নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ছোট-বড় দুই শতাধিক সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। গতকাল শনিবার তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকার।

প্রতিবেদনে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলেছে, গত ১৫ বছরে দেশ যত সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, সেটার শুরু হয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার কারণে। নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে দায়বদ্ধতার কাঠামোও ভেঙে পড়েছে। এ কারণে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

সংস্কারের অগ্রাধিকার হিসেবে কমিশন ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো নির্বাচন কমিশন; সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন; প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন; সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; সংসদ নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; কার্যকর সংসদ; তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা; স্থানীয় সরকার নির্বাচন; রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন; সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ; জাতীয় পরিচয়পত্র; প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ; ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ; প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ভোটিংয়ের ব্যবস্থা এবং অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থা। 

এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠনপ্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং ইসিকে আরও ক্ষমতা দিতে বেশ কিছু আইন বিধিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। তারা ‘নির্বাচন কমিশন আইন’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তাবও করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনারদের জন্য একটি আচরণবিধিমালা এবং সংসদের সীমানা নির্ধারণ আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের বেশ কিছু জায়গায় সংশোধনী আনার কথা বলেছে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা, পর্যবেক্ষক নীতিমালা ও নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা প্রস্তাব করা হয়েছে। 

■ অগ্রাধিকার হিসেবে ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে।  ■ ফেরারি আসামিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা।  ■ ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন করা। ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা। 

ফেরারি আসামিদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গৃহীত হলে তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য করা এবং দলের পদে অযোগ্য করা, ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন করা, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের বিধান করার মতো সুপারিশ রেখেছে কমিশন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন স্থগিত, বাতিল এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষমতা আরও বাড়াতে আইনের সংশোধন, নির্বাচনের পরিবেশ নেই মনে করলে ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত রাখার বিধান, নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার জায়গা তৈরির কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন। 

‘টাকার খেলা’ বন্ধে সুপারিশ নেই যে কারণে

সংস্কার কমিশন বলেছে, টাকার খেলা রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করেছে। টাকা দিয়ে কেনা যায়-এমন গণতন্ত্র দেশে বিরাজ করছে। দৃশ্যমান নির্বাচনী ব্যয় নিরীক্ষণের সুপারিশ করা হলেও ‘অদৃশ্য’ নির্বাচনী ব্যয়, মনোনয়ন-বাণিজ্য ও ভোট কেনাবেচা বন্ধের ব্যাপারে কমিশন সুপারিশ রাখতে পারেনি। কমিশন মনে করে, এগুলো বন্ধ করা না–করা নির্ভর করবে রাজনীতিবিদদের এবং তাঁদের নৈতিকতাবোধের ওপর। 

গ্রহণযোগ্য নয় তিনটি নির্বাচন 

সংস্কার কমিশন বলেছে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সক্ষম নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করতে হলে এর গঠনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও কারসাজিমুক্ত করা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে বলা থাকলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত তা করা হয়নি। ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন করা হলেও ওই আইনের অধীনেও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের অধীন টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

২০১৪ সালের নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনেই প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এই দুই নির্বাচন নিয়ে সংস্কার কমিশন বলেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো একটি নির্বাচনব্যবস্থায় কোনো ভোট পড়ার আগেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ইতিহাস সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই। অন্যদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনকে একেবারে নিজের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘রাতের ভোট’-এর তকমা পাওয়া ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির নজির তৈরি হয়েছিল, সেটাও সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। 

২০২৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত ও তাদের দলের পৃষ্ঠপোষকতায় দাঁড়ানো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। যাকে অনেকে ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেন। 

শেখ হাসিনা সরকারের অধীন এই তিনটি নির্বাচনকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যায় না বলে সংস্কার কমিশন মনে করে।

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্কারের সার্থকতা তার বাস্তবায়নে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন নির্ভর করবে চারটি পক্ষের ওপর—অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও জনগণ। এর মধ্যে প্রস্তাবগুলো কত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, সেটা নির্ভর করতে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহের ওপর।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই ব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে তাঁরা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন। এগুলোতে দ্বিমত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় বলে কমিশন মনে করে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য ক ত কর আইন র সরক র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সিরাজগঞ্জে মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি স্থগিত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিরাজগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে মহাসড়কের পর রেলপথও অবরোধ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। এতে ট্রেনসহ ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদ্য ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো আজ সোমবার বিকেল চারটায় যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে মহাসড়কের গোল চত্বর এলাকায় অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাঁরা সেতুর পশ্চিম পাড়ে সয়দাবাদ রেলস্টেশনে গিয়ে রেলপথও অবরোধ করেন।

এদিকে রাত ৮টার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ থেকে সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটি স্থগিতের কথা জানানো হয়। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যান।

ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার কথা নিশ্চিত করে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে যমুনা সেতুর পশ্চিম সয়দাবাদ রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনে শিক্ষার্থীরা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকামুখী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। এতে ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

যমুনা সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনারুল ইসলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন করছেন। আমরা তাঁদের বারবার অনুরোধ করছি। আমাদের অনুরোধে একটু সময় মহাসড়ক ছাড়লেও আবার তাঁরা মহাসড়কটি অবরোধ করেছেন। মহাসড়ক বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করায় দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।’

আরও পড়ুনবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি বাতিলের দাবিতে সিরাজগঞ্জে আবারও মহাসড়ক অবরোধ৩ ঘণ্টা আগে

সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে বাজার স্টেশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল উদ্দিন বলেন, ‘পদবঞ্চিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ রয়েছে। আমরা এর চাইতে কিছু বলতে পারছি না।’

গত শনিবার রাতে আগামী ছয় মাসের জন্য ২৮৪ সদস্যবিশিষ্ট সিরাজগঞ্জ জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এতে সজীব সরকারকে আহ্বায়ক, মেহেদী হাসানকে সদস্যসচিব, ইকবাল হোসেনকে মুখ্য সংগঠক ও টি এম মুশফিক সাদকে মুখপাত্র করা হয়। এর পর ওই কমিটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

আন্দোলনে প্রকৃত ত্যাগীদের স্থান না দেওয়ার অভিযোগ তুলে ওই কমিটি বাতিলের দাবি তুলেছে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরে সংবাদ সম্মেলন করে কমিটি বাতিলে ছয় ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় ‘জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্রসমাজ’। সেই সঙ্গে এই কমিটি প্রস্তুত করার জন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন তাঁরা। এ সময় উপস্থিত নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান পাওয়া ৩০ জন স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরে গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ঘণ্টাব্যাপী মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

কমিটি বাতিলের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়ায় আজ বিকেল চারটার দিকে আবারও মহাসড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