ব্যারিস্টার তাসনুভা শেলী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, লিগ্যালাইজড এডুকেশন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জাস্টিসিয়া লিগ্যাল মাইন্ডসের চেম্বার-প্রধান। আইন অঙ্গনে প্রযুক্তিচালিত সমাধান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইন্টারন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর এবং ভার্জিনিয়ার অ্যান্টোনিন স্ক্যালিয়া ল স্কুলে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ওয়াশিংটনের অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ফেডারেল ট্রেড কমিশনের লিগ্যাল ফেলো হিসেবেও কাজ করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ‘ডেটা প্রাইভেসি’ সপ্তাহ পালিত হয়। তথ্যের গোপনীয়তার বিষয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

তাসনুভা শেলী: আপনি হয়তো ভাবতে পারেন– সবকিছুই যখন অনলাইনে আছে, তখন তথ্যের গোপনীয়তা কেন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধরুন, ফেসবুক বা গুগলে আপনি কোনো পণ্য খোঁজ করছেন এবং হঠাৎ সেই পণ্যের বিজ্ঞাপন সব জায়গায় দেখতে পাচ্ছেন। আজকের বিশ্বে ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইন ইকোসিস্টেমকে চালিত করে। প্রযুক্তি কোম্পানি ও বিজ্ঞাপনদাতারা আপনার তথ্যকে মূল্যবান হিসেবে দেখছে বটে; কিন্তু এখানে গুরুতর গোপনীয়তার উদ্বেগ আছে। তথ্য শেয়ারের বিষয়টি হয়তো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না; কিন্তু তথ্য গোপনীয়তার সর্বোত্তম অনুশীলন আপনাকে কার সঙ্গে কী শেয়ার করছেন, তা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারবে। অর্থাৎ সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার অনলাইন জগৎকে আরও নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির মধ্যেই ‘ডেটা প্রাইভেসি’ সপ্তাহের সার্থকতা।

সমকাল: ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

তাসনুভা শেলী: বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সচেতনতা এবং আইনি কাঠামোর অভাব। তথ্য সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে। যে কারণে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার সম্ভব হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি কাঠামোর উন্নতি ও আইনের প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল: আপনি তথ্য প্রাইভেসি বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের কথা বললেন। আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?

তাসনুভা শেলী: অনেকেই অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত নন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে, সে বিষয়ে ধারণা নেই। অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়লেও সচেতনতামূলক প্রচারণা ও শিক্ষামূলক উদ্যোগ এখনও সীমিত। 

সমকাল: সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্য প্রাইভেসি বিষয়ে কোনো উন্নতি প্রয়োজন?

তাসনুভা শেলী: প্রথমত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্পষ্ট ও বিস্তৃত তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা প্রয়োজন। সরকারকে সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষায় শক্তিশালী ‘ডেটা এনক্রিপশন’ পদ্ধতি এবং নিরাপদ স্টোরেজ ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা ছাড়া গোপনীয়তার নিয়মাবলি মেনে চলা নিশ্চিত করতে নিয়মিত তদারকি জরুরি। 

সমকাল: দেশের তথ্য গোপনীয়তা-বিষয়ক আইন বা নীতিমালা বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

তাসনুভা শেলী: বর্তমানে পারসোনাল ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট, ২০২৪-এর খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন। এটি ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে বলে আশা করা যায়। ইতোমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ আমরা দেখেছি। সাইবার অপরাধ ও ডিজিটাল নিরাপত্তায় আইনটি প্রণীত হলেও এটি তথ্য গোপনীয়তার সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি সক্ষম নয়। আমরা বিশ্বাস করি, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ নামে যে আইনটি প্রণীত হচ্ছে, তা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইবার স্পেসে নিরাপত্তা জোরদার করবে। একই সঙ্গে এটি সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তথ্যের অপব্যবহার রোধের ব্যবস্থা করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

সমকাল: তথ্য গোপনীয়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ কী হতে পারে?

