আইনি প্রক্রিয়ায় আটকে আছে জকসু নির্বাচন
Published: 10th, February 2025 GMT
অবশেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথ খুলছে। আইনে ছাত্র সংসদের বিধান যুক্ত না থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৯ বছরেও নির্বাচন হয়নি। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নীতিমালা ইতিমধ্যে সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হয়েছে। এখন আইনি প্রক্রিয়া শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলেই নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের বিধান না থাকায় দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন ও নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। কয়েকটি ছাত্র সংগঠনও একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে জকসু বিধান যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ।
সিন্ডিকেটে অনুমোদিত জকসু নীতিমালার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি হলে এটি আইন হিসেবে গৃহীত হবে।রেজাউল করিম, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদ নিয়ে কোনো বিধান ছিল না। ইতিমধ্যে সিন্ডিকেট সভায় জকসুর নীতিমালা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন জকসু নিয়ে আর কোনো বাধা নেই। সিন্ডিকেটে অনুমোদিত নীতিমালার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি হলে এটি আইন হিসেবে গৃহীত হবে।’
বিশ্ববিদ্যায় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার আইন ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫’–এ ছাত্র সংসদের বিষয়টি যুক্ত ছিল না। প্রতিষ্ঠার পর গত প্রায় ১৯ বছরেও ছাত্র সংসদ বিধান যুক্ত করা হয়নি। ফলে নির্বাচনও হয়নি। যদিও ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে জকসু গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটি গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন করে জমা দিলেও সিন্ডিকেটে তা পাস হয়নি।
গত ৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জকসু নির্বাচনের জোরালো দাবি তোলেন। প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবাসন, ক্যানটিন, মানসম্মত লাইব্রেরিসহ নানা সংকট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরাসহ শিক্ষার্থীদের যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করতে ছাত্র সংসদ অত্যন্ত জরুরি। তাই দ্রুত জকসু নির্বাচন দিতে হবে।
জকসু বিধান সিন্ডিকেটে পাস হওয়ার পর রেজল্যুশন আকারে চিঠি আসার কথা, সেটা এখনো আমার কাছে আসেনি। চিঠি এলেই আমরা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া শুরু করব।সাবিনা শরমীন, কোষাধ্যক্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেজবা উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত জকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শিক্ষার্থীদের প্রতি ছাত্রনেতাদের জবাবদিহির পথ তৈরি হবে। সেই জবাবদিহির জায়গা থেকে ছাত্রনেতারা চাইলেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ব্যাহত হয়, এমন কোনো কাজ বা লেজুড়বৃত্তিক দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তাই তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচন চান।
সম্প্রতি ছাত্র অধিকার পরিষদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জকসু নীতিমালা ও নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত রূপরেখার দাবি জানায়। ছাত্রশিবির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জকসু নির্বাচনের দাবিতে গত নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে সংবাদ সম্মেলনে করে।
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জকসুর নীতিমালা প্রণয়নে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জকসুর খসড়া (পরিমার্জিত ও সংশোদিত) নীতিমালা জমা দেয়। প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে জকসু নীতিমালা অনুমোদিত হয়। সিন্ডিকেটে অনুমোদিত নীতিমালার আইনি মতামত গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ সাবিনা শরমীনসহ দুজন অধ্যাপককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাবিনা শরমীন গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রথম আলোকে বলেন, ‘জকসু বিধান সিন্ডিকেটে পাস হওয়ার পর রেজল্যুশন আকারে চিঠি আসার কথা, সেটা এখনো আমার কাছে আসেনি। চিঠি এলেই আমরা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করব।’
ছাত্রসংগঠনগুলো কী বলছেজকসু নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ছাত্রসংগঠন। তবে কারা ভোট দিতে বা নির্বাচন করতে পারবেন, তাঁদের বয়স কত হবে—এসব নিয়ে সংগঠনগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক জুবায়ের ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর রাখার জন্য এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। তাঁর মতে, প্রাক্তন শিক্ষার্থী নয়, বরং বর্তমান শিক্ষার্থীরা জকসু প্রতিনিধি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো। কারণ, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত।
গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার জন্য ছাত্র সংসদের নির্বাচন প্রয়োজন বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব সামসুল আরেফিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
