সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ। ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও পতিত আওয়ামী শক্তির উসকানি এবং হামলার ভয় এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িসহ সারা দেশে ভাঙচুরের ঘটনা আমরা দেখলাম। এতে পরিস্থিতি আবারও মারমুখী পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। গাজীপুরে হামলা ও গুলিবিদ্ধের ঘটনা ঘটেছে।

সবকিছু মিলিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডে অনেকে সমালোচনামুখর। এ সবকিছুর মধ্যে সরকার আমাদের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার করতে পারবে কি না? নাকি দ্রুত নির্বাচন দিয়ে চলে যাবে, সেটাই এখন মানুষের প্রশ্ন।

বর্তমান অবস্থায় সব থেকে বেশি নজরে পড়ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা। যেখানে এই অভ্যুত্থানের পর তাঁর ভূমিকাই সব থেকে বেশি হওয়া উচিত ছিল, সেটি কতটা করছেন তিনি? অবশ্যই মানতেই হয় শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপনে তিনি সফল ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি হতাশ করেছেন বলতেই হবে।

পলাতক এক সাবেক আইজিপিই বলছেন, এই পুলিশ বাহিনীতে ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগ করে। তাহলে এমন বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আসলে কী করছেন? পোশাক বদলের সিদ্ধান্ত মাঝখান থেকে মানুষের হাসির উদ্রেক ঘটিয়েছে। দেশে ছিনতাই ডাকাতি বেড়েছে, রাতে ট্রাফিক পুলিশ থাকে না, পতিত শক্তি ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে, প্রতিদিন নতুন নতুন আন্দোলন হচ্ছে—এর মধ্যে উনি যদি কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না নিতে পারেন, এই সরকার ব্যর্থ হতে বাধ্য।

এই সরকারকে ব্যর্থ করছে তার বিশাল আমলাতন্ত্র। আগস্টের পর এই সনাতনী আমলা সিস্টেম ভেঙে দেওয়ার খুব ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু সরকারের ধীরে চলো নীতির ফলে আমলারা নিজেরা জোট বাঁধতে পেরেছে, এবং তারা বাস্তবিকই ‘বাঙালিকে হাইকোর্ট’ দেখিয়ে কাজ আটকে রাখছে। ফলাফল আমরা দেখতে পাই, আহত আন্দোলনকারীদের সুচিকিৎসা পেতে বিলম্ব হচ্ছে। তাদের নিজেদের মহার্ঘ ভাতা, পদোন্নতি, বিদেশ ভ্রমণ, বয়স বৃদ্ধির ফাইল দ্রুত এগোলেও বাকি ফাইলগুলা কেন নড়ে না—এটা গবেষণার বিষয়। সময়ের কাজ এখনো না করার ফল পাচ্ছে সারা দেশ, সঙ্গে সরকার ও।

বিচার কার্যক্রম নিয়ে তো শুরু থেকেই প্রশ্ন আছে। মামলা, তদন্ত, গ্রেপ্তার, জামিন—প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন কৌশলে পতিত শক্তির কয়েক শ অপরাধী জামিন নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। যাদের অনেকেই নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, যারা জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে নতুন করে আবারও হুমকির কারণ হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়টি এখানে জরুরি হয়ে পড়েছে।

এদিকে যৌথ অভিযানে যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখলাম। বেশ কয়েকজন এমন মৃত্যুর শিকার হলো গত ছয় মাসে। এদিকে গুম কমিশন থেকে বলা হয়েছে, তারা আয়নাঘর পরিদর্শনে সহায়তা পাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিক নিয়ে আয়নাঘর দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। আয়নাঘরের যে ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা রং করে, নতুন টাইলস বসানো। কাদের বাঁচানোর জন্য এই চিহ্ন লুকানোর প্রচেষ্টা? পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়েও গড়িমসি আমরা দেখেছি। পরে একটা কমিশন গঠন করা হলো।

আরও পড়ুনঅভ্যুত্থানের ৬ মাস: কী করা উচিত, কী করছি০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এই সব তো গেল সরকারের ভেতরের স্তম্ভগুলার অবস্থা। মানুষ কী চায়? প্রথম চাওয়া—চাকরি। এই ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ কী? এই চাকরির জন্যই কিন্তু আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বেসরকারি খাত স্থবির হয়ে যাওয়াতে ওই দিকে খুব আশা দেখা যাচ্ছে না। অদক্ষতার জন্য অনেকে চাহিদামতো প্রার্থীও পাচ্ছে না। এই দেশ শুধু অদক্ষ শ্রমিক বানান না, অদক্ষ স্নাতক বানানোতেও বিশ্বে শীর্ষে। দেশ থেকে অবৈধ বিদেশি বিতাড়নের কথা শোনা গেলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি। এদিকে সরকারের অন্তত ২০ শতাংশ পরিচালনা ব্যয় কমানো উচিত। যেখানে তাদের উচিত নিজেদের মাথাভারী কর্মচারী কমানো সেখানে তারা কীভাবে নতুন লোক নিয়োগ করবে?

এদিকে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমলেও পেটে লাথি পড়েছে কৃষকের। এনবিআর নিজের অদক্ষতা ঢাকতে সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। মানুষের দাবির মুখে কিছু কিছু ভ্যাট কমালে তা আসলে সরকারের নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

এদিকে ইতিমধ্যেই ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ যাওয়া শুরু হয়েছে। শিল্পাঞ্চলগুলা এখনো নিরাপত্তাহীনতাতে আছে। চাঁদাবাজি বাড়ছে।  পতিত শক্তির পালিয়ে যাওয়া এমপি-মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গিয়েছে। কারখানাগুলোর ব্যাপারে সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত এখনো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ইউএসএইড বন্ধ হওয়াসহ দেশে এক বিশাল নতুন বেকারত্ব সমস্যা সামনের দিনগুলাতে আমাদের সামলাতে হবে। আর এই আমলা এবং পুলিশ দিয়ে সরকার সামলাতে পারবে কিনা, এই ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

এদিকে এই সরকারের সব থেকে বড় শক্তি সব রাজনৈতিক দল এখনো তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এক চাওয়া দ্রুত নির্বাচন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জনপরিসরে নাগরিক সমস্যা সমাধানের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার চর্চা প্রায় হারিয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে আমরা মানুষের চাহিদাগুলো নিয়ে কথা শুনতে চাই। আগের সেই ‘রিয়েক্টিভ’ দৃষ্টিভঙ্গির বদলে ‘প্রো অ্যাকটিভ’ দৃষ্টিভঙ্গি এখন খুব দরকার। তারা আমাদের কথা না বললে কে বলবে?

সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তাদের প্রস্তাবিত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে। আর প্রয়োজনীয় সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে। আইন উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ৫০ শতাংশ এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে।

সংবিধান সংস্কার এবং নির্বাচন সংস্কারের সুপারিশগুলা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলদের ও বুঝতে হবে তারা যদি সংস্কারে সহায়তা না দেয়, তাহলে তারা মানুষের আস্থার জায়গাটা পাবে না।

এই উপদেষ্টা পরিষদের মাত্র অল্প কয়েকজনই তরুণ। অথচ তরুণদের নেতৃত্বে একটি গণ–অভ্যুত্থানের পর গঠিত এ সরকারের বেশিরভাগ সদস্য হওয়া উচিত ছিল অপেক্ষাকৃত তরুণ। এখন উপদেষ্টা পরিষদে এমন অনেক সদস্য আছেন, যাদের সময়কার সামাজিক কাঠামো এখন দেশে আর নেই। তাঁদের সেই উদ্যোমও নেই যে সব বাধা ভেঙে ফেলে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। জনগণ ও বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব অনেক।

এরপরেও তাঁদের আকাঙ্ক্ষা বা আমাদের চাওয়াতে কোনো খাদ নেই। তাই এই সরকারকে সফল করতে হলে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, অ্যাকটিভিস্টসহ জনগণের সব অংশীজনদের নিজেদের দলাদলি ভুলে শুধু দেশের স্বার্থে জুলাইয়ের মতো এক হতে পারলেই শুধু এখান থেকে সফলতা সম্ভব। নতুন বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই এই সরকারকে ব্যর্থ করতে দেওয়া যাবে না।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট

ই-মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র উপদ ষ ট র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল

সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের আয়কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুদানেও কর সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।

সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সুবিধা দুটি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আয়কর আইন ২০২৩ এর ৭৬ ধারা উপ-ধারা (৩) এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সুবিধাদুটি বাতিল করা হলো। এই অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন কার্যকর হবে।

গত বছরের নভেম্বরে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর গত ২৯ জানুয়ারি ধানমন্ডিতে ফাউন্ডেশনের কয়েকটি ঠিকানায় অভিযান চালায় দুদক। তবে এসব ঠিকানায় সূচনা ফাউন্ডেশনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে জানায় দুদক।

পুতুল বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। পুতুলের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়েছে। যার মধ্যে দুদক একটি মামলা দায়ের করেছে ‘তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে পূর্বাচলে পুতুলের নামে প্লট বরাদ্দের অভিযোগে।

দুদক বলছে, পুতুল সূচনা ফাউন্ডেশন নামের প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে ‘জোরপূর্বক উপঢৌকন নেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। পুতুল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে ফাউন্ডেশনের নামে পাওয়া অর্থ করমুক্ত করিয়ে নেন, যাতে সরকারের বিপুল অর্থের ক্ষতি হয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠা সূচনা ফাউন্ডেশন মানসিক প্রতিবন্ধিতা, স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতা, অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে। সায়মা ওয়াজেদ এটির প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ছিলেন।

বিএইচ

সম্পর্কিত নিবন্ধ