তাসনুভা শেলী: তথ্য গোপনীয়তার ক্ষেত্রে হুমকি মোকাবিলা ও আরও দৃঢ় সুরক্ষায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রয়োজন। যেমন উন্নত এনক্রিপশন অ্যালগরিদম। এনক্রিপশন তথ্য সুরক্ষার অন্যতম মূল স্তম্ভ হলেও, কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী এনক্রিপশন অ্যালগরিদমে উদ্ভাবন অপরিহার্য হবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সম্ভাব্য উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এনক্রিপশন দুর্বল হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রতিরোধী অ্যালগরিদমের বিকাশ ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং মডেল তথ্য গোপনীয়তার সমস্যা শনাক্তকরণ ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। বিকেন্দ্রীকৃত ডেটা স্টোরেজ বা কেন্দ্রীভূত ডেটা স্টোরেজ সিস্টেম প্রায়ই হ্যাকারদের লক্ষ্য হয়। ইন্টারপ্ল্যানেটারি ফাইল সিস্টেম বা ব্লকচেইন-ভিত্তিক সমাধানের মতো বিকেন্দ্রীকৃত স্টোরেজে উদ্ভাবন ব্যক্তিগত ডেটা সংরক্ষণের একটি নিরাপদ উপায় প্রদান করতে পারে।

সমকাল: ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে নৈতিক কোনো দ্বন্দ্ব আছে?

তাসনুভা শেলী: ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য কিছু নৈতিক দ্বন্দ্ব আছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার ভারসাম্য বজায় রাখা যায়? উদাহরণস্বরূপ, তথ্য নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হতে পারে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো, তথ্য সংগ্রহের সময় ব্যবহারকারীর সম্মতি পাওয়া এবং তাদের তথ্য কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত না করা। নজরদারি করার প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহারও গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে। কারণ, কোনো কোনো কোম্পানি অনুমতি ছাড়াই তথ্য ব্যবহার করে এবং তার ব্যবহারকারীদের কাছে এর স্বচ্ছ জবাব নেই। উপরন্তু, তথ্য বিশ্লেষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতা বা বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগ আছে। এসব সমস্যা তথ্যের গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং ন্যায্যতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

সমকাল: অন্যান্য দেশের তুলনায় তথ্য গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?

তাসনুভা শেলী: ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআর-তথ্য সুরক্ষা আইন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের আইন আছে, সে তুলনায় বলা চলে বাংলাদেশ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৩ এবং পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ২০২৪-এর খসড়ার মতো আইন থাকলেও, প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা সেই অর্থে নেই। অন্যদিকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারও আমরা দেখেছি। মানুষের তথ্য গোপনীয়তার ঝুঁকি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ও ডিজিটাল সাক্ষরতা কম থাকায় সুরক্ষা পদ্ধতি নাজুক। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, শক্তিশালী তথ্য গোপনীয়তা কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশকে এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

সমকাল: তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিতে পারে? সেটা কীভাবে?

তাসনুভা শেলী: নলেজ এক্সচেঞ্জ তথা জ্ঞান বিনিময়, আইনি কাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জিডিপিআর-এর মতো বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন ও এর প্রয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থানীয় দক্ষতা তৈরি করতে, সচেতনতা বাড়াতে ও তথ্য সুরক্ষার জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনে সহায়তা করতে পারে। একইভাবে সাইবার হুমকি ও এর দুর্বলতা সম্পর্কে তথ্যের ব্যাপারে অন্যদের অভিজ্ঞতা নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ফলে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব বাংলাদেশকে তথ্যের গোপনীয়তা অনুশীলন ও ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য আরও ভালো সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।

সমকাল: তথ্য গোপনীয়তা নিয়ে আমাদের সামনের চ্যালেঞ্জ কী?

তাসনুভা শেলী: ভবিষ্যতে তথ্য গোপনীয়তা সংক্রান্ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। কারণ তথ্যের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে এবং কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার (এআই) মতো উন্নত প্রযুক্তি আরও জটিল গোপনীয়তার ঝুঁকির দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তিসহ অন্যান্য কোম্পানি ব্যক্তির যত বেশি তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবে, এর অপব্যবহার তত বাড়বে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, নজরদারি করে এমন প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার; এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন বেশি হতে পারে। তা ছাড়া ডিজিটাল পরিষেবা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য প্রবাহ এখতিয়ার-সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা সীমানাকেন্দ্রিক তথ্য গোপনীয়তার আইন প্রয়োগ কঠিন করে তুলতে পারে। সাইবার আক্রমণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা গুরুতর তথ্য লঙ্ঘন করতে পারে, যা ব্যক্তিগত তথ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে। এসব চ্যালেঞ্জ শক্তিশালী, আরও অভিযোজিত তথ্য গোপনীয়তা আইনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

সমকাল: বাংলাদেশের তথ্য গোপনীয়তা উন্নতকরণে আপনারা কী ভূমিকা রাখছেন?

তাসনুভা শেলী: লিগ্যালাইজড এডুকেশন বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো গত বছর আমরা প্রথম ‘ডেটা প্রাইভেসি’ সপ্তাহ পালন করি ২১ থেকে ২৭ জানুয়ারি। এই বছরও ২৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি আমরা সপ্তাহটি পালন করেছি। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল, টেক কন্ট্রোল অব ইয়োর ডেটা– আপনার তথ্যের নিয়ন্ত্রণ আপনিই গ্রহণ করুন। আমরা আশা করছি, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সরকারি উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

তাসনুভা শেলী: সমকালকেও ধন্যবাদ।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র অপব যবহ র ন শ চ ত কর ব যবস থ ব যবহ র র জন য ন করত আইন র সমস য গ রহণ আপন র সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

সাত মাসে ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ৮৪ জনকে বরখাস্ত করেছে কারা অধিদপ্তর

গত সাত মাসে কারা অধিদপ্তরের ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ছয়জনকে বাধ্যতামূলক অবসর, ৮৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ২৭০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি এবং ২৬০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

নানা অনিয়ম, আর্থিক লেনদেনসহ অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।

সোমবার (১০ মার্চ) দুপুরে পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

আর্থিক লেনদেন ব্যতীত কারাগারে বন্দিদের তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতের জন্য জেল সুপার এবং ডিআইজিদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।

তিনি বলেন, নিয়ম ভঙ্গকারী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কোনোরূপ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের অতি দ্রুততার সঙ্গে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। তারই ফল স্বরূপ সাত মাসে ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ৬ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর, ৮৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ২৭০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান, বিভাগীয় মামলা দায়ের ২৬০ জনের বিরুদ্ধে, ২৯ জনকে কৈফিয়ত তলব, ২১ জনকে চূড়ান্ত সতর্ক, ৩৯ জনকে তাৎক্ষণিক বদলি এবং ১০২ জনকে প্রশাসনিক কারণে বিভাগের বাইরে বদলি করা হয়েছে। 

কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারা সদর দপ্তর নিশ্চিত করছে যে, বর্তমান প্রশাসন প্রমাণসহ যেকোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব কারাগারকে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক হিসেবে গড়ে তুলার লক্ষ্যে বর্তমান প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। ‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জেল ডিপার্টমেন্টকে একটি মানবিক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলার জন্য ইতোমধ্যেই নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। 

বন্দি ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের নানা কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- 

১. দেশব্যাপী বন্দি সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য সংগ্রহের জন্য হটলাইন চালু করা। 

২. বন্দিদের সাক্ষাৎকারে ভোগান্তি কমানোর জন্য ডিজিটাল ভিজিটর ম্যানেজমেন্ট চালু করা। 

৩. অভ্যন্তরীণ বন্দি ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের লক্ষ্যে comprehensive বন্দি ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার চালু করা। যাতে, পিসি ক্যাশ, টেলিফোন কথোপকথন, ক্যান্টিন ম্যানেজমেন্ট এবং বন্দিদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং ধাপে ধাপে তা আর এফ আইডির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।

৪. গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালনকারী কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বডি ক্যাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করণ, ৬৯টি কারাগারকে নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্ক কানেকটিভিটির আওতায় আনায়ন যা কারা ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা জোরদারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

৫. বড় কারাগারগুলোকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনা হচ্ছে। যাতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রাপ্তির নিশ্চিত করাসহ সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বও সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত বন্দির অবস্থান একটি সার্বক্ষণিক সমস্যা উল্লেখ করে সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, এ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার-২ (যা মেট্রোপলিটন কারাগার হিসেবে পরিচিত) চালু করা হয়েছে এবং কেরাণীগঞ্জে আরেকটি বিশেষ কারাগার চালুর উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। 

এ ছাড়া রংপুর, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি পুরোনো কারাগার সম্প্রসারণের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। বন্দিদের নিরাপদ উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। 

বন্দিদের কারাগারের বাহিরে যাতায়াত নিরাপদ এবং ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য আধুনিক জিপিএস ট্রাকারযুক্ত এ্যাংকেল ব্যান্ড লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোপরি কোনো আর্থিক লেনদেন ব্যতীত বন্দিদের তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতের জন্য জেল সুপার এবং ডিআইজিদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গকারী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কোনোরূপ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের অতি দ্রুততার সঙ্গে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে।

