মেডলিং, ডিপফেক, গুজব ও অপতথ্যের সুনামি ঠেকাবেন কী করে
Published: 9th, February 2025 GMT
এক.
এ বছরের জানুয়ারির ২৮ তারিখে, কানাডার মানুষ এক আজব তথ্য জেনে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। কানাডার মতো দেশের ২০২১ সালের নির্বাচনে গভীর গোপন কায়দায় জোরদার হস্তক্ষেপ করেছে ভারত ও চীন। অবাক হওয়ার আরও বড় কারণ, পাকিস্তানও পিছিয়ে থাকেনি। অথচ দেশটি নিজেই একটি ভাঙাচোরা রাষ্ট্র।
মার্কিন এবং ইউরোপীয় কোনো কোনো দেশের বেসরকারি গোয়েন্দা কার্যক্রমও হয়তো ব্যাপকভাবেই ছিল, তদন্ত কমিটি কৌশলগত কারণে হয়তো প্রচার করছে না—এ রকম কানাঘুষাও চলছে কানাডার ঘরোয়া আড্ডায়, পাব-রেস্তোঁরায়।
নির্বাচনে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ টের পেয়ে কানাডা সরকার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করে। বিচারপতি ম্যারি-জোসি হ্যোগের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা টানা ১৬ মাস প্রায় ১০০ জন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, কানাডার অত্যন্ত সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার কারণে বাইরের শক্তিগুলোর জোরদার নাক গলানোও অবশ্য বিশেষ কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ‘মেডলিং’–চেষ্টাগুলোর বেশির ভাগই ছিল তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। কানাডার শক্তিশালী তথ্য-নিরাপত্তাবলয় নির্বাচনটিকে বড়সড় সুরক্ষা দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও চীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অস্বীকার করেছে অভিযোগ। পাকিস্তান এখনো কোনো মন্তব্য করেছে বলে শোনা যায়নি। কিন্তু কানাডাবাসী অভিযুক্ত দেশগুলোর ‘অস্বীকার’কে বিশ্বাস না করে গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকেই বিশ্বাস করছে। কারণ দুটি—এক.
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা স্ক্যান্ডালটি অনেকেরই মনে থাকার কথা। ২০১৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমস কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনের ভাষ্য—ব্রিটেনের ‘বিগ ডেটা’ প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তথ্য বিশ্লেষণী সংস্থার আড়ালে আসলে একটি অত্যাধুনিক হাইটেক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৯ কোটি ভোটারের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করেছে নির্বাচনে জয়ে–ইচ্ছুকদের কাছে। সংখ্যাটি শুধুই প্রমাণিত সংখ্যা। আড়ালে আসল সংখ্যা আরও কয় শ কোটি, কে জানে!
কারণ, সংখ্যাটি শুধু ফেসবুকের পৌনে তিন লাখ ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টের বরাতে পাওয়া। উদাহরণস্বরূপ বিষয়টি এ রকম—আমার ফেসবুক পেজ হ্যাক করে আমি কাকে ভোট দিতে পারি, কার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা করতে পারি—এ ধরনের তথ্য তো নিয়েছেই, আমার বন্ধুতালিকা থেকে আরও এক হাজার ভোটারের রাজনৈতিক দুর্বলতার সব তথ্য নিয়ে নিয়েছে। তারপর সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করেছে নির্বাচনী অপরাধীদের কাছে। ফেসবুকের বাইরে আরও অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আরও কত অপকর্ম করেছে, কে জানে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে একই রকম প্রতিবেদন প্রকাশ পায় দ্য অবজারভার পত্রিকায়। দ্রুতই গভীর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নামে চ্যানেল ফোর টেলিভিশন। প্রমাণিত হয়, অভিযোগগুলো সত্য তো অবশ্যই, আরও গুরুতর বিপদের কারণও বটে। সংস্থাটির কর্ণধারেরা ব্রিটেনের রাজপরিবারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রাখত। আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারের রাঘববোয়াল, অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর বড় বড় কূটনীতিক, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও শীর্ষ নির্বাচনী রাষ্ট্র সংস্থার সঙ্গেও সংযুক্ত থাকত। পরামর্শকের কাজও করত। হানি-ট্র্যাপ, মানি-ট্র্যাপ, সব রকমের অপকর্মে জড়িত ছিল।
