মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি তিনটি– গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই তিন নীতির ভিত্তিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি দাঁড়ায় চারটি। বর্তমানে সংবিধানের এই চার মূলনীতির ব্যাপারে দেখা দিয়েছে গভীর এক সংকট। বিশেষত জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে বাঙালি, নাকি বাংলাদেশি– এ নিয়ে তর্ক উঠেছে।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতির মেরূকরণ হয়। নানা সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। যে দলের ভাবাদর্শ– গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সেই সত্তর দশকের পর থেকে জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলেও ভৌগোলিক দিক থেকে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তত্ত্বটি বেশি যুক্তিযুক্ত। এ মতবাদের ভিত্তিতে বড় একটি অংশের ন্যারেটিভ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এ দেশের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের আত্মিক বন্ধনের ওপর গড়ে ওঠে এ মতবাদটি। বর্তমানে বাংলাদেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) ১৫টি দল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ লালন করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চর্চা করা হচ্ছে– আমরা বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই চর্চিত। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের কাছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা হারায় বাংলা। এর পর থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে বাংলার মানুষের মাঝে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাভাষী মানুষ এ জাতীয়তাবাদের আওতাভুক্ত। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশি ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও এ জাতীয়তাবাদ লালন করে এবং তারাও এ মতবাদের অংশ। ভাষাবিদ ড.
বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে নন্দিত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘খণ্ডিত বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুই বাংলায় মিলন ঘটাতে হবে এবং খণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতিকেও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।’
এক কথায় বলতে গেলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সমন্বিত কৃষ্টি-কালচারের মেলবন্ধন হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব ধর্ম-বর্ণের মিলিত পথচলার বন্ধনই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও পুরো জাতি এখনও নির্দিষ্ট কোনো মতবাদে এসে একীভূত হতে পারেনি। এ জন্য হাল আমলের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে বিভক্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদে ভর করে যদি একাত্তরের মহান স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, তাহলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নের এ মতবাদ লালন নয় কেন? এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তেমনি ভূখণ্ডগত জাতিসত্তার ভিত্তি স্থাপনে জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রসার, প্রচার ও চর্চাও অমূলক নয়।
মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে একই কাতারে শামিল করা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে যে মতবাদটি সর্বাপেক্ষা নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে, সেটাই আমলে নেওয়া উত্তম। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার পরে এতটা পথ পাড়ি দিয়েও একক জাতীয়তাবাদ গঠনে আমরা ব্যর্থ।
বেলাল উদ্দিন বিল্লাল: সাংবাদিক bubillalbd@yahoo.com
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গণ–অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পটপরিবর্তন বাংলাদেশের সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। ফলে বাংলাদেশের সামনে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
সোমবার রাজধানীতে বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় প্যানেল আলোচক হিসেবে উইলিয়াম বি মাইলাম এমন অভিমত দেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) ‘ট্রাম্প যুগে বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক’ শীর্ষক ওই আলোচনার আয়োজন করে।
আইবিএফবির সভাপতি লুৎফুন্নেসা সউদিয়া খানের সভাপতিত্বে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সংগঠনের নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহায়তা বন্ধের প্রভাব, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা—এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে।
উইলিয়াম বি মাইলাম বলেন, ‘নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আমি ভেবেছিলাম বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগোবে। এখন বাইরের বিশ্বে বলা যাবে, বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ততার মাধ্যমে অবাধে ব্যবসা–বাণিজ্য করা যাবে।’
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক মার্কিন এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার স্বার্থে সহায়তার জন্য মানবাধিকার সংস্থা রাইট টু ফ্রিডম কাজ করবে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রদূত জন এফ ডেনিলোভিচ বলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব নীতি গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তেমন যোগসূত্র নেই। যেমন ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধের বিষয়টি মূলত অভ্যন্তরীণ। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো যোগ নেই। আবার অভ্যন্তরীণ কারণেই সীমান্ত নিরাপদ রাখতে অভিবাসননীতি নেওয়া হয়েছে। কাজেই নতুন মার্কিন এসব নীতি ও পদক্ষেপের উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে লক্ষ্যে রেখে বা বাংলাদেশের জন্য নয়।
ট্রাম্পের জমানায় বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেমন হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে জন এফ ডেনিলোভিচ বলেন, বিষয়টি বলার মতো সময় এখনো আসেনি। আর যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার সবকিছুই প্রেসিডেন্টের হাতে নয়। কংগ্রেসসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে।
সাবেক এই মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত আরও বলেন, বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অনেক অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সমালোচনাগুলোকেও সত্য দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। মিথ্যাকে মিথ্যা দিয়ে নয়, সত্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।
‘ডিপ স্টেট’–সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে জন এফ ডেনিলোভিচ বলেন, রাষ্ট্রীয় নীতি নিয়ে কাজ করার জন্য যদি বিভিন্ন পদ্ধতি নেওয়া হয়, সেটা ডিপ স্টেট নয়, সেটা রাষ্ট্রের নীতি। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশে অনেক অপতথ্য আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা নাকচ করে দিয়েছেন—দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি ভালো ইঙ্গিত। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।
হুমায়ুন কবীর বলেন, এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক চ্যারিটি (দান–খয়রাত) নয়। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন—সব দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। সম্পর্ক আরও উন্নত হলে দুই দেশ থেকেই বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ আসবে। গণতান্ত্রিক দুর্বলতায় এত দিন যা কাজে আসেনি। গণতান্ত্রিক ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মার্কিন উদ্যোক্তাদের আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের জন্য অন্যান্য সহযোগিতার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তাও প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ এম শাহান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এতে এই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সহজ হবে। স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনই শেষ কথা নয়। যদি একটা নির্বাচনকেই লক্ষ্য ধরা হয়, তাহলে কোনো দিন গণতন্ত্র সুসংহত হবে না। সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনসহ সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা, সংস্কার, উন্নয়ন ও ব্যবসা–বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি।