। তুমি জানতে চাইতে, তুমি কি প্রতিদিনই আসবে আমার এখানে?
নিত্রা বলত, ‘ইয়েস!’ তারপর হাসত অনেকক্ষণ। শেষে বলত, ‘তোমার কি এখন আমাকে বিতৃষ্ণা হচ্ছে?’
কিছুই বলতে না তুমি। কিন্তু তোমার মনে হতো নিত্রা চলে যাক। মনে হতো, সে যদি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তোমার পাশে বসে, তোমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। যেন তোমার ওপর একটা ভার এসে ভর করে। যেন তুমি যা চাও, তা করতে পারো না। ফলে বৃষ্টির ওই সন্ধ্যায় তুমি অসহ্য রকম বিদ্রোহী হয়ে ওঠো। নিত্রা যখন কফির কাপের সঙ্গে নিজেকেও এগিয়ে দেয় তোমার দিকে, তোমার শরীরের সঙ্গে তার শরীর...বাড়তে থাকা প্রেম, তখন তোমার পৃথিবীও কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে। একঝটকায় তুমি সরিয়ে দাও নিত্রাকে। আর প্রবল অপমানে বৃষ্টির মধ্যে সে ভেসে যেতে থাকে। তীব্র ক্ষোভ থেকেই নিত্রা বলে ওঠে, ‘শোনো, ওই ভোরে লোকটা তোমাকে ঘুম নিয়ে কিছু বলেনি, বিতৃষ্ণা নিয়েও কিছু বলেনি...কিছুই বলেনি...সে তোমার শরীর ধরেছিল সেদিন...পুনর্ভবাকে উথাল-পাতাল করে লোকটা তোমার শৈশবকে মেরে ফেলেছিল! তুমি বলোনি, কিন্তু আমি জানি!’
নিত্রা সেদিন চিরদিনের মতো চলে গিয়েছিল। তোমার বুক থেকে নেমে গিয়েছিল এক পৃথিবীর ভার!
৩.
রাদিফ মানে তুমি জানো। কিন্তু কাউকে তোমার তা বলতে ইচ্ছা করে না। সারা রাত তুমি চোখ মেলে তাকিয়ে থাকো ছাদের দিকে। ঝমঝমিয়ে ট্রেন চলে যায় একের পর এক। এক শ, দুই শ, তিন শ... ট্রেন চলে যায়, যেতেই থাকে একের পর এক!
কখনো কখনো তোমার বাইরে যেতে ইচ্ছা হয়, কাউকে বলতে ইচ্ছা হয় রাদিফ মানে কী...কিন্তু কোথায় যাবে তুমি? কাকেই–বা বলবে কিছু...
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জিনদের আহার্য
মহানবী (সা.) একবার তার সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বললেন কিছু পাথর নিয়ে আসতে। তবে হাড় বা গোবর আনতে নিষেধ করলেন। আবু হুরায়রা (রা.) কাপড়ে করে কিছু পাথর এনে সেগুলো নবীজি (সা.)-এর পাশে রেখে চলে গেলেন। নবীজি (সা.) কাজ সেরে ফিরে আসার পর আবু হুরাইরা জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসুল, হাড় ও গোবরে সমস্যা কী? তিনি উত্তরে বললেন, সেগুলো জিনদের খাবার। নাসিবিন শহরে (সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে আলজাযিরার একটি নগরী) জিনদের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা সবাই খুব ভালো জিন। আমার কাছে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া করি। তাই তারা যে হাড় বা গোবরের পাশ দিয়ে যাবে, তাতেই নিজেদের জন্য খাবার খুঁজে পাবে। (বুখারি, হাদিস: ৩,৫৭৮)
আরও পড়ুনইবলিস কি জিন নাকি ফেরেশতা১৬ মার্চ ২০২৫তাই কেউ যদি বিসমিল্লাহ বলে খাবার খায় এবং হাড় থেকে মাংস খাওয়ার পর নাপাক স্থানে না ফেলে, মুমিন জিনেরা সেই হাড় হাতে নিলে তাতে গোশত ফিরে আসবে। (তিরমিজি, হাদিস: ৩,২৫৮)
আর দুষ্ট জিন ও শয়তানরা খায় এমন খাবার, যাতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না। যেসব খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা হয়, সেগুলো তারা ছুঁয়েও দেখে না।
গোবরে জিনদের পশুদের জন্য খাবার জমা হয়। তার মানে জিনদের পোষা প্রাণী আছে এবং তারা তাতে আরোহণ করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘গোবর বা হাড় নাপাকি পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করো না। কারণ এগুলো তোমাদের ভাই জিনদের খাবার।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৮)
আরও পড়ুনকোরআন শুনে একদল জিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন০৬ আগস্ট ২০২৩