ছাত্রশিবিরের সভাপতি আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন পাস করে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মারকলিপি দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। যাঁরা পাস করে বের হয়েছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে কাজ করতে পারবেন না।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এ কে এম রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আগে ঠিক করতে হবে যে শিক্ষার্থী কারা বা শিক্ষার্থীর সংজ্ঞা কী হবে? সেই ক্ষেত্রে যদি শিক্ষার্থীর বয়স ৩০ বছরও হয়, তাহলে তাঁকে ভোটার হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন দরকার উল্লেখ করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ইভান তাহসীভ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য দাবিদার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তাজাম্মুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সব সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করছে। আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো সহিংসতা নেই, যেটা খুবই ইতিবাচক। আইন চূড়ান্ত হলেই জকসু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমরা প্রস্তুত।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রণয়ন র জন য র আইন হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
বিলুপ্ত হচ্ছে এনবিআর, বন্ধ হবে সরকারের হস্তক্ষেপ
রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মাধ্যমে ৫৩ বছরের এ সংস্থা বিলুপ্ত হবে।
উপদেষ্টা পরিষদে তা চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে কমিটি গঠনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে। এর ফলে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগে বন্ধ হবে সরকারের হস্তক্ষেপ। একক ইচ্ছায় কাউকে ওএসডি বা চাকরিচ্যুত করা যাবে না।
গত ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিদ্যমান এনবিআরকে ভেঙে দুটি বিভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এ দুটি কার্যক্রমকে পৃথক্করণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। দুই বিভাগের সচিব হবেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা সচিব বা জ্যেষ্ঠ সচিবের মর্যাদা পাবেন। নীতি বোর্ডের সদস্যরা পদমর্যাদা পাবেন গ্রেড-১।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান এই বোর্ডের প্রশাসন, আর্থিক, উন্নয়ন ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। দেখভাল করবেন বোর্ড সদস্যদের কাজ। তিনি বোর্ড সভা ও উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে সভারও আয়োজন করবেন। চেয়ারম্যানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এই অধ্যাদেশে সংজ্ঞায়িত বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর অনুবিভাগের দু’জন এবং শুল্ক, মূসক ও আবগারি অনুবিভাগের দু’জন করে কর্মকর্তা নীতি বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন। তাদের এনবিআরের সদস্য বা কমিশনার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এতে বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারবেন না আমলারা। তবে স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় আমলারাই ছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান।
আইআরডির নিয়ন্ত্রণে থাকছে না বোর্ড
নতুন অধ্যাদেশ চূড়ান্তভাবে জারি হলে জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড আইআরডিতে সংযুক্ত থাকবে। কিন্তু কোনোভাবে অধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না। আয়কর নীতি, কর নীতি, ভ্যাট নীতি ও শুল্ক নীতি প্রণয়ন এবং এসআরও, ব্যাখ্যা ও প্রজ্ঞাপন জারীকরণে রাজস্ব নীতি বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার থেকে। সদস্য চারজন কাজ করবেন আয়কর নীতি ও গবেষণা, আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য কর নীতি ও গবেষণা, ভ্যাট নীতি ও গবেষণা এবং শুদ্ধ নীতি ও গবেষণা বিষয়ে।
বিদ্যমান নিয়মে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) অধীনে কাজ করছে এনবিআর। আইআরডি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর আরোপ ও আহরণ এবং এ-সংক্রান্ত আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন-নবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। তবে আইআরডির সচিব একই সঙ্গে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক ব্যক্তি দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ায় অভিযোগ আছে নানা জটিলতার। আইআরডির কাজ সম্পাদন করেন উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সমকালকে বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কার্যকরভাবে আলাদা হলে সে ক্ষেত্রে একদিকে এনবিআর রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করবে; অন্যদিকে আইআরডি রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী তার স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে পারবে। ভারতে একদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগ এবং অন্যদিকে প্রত্যক্ষ কর বোর্ড ও পরোক্ষ কর বোর্ড এ কাজগুলো করে থাকে। স্বাধীনতা ও জবাবদিহি পরস্পরের পরিপূরক।