বর্তমান প্রশাসন কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধিসহ তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল- কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন ব্যতীত সৎ, যোগ্য, কর্মোদ্যোমী ব্যক্তিবর্গকে গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং স্থাপনায় পদায়ন। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- জনবল সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে নতুন ১৮৯৯টি পদ সৃষ্টি করা, দীর্ঘ ১৪ বৎসর পর সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জট খোলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্জিত ছুটি নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রত্যাশা Apps এর মাধ্যমে সব স্তরের মতামত প্রকাশের ব্যবস্থাকরণ, একই স্থানে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত থেকে অনিয়মের সিন্ডিকেটকারীদের পোস্টিং এর আওতায় আনা, সব পদবির জন্য নতুন প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন, সবার মতামত গ্রহণপূর্বক নতুন নিয়োগবিধির খসড়া চূড়ান্তকরণ, স্বাস্থ্য স্কিমের আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্ধিত সহায়তা প্রদান, পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় আনুতোষিক বৃদ্ধি, Team Tracker এর মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ। এছাড়া Bangladesh Prisons and Correction Services Acts এর খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। কারা গোয়েন্দা ইউনিটকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও কারা কল্যাণ সমিতির কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা কার্যক্রম বৃদ্ধির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।

এতো স্বল্প সময়ে উল্লিখিত সংস্কার সত্ত্বেও বিগত ১৫ বছরের কিছু সুবিধাভোগী অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বন্দিরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাহিরের কিছু অসাধু ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ, প্রপাগান্ডা, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক অবান্তর ও অবাস্তব ঘটনার অবতারণা করে অধিদপ্তরের ভাবমূর্তি বিনষ্টের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তারা কারাগার সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে। 

এক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানাতে চায়, কারাগারের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাসহ অনিয়ম দুর্নীতি দূর করার জন্য কারা সদর দপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কারাগারকে মাদক এবং মোবাইল মুক্ত করার জন্য গত ৩ মাসে শুধুমাত্র কেরাণীগঞ্জ কারাগারেই ২৭৫টি ঝটিকা তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং ফলস্বরূপ কারা অভ্যন্তর থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোট বাটন ফোন এবং মাদক উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। 

এ ছাড়া প্রশাসনের তৎপরতায় কারাগারে মাদক প্রবেশ করানোর বেশ কয়েকটি উদ্যোগও ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ক্যান্টিন দ্রব্যসামগ্রীর মান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। 

বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী, খাবার নিশ্চিতের জন্য কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কারা হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে অবস্থানের সুবিধা কঠোর নজরদারির কারণে বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। 

এতো নজরদারির পরও কারা অধিদপ্তর মনে করে অনেক ক্ষেত্রে আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫/১৬ বছরের অনিয়ম দুর্নীতিতে অভ্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়, কিন্তু তা চলমান রয়েছে এবং আমরা আশাবাদী অদূর ভবিষ্যতে এর সুফল কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কারাগারের সেবা প্রত্যাশীরা উপভোগ করবে।

একটি মহল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দাবি করে কারা মহাপরিদর্শক বলেন,  দীর্ঘ ১৫ বছরের অনৈতিক সুবিধাভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দ্রুত সংস্কার/পরিবর্তন করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তথাপিও কারা বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চান তিনি।

তিনি আরো বলেন, সংরক্ষিত এলাকা এবং বর্তমান সময়ে সাবেক মন্ত্রী-আমলা ও আলোচিত ব্যক্তিবর্গ কারাগারে আটক থাকায় কারাগারের প্রতি সবার আগ্রহ অনিবার্য। কারা প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অপরাধীরা সব সময়েই সচেষ্ট থাকে, আর তাদের দোসররা বাইরে থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সমাজ/দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালায়। এজন্য গণমাধ্যমের গঠনমূলক সমালোচনা কারাগারের সংস্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে দুর্নীতি ও রাহুমুক্ত কারা প্রশাসন গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে কারা উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা) জাহাঙ্গীর কবীর, কারা উপমহাপরিদর্শক (সদর দপ্তর) মনির আহমেদ, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. আবু তালেব, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

ঢাকা/মাকসুদ/এনএইচ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিরিয়ায় ইসলামবাদী পুনরুত্থানের ইঙ্গিত
  • সাত মাসে ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ৮৪ জনকে বরখাস্ত করেছে কারা অধিদপ্তর