‘শাহজালালের তালোয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগানের তালে ভাঙা হয় কৃষাণচত্বর
Published: 9th, February 2025 GMT
তিন বছর ধরে তিন রাস্তার মোড়ে হাতে কাস্তে ও কাঁধে লাঙল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক কৃষক। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কৃষাণচত্বর’। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন্দ পয়েন্টে প্রশাসনের উদ্যোগে এটি নির্মাণ করা হয়। তবে সেই কৃষকের ভাস্কর্যটি এখন মুখথুবড়ে পড়ে আছে। গত শুক্রবার ‘শাহজালালের তালোয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগানের তালে হাতুড়ি দিয়ে ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া উপজেলা সদরে প্রবেশমুখের সড়কঘেঁষে নির্মিত শিশুপার্কের আউটডোরে ঘোড়া, হরিণ, জিরাফ, টম অ্যান্ড জেরি, মিখি মাউসও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
গ্রামীণ ঐতিহ্য, কৃষি ও কৃষকের ঐতিহ্য তুলে ধরতে এবং শিশুদের বিনোদনের জন্য সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে নির্মাণ করা হয়েছিল এসব ভাস্কর্য। চলতি পথে মানুষ সেখানে বিশ্রাম নিতেন, ছবি তুলতেন। কিন্তু রাতের অন্ধকারে এই ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বললেন, কয়েকজন হাতুড়ি দিয়ে ভাস্কর্যটি ভাঙার সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় তারা ‘শাহজালালের তালোয়ার গর্জে উঠুক আরেকবারসহ’ ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী নানা স্লোগান দেয়।
চালবন্দ পয়েন্টের মোটরসাইকেল মিস্ত্রি মো.
চালবন্দ গ্রামের রিকশাচালক জাহের মিয়া বলেন, ‘ভেঙে ফেলায় আমাদের খারাপ লেগেছে। এটা তো দলের কিছু নয়।’
চালবন্দ গ্রামের মদন মিয়া বলেন, এটা ভাঙা ঠিক হয়নি। আমাদের এলাকার মানুষ দেখেনি, তারা রাত একটা দেড়টার দিকে ভেঙেছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বিএনপির নেতা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিউর রহিম জাদিদ পেশাজীবীদের উজ্জীবিত করা এবং পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য কিছু স্থাপনা করেছিলেন। এরমধ্যে ছিল করচার হাওরের একপাশে উপজেলা সদরের কাছাকাছি স্থানে হাওরবিলাস, হাওরভিউ ক্যাফে, সীমান্ত এলাকায় মেঘালয় পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে পাহাড়বিলাস, চালবন্দ পয়েন্টে কৃষাণচত্বর, পলাশ বাজারে হাওরবৃত্ত, ওয়ারওয়ে, কারেন্টের বাজারে বোয়ালচত্বর, উপজেলা পরিষদের পাশে শিশুপার্কসহ মাল্টিপারপাস সেন্টার, হাসপাতালের সামনের ম্যাপ ফোয়ারা ও ট্যারাকোটা, চিনাকান্দি বাজার মুক্তিযোদ্ধা উদ্যান, বাঘমারা বাজার ওয়ারওয়ে নির্মাণ করেছিলেন। এসব উদ্যোগে নান্দনিকতা বাড়ে বিশ্বম্ভরপুরের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পর্যটকেরা এখানেও কিছু সময় কাটাতেন, ছবি তুলতেন। কৃষকরা এই পথ দিয়ে যেতে উৎসাহিত হতেন, নিজেদের সম্মানিত বোধ করতেন। এগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সূত্র আছে বলে মনে করছি না আমি। এগুলো ভাঙা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মফিজুর রহমান বলেন, উপজেলা পরিষদের সভায় কৃষাণ চত্বরসহ অন্যান্য যে সব স্থাপনা বা ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, এ বিষয়ে আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। যেগুলো মেরামত সম্ভব, সেগুলো মেরামত করতে কীভাবে অর্থ পাওয়া যায় সে চেষ্টাও করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ ভ স কর য ভ স কর য চ লবন দ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় রান্নার শিল্প