জানা যায়, শিগগির জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড অধ্যাদেশের খসড়া আইআরডি থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করবে। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান এনবিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করা হবে। সংশোধন হবে রুলস অব বিজনেস, অ্যালোকেশন অব বিজনেস, বিসিএস (কাস্টমস ও ট্যাক্স) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলস-১৯৮০।
এদিকে গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ঈদের আগেই অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে উঠবে এবং জারি হবে। কার্যক্রম শুরু হবে নতুন অর্থবছরের প্রথম থেকেই। প্রধান উপদেষ্টা গতকালও (মঙ্গলবার) ডেকে জানিয়েছেন ঈদের আগেই আলাদা হওয়ার বিষয়টি পাস হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব নীতি বিভাগে যারা কাজ করবেন, তাদের এ বিষয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে। আমলাতান্ত্রিক নিয়মে না করে যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন স্বতন্ত্র দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কারও ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ না থাকে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদের নিয়োগে রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, সরকারি সিদ্ধান্তে নিয়োগ হলে আগের মতো পছন্দের ব্যক্তিরাই নিয়োগ হতে পারে। সরকারের ব্যক্তিরা যেহেতু নিজেই করদাতা, এ জন্য তারা তাদের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে।
অস্ট্রেলিয়ার মতো নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব
রাজস্ব নীতি সংস্কার-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সার্চ কমিটিতে থাকেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতি। তারা সম্মিলিতভাবে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেন। এর পর যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার তার নিয়োগ বাতিল করতে হলে সবার মতামত নিতে হয়। বাংলাদেশেও এভাবে রাজস্ব নীতির চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাস্তবায়নে রয়েছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রয়েছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। কারণ, বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাধা দিতে পারেন। এর আগে ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজস্ব প্রশাসন ও নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথক করতে একটি আদেশ জারি করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেই সিদ্ধান্ত বাতিল বা স্থগিত না করে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। রাজস্ব নীতি সংস্কার-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রের কল্যাণে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। যাতে হাকিম নড়বে, কিন্তু হুকুম নড়বে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, করদাতারা যাতে সহজে ও হয়রানিমুক্তভাবে কর দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। এ জন্য রাজস্ব খাতের সংস্কার জরুরি হয়ে গেছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগ ২৮৬ কোটি টাকার কর ফাঁকির ঘটনা খুঁজে পেয়েছে সংস্থাটি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সবচেয়ে বেশি কর ফাঁকির তথ্য পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। এই খাতে সব মিলিয়ে ১৬৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য মিলেছে।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা একটি পেশাগত কাজ, কিন্তু সাধারণ হয়ে গেছে। এটা আলাদা করা জরুরি। এ জন্য পৃথক মানবসম্পদ বিভাগ করতে হবে। কেউ যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে। তবে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ দুটি স্বতন্ত্র করতে হবে। এক বিভাগের জনবল যেন অন্য বিভাগে যেতে না পারে। কারণ, এখানে একটা স্বার্থের সংঘাত কাজ করে। তিনি বলেন, যোগ্যতার মাপকাঠি শুধু জ্যেষ্ঠতা হতে পারে না। যারা নীতি বিভাগে কাজ করবে, তাদের ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন শর্ত রাখতে হবে। এ ছাড়া রাজস্ব সংগ্রহ যেন মূল লক্ষ্য না হয়; বরং অর্থনীতিতে সমতা, প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের বিষয়টি সামনে রাখতে হবে।
নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে উপদেষ্টা পরিষদ
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বোর্ডের নীতি প্রণয়ন কাজে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদানের জন্য সরকার প্রতিবছর অনধিক সাত সদস্যের একটি রাজস্ব নীতি-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে সভা আয়োজন করবে বোর্ড। এর পর বোর্ডকে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করা হবে।
মুসলিম চৌধুরী বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা কোন খাতের হবেন, সেটি রুল বা বিধি দিয়ে স্পষ্ট করতে হবে। উপদেষ্টাদের বৈঠকে সম্মানী রাখা যেতে পারে। এতে তারা কাজে উৎসাহ পাবেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন হলে শুধু রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্য হতে পারবেন। চেয়ারম্যান নিয়োগ করবে উপদেষ্টা পরিষদ। তবে সংশ্লিষ্ট আইনবিধি সংশোধন করে বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস লাগবে।
এনবিআর সংস্কারে গত ৯ অক্টোবর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারকাজ শুরু হয়।