প্রতিপক্ষ প্রার্থীর যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিত কার পেছনে নারী লেলিয়ে দিতে হবে, কাকে টাকায় কিনে নিতে হবে, কাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি অপকর্মের পথঘাটই দেখিয়ে দিত। প্রয়োজনে অতথ্য, অপতথ্য, বানোয়াট তথ্য ও গুজব-বিভ্রান্তির ছকও কষে দিত।
আরও বিপজ্জনক সত্য হয়ে দেখা দিল যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল দলে তহবিলদাতা সাত থেকে আটজন ধনকুবেরের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকায় কয়েক শ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। হোয়াইট হাউসের চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট হওয়ার কারণে ২০১৭ সালে স্টিভ ব্যানন বাধ্য হয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোল।
দেখা গেল, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন, সিনেট নির্বাচন ও প্রাদেশিক নির্বাচন মিলিয়ে ৪৪টি ভোটাভুটিতে প্রভাব বিস্তারের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে তিন বছরব্যাপী তদন্ত চলে, ২০১৬ সালে ‘ব্রেক্সিট’ গণভোটের ভোটাভুটিতে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ভূমিকা আছে কি না। প্রমাণ মিলেছে, রাশিয়ার কাছে সংস্থাটি ইউরোপীয় ভোটারদের তথ্য বিক্রি করেছে। তবে রাশিয়া সেগুলো ব্রেক্সিট গণভোটে প্রভাব বিস্তারের কাজে লাগাতে পারেনি বলে রক্ষা।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো নিঃসন্দেহে দুনিয়াময় অনুসন্ধান চালায়নি। ছিটেফোঁটা যেটুকু চালিয়েছে, তাতেই নমুনা মিলেছে, ভারত, কেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, মেক্সিকো, মাল্টা, ব্রাজিল, কলম্বিয়াসহ আরও অনেক দেশেই ধনকুবের নির্বাচনপ্রার্থীরা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা থেকে তথ্য কিনেছেন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা বিনষ্ট করেছেন। আইন-আদালত ও আন্তর্জাতিক হইহল্লার চাপে ফেলে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা রাশ টেনে ধরা গেছে বটে; কিন্তু দুনিয়াজুড়ে আরও হাজার হাজার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা যে আরও চতুরতার সঙ্গে অধরা থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে না, সে নিশ্চয়তা কি আছে?
দুই.কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্য চুরির অসংখ্য পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম কার্যকর অস্ত্রটি ছিল একেবারেই নিরীহদর্শন ছোট একটি মনোবৈজ্ঞানিক জরিপ। ফেসবুকে আমরা অহরহই দেখি, ‘পরীক্ষা করুন, আপনি মানুষটি কেমন’, ‘দেখুন, কে আপনাকে বেশি ভালোবাসে’, ‘কোন হলিউড নায়ক-নায়িকার সঙ্গে আপনার মিল’ ইত্যাদি। এসব সাইকোগ্রাফি অ্যাপ বা জরিপ স্বভাবতই আকর্ষণীয়। নিজেকে চেনার অদম্য কৌতূহল জাগায় অনায়াসেই।
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর নিজে নিজেই টাইমলাইনে পোস্ট হয় ‘আমার সঙ্গে আইনস্টাইনের মিল। পরীক্ষা করুন আপনার সঙ্গে কার মিল’। এভাবে একজন থেকে বন্ধুতালিকার এক শ জন, এক শ জন থেকে হাজারজন হয়ে লাখো কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নেয় চতুর অ্যাপগুলো।
অ্যাপগুলোর বিপদ সম্পর্কে সতর্কতা বাড়লে কী হবে, আমরা পড়ছি ডোবা থেকে তথ্যের সমুদ্রে। বাস করছি তথ্য সঞ্চালনা ও তথ্যপ্রযুক্তির হিমালয় সমান উৎকর্ষের কালে। এই উৎকর্ষে আমাদের লাভের যেমন কমতি নেই, বিপদেরও কমতি নেই।
দুনিয়াময় বিপদগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে টের পাওয়া যাচ্ছে ক্যানসারের চেয়েও বিধ্বংসী, কোভিডের চেয়েও বড়সড় তথ্য-মহামারির প্রাদুর্ভাব। মাহামারির রূপ নিচ্ছে ‘ডিজইনফরমেশন’ ‘মিসইনফরমেশন’—‘বানোয়াট তথ্য’, অপতথ্য, ‘অতথ্য’, ভুল তথ্য। সঙ্গে বাহারি গুজব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘ডিপফেক’ দেখে আসল-নকল চিনতে পাকা জহুরিও ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশে ব্যক্তিপর্যায়ে বা সামষ্টিক পর্যায়ে তথ্য ব্যবস্থাপনা নেই-ই বলা চলে।