অধ্যাপক আবু বকর আল-সুলী (৩৩৯ হিজরি, ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর আদাব আল-কাতিব গ্রন্থে এক আরব আর এক পার্সির ঝগড়ার গল্প বলেছেন। পারসি লোকটি আরবকে বলছিল, ‘আমরা কখনো আপনাদের সাহায্য ছাড়া কিছু করিনি। আপনাদের রান্না, পানীয় আর শাসন ব্যবস্থাও একইভাবে রেখেছি। কিছুই বদলাইনি। এভাবে তো চলে না।’ আরব উত্তরে জানাল, ‘ধৈর্য ধরুন, এক হাজার বছর শাসন করার পর কিছু পরিবর্তন নিশ্চয় আনব, তখন আপনার সমস্যা হবে না।’
এই ধরনের বিতর্ক তখনকার সময়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মিলনের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। একই সঙ্গে তা রান্নার শিল্প কীভাবে সভ্যতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, তা-ও চিত্রায়িত করে।
আদি খাদ্যসংস্কৃতি
আরবরা আদিতে এমন একটি পরিবেশে বাস করত, যেখানে খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সীমিত। তখন তাদের প্রধান খাবার ছিল সারিদ। সারিদ ছিল এক ধরনের পিঠা, মাংসের স্যুপে ভিজিয়ে খাওয়া হতো। আর ছিল শাওয়া বা পোড়ানো মাংস। তাদের জীবনযাত্রায় এই খাদ্যগুলো ছিল সাধারণ ও সহজলভ্য। এ ধরনের খাবারকে ‘ফাঈলাহ’ বা ‘অসাধারণ’ নামে ডাকা হতো। আবু মনসুর আল-সিয়ালবি তাঁর ফিকহ আল-লুগা গ্রন্থে আরও তিনটি ‘ফাঈলাহ’ খাবারের সন্ধান দিয়েছেন, যেমন সাখিনাহ নামে মাংসের স্যুপ, আসিদাহ নামে এক ধরনের পরিজ ও হরিরাহ নামে এক ধরনের ঝোলের তরকারি।
তীব্র খরা হলে আরবদের অনাহারে কাটাতে হতো। তাই তারা সে-সময় খাবার হিসেবে যে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে প্রস্তুত ছিল। এমনকি গৃহপালিত প্রাণীও ছিল তাদের খাদ্য তালিকায়।
আরও পড়ুনরাগ সংবরণ করার উপায় নিয়ে মহানবী (সা.)–এর পরামর্শ২১ জানুয়ারি ২০২৫মুসলিম বিজয়ের পর
ইসলামি যুগে, বিশেষত উমাইয়া ও আব্বাসি শাসনামলে আরবরা রোমান ও ফারসি সভ্যতার রন্ধন কৌশল গ্রহণ করে এবং এর সঙ্গে তাদের নিজস্ব রান্নার ধরন বিকশিত করে। মুসলিম বিজয়ের ফলে বিশেষত শাম ও ইরাক অঞ্চলে খাবার সংস্কৃতি ও রান্নার পদ্ধতিতে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন অঞ্চল আওতায় এলে মুসলিমরা সেখানকার উপাদান ও রান্নার পদ্ধতি গ্রহণ করত, ফলে তাদের খাবারের সংস্কৃতি এবং রান্নার পদ্ধতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
তবে মুসলিমরা শুধুমাত্র বিদেশি সংস্কৃতির নকল করেনি, বরং তারা নতুন নতুন রান্নার প্রকরণ তৈরি করতে শুরু করে। তারা খাবারে তখন স্বাস্থ্য, শক্তি ও পুষ্টির দিকটি বিবেচনায় রাখত। শাসন ব্যবস্থা ও খাবারের প্রভাব ছিল একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মুসলিমদের রচিত বিভিন্ন রান্নার বইয়ে আমরা দেখি, যেসব মসলার ব্যবহার করা হতো, তাতে বিভিন্ন উপাদান এবং প্রক্রিয়ার বিবরণে অনেক বেশি বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আসে।
আব্বাসি যুগের উদ্ভাবন
আব্বাসি আমলে রান্নার শৈলী আরও উন্নত ও উদ্ভাবনী হয়ে ওঠে। খাবার তখন প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক ও আর্থিক পরিসরে জড়িয়ে পড়ে। মুসলমানরা খাবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় নেমে পড়ে। খাদ্যের উপকারিতা ও ক্ষতি এবং সঠিক রান্নার পদ্ধতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়, এমনকি নতুন নতুন রেসিপি ও নিয়মকানুন সামনে চলে আসে।
এই সময়ে মুসলিমরা খাবারের মান নিয়ন্ত্রণেও সচেতন ছিল। হিসবা (ভোক্তা সুরক্ষা) ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা খাবারের গুণগত মান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মাবলি প্রণয়ন করে। খাবারের নিরাপত্তা ও সততা বজায় রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রোগ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের জন্য নির্দিষ্ট মাংস রান্নার পরামর্শ থাকত। যেমন গরু, উট ও ছাগলের মাংস একসঙ্গে না মেশানো, যাতে পুনরায় কেউ অসুস্থ না হন।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাবারের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং এর ফলস্বরূপ শরাহ (অতি খাওয়া) প্রবণতা দেখা দেয়।
আরও পড়ুনমন্দ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের উপায়০৬ এপ্রিল ২০২৫খাদ্যরসিক মাওইয়া
কামালুদ্দিন আল-দামিরি (৮০৮ হিজরি, ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর হায়াতুল হাইওয়ান গ্রন্থে একটি পরিবর্তন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘উমাইয়া যুগে খাবারের প্রতি এই আগ্রহ প্রথম দিকে ততটা ছিল না, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। প্রথম যে ব্যক্তি ফারসি সংস্কৃতির অনুকরণ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি মাওইয়া ইবনে আবু সাফিয়ান। তিনি খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন বিলাসিতার সূচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্যা খলিফারাও এই রীতি অনুসরণ করে।’
আল-মাসউদি (৩৪৬ হিজরি, ৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) মুরুজ আল-যাহাব গ্রন্থে মাওইয়ার খাদ্যাভ্যাসের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লেখেন, ‘মাওইয়া দিনে পাঁচবার খেতেন। শেষ খাবার ছিল সবচেয়ে ভারী, তারপর বলতেন, আরে, আমাকে ওঠাও। আমি মনমতো খেতে পারিনি। কিন্তু বিরক্ত হয়ে গেছি!’
ইমাম ইবনে কাসির (৭৭৪ হিজরি, ১৩৭২ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে মাওইয়ার পরিচিতসহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন দামেস্কের শাসক। দিনে সাতবার খেতেন। খাবারে প্রচুর মাংস ও মিষ্টি রাখতেন। এত খাওয়ার পরেও তিনি বলতেন, আমি কখনো পেটভরে খাই না, শুধু ক্লান্ত হয়ে যাই আর কি!’
মাওইয়ার এই অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা তাকে শারীরিক ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয় এবং তাকে স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে খাবারের উপাদান পর্যালোচনা করার জন্য ডাক্তার ডাকতে হয়। ডাক্তার তাকে কী খাবেন, কী খাবেন না, সে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু মাওইয়ার তা থোড়াই কেয়ার করতেন।
আরও পড়ুনবিপদগ্রস্তকে সাহায্য করার সওয়াব১০ ডিসেম্বর ২০২৪মুসলিম সমাজে রান্নার উন্নতি
রান্নার প্রসারে তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইসলামি শাসন এবং পূর্বতন পারস্য ও রোমান সংস্কৃতির মধ্যকার মেলবন্ধন। বিশেষত মুসলিম শাসকদের হেঁশেলে যে বিপুল ও বৈচিত্র্যময় রান্নার আবির্ভাব ঘটে, তা-ই মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতায় রন্ধনশিল্পকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করে।
উমাইয়া শাসক সুলেমান ইবনে আবদুল মালিক (৯৯ হিজরি, ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ) ও হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের (১২৫ হিজরি, ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) মতো বহু শাসক তাঁদের বিপুল খাদ্যাভ্যাসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। শামসুদ্দিন আল-যাহাবি সিয়ারু আলাম আন-নুবালা গ্রন্থে সুলেমান ইবনে আবদুল মালিকের অতিমাত্রায় খাবার গ্রহণের ইতিহাস উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘তিনি একবার ৪০টি মুরগি এবং ৭০টি আঙুর খেয়েছিলেন’।
আরও পড়ুনগায়েবি সাহায্য০৮ এপ্রিল ২০২৫