দুটি কারণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনটি হবে ইতিহাসের জটিলতম নির্বাচন। এক. বাইরের এক বা একাধিক দেশের সংগোপন সক্রিয়তা। দুই. অপতথ্যের সুনামি। পাচার হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লগ্নি হতে পারে গুজব, অতথ্য, অপতথ্য, তথ্যবিকৃতি, ভয়ভীতি ও বিভ্রান্তির সুনামি ঘটাতে।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার আদলে অসংখ্য অপতথ্য সংক্রমণকেন্দ্র হয়তো কাজকর্মও শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও তথ্য অধিদপ্তর বিষয়গুলো আদৌ ভেবেছে কি? একটি শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র নির্বাচনী তথ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল চূড়ান্ত না করতে পারলে আগামী নির্বাচনটি শান্তির বদলে বিভীষিকা বয়ে আনতে পারে।
● হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অপতথ য ন ত কম ফ সব ক
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি বছরে ডিএনসিসি এলাকায় ৫ লাখ গাছ লাগানো হবে: ডিএনসিসি প্রশাসক
চলতি বছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ৫ লাখ গাছ লাগানো হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা'য় ‘পরিবেশ বাঁচাও’ শিরোনামে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মো. আবু সেলিমের একক চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, ‘ডিএনসিসি এলাকার সব রাস্তা, ফুটপাত, মিডিয়ান ও সব পাবলিক স্পেসে আমরা বৃক্ষরোপণ শুরু করেছি। এই বছর আমরা ৫ লাখ বৃক্ষরোপণ করবো। এই বৃক্ষরোপণে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হবে, পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে এমন সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা প্রতিদিন ময়লা পরিষ্কার করছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলো ঢাকার রাস্তায়, ফুটপাতে, মাঠে, পার্কে, খালে, ড্রেনে প্রতিটি জায়গায় এতো বেশি ময়লা, যা সংগ্রহ করতে করতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা টায়ার্ড হয়ে যায়। মানুষ ঢাকা শহরে নির্বিচারে যত্রতত্র ময়লা ফেলে দেয়। পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে হলে যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। আমাদের সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদেরও আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার কাজ করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি।’
মোহাম্সদ এজাজ বলেন, ‘অনেক জায়গায় দেখা যায় ময়লা এসটিএসে (সেকেন ট্রান্সফার স্টেশন) না ফেলে খালে, বিলে ফেলে দিচ্ছে। অনেকে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ময়লা ফেলে দিচ্ছে। এর ফলে শহর নোংরা হচ্ছে, আমরা নিজেরা নিজেদের বাড়িঘর নোংরা করছি পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছি। বাসাবাড়ির এসব ময়লা বিশেষ করে প্লাস্টিক, পলিথিনে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার জন্ম হয়৷ এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এগুলো বন্ধ করতে হবে, সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ঢাকা শহরে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান বড় অংকের মুনাফার জন্য পরিবেশের ক্ষতি করেছে। তাদের দখলেই গেছে খাল, বন। আমরা গত সরকারের আমলে প্রাণ বিনাশী উন্নয়ন দেখেছি। আমাদের লেখক, শিল্পী, সাংস্কৃতিকদের প্রাণ বিনাশী ক্ষতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এমন কোন উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না যে প্রকল্প মানুষের জীবন বিপন্ন করে, প্রাণ বিপন্ন করে, নদী বিনষ্ট করে, বাতাস দূষিত করে।’
পরে ডিএনসিসি প্রশাসক চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন এবং অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন।