নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের ফলে ভেঙে পড়ে দায়বদ্ধতার কাঠামো
Published: 9th, February 2025 GMT
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে ছোট-বড় দুই শতাধিক সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। গতকাল শনিবার তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকার।
প্রতিবেদনে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলেছে, গত ১৫ বছরে দেশ যত সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, সেটার শুরু হয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার কারণে। নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে দায়বদ্ধতার কাঠামোও ভেঙে পড়েছে। এ কারণে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।
সংস্কারের অগ্রাধিকার হিসেবে কমিশন ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো নির্বাচন কমিশন; সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন; প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন; সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; সংসদ নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; কার্যকর সংসদ; তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা; স্থানীয় সরকার নির্বাচন; রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন; সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ; জাতীয় পরিচয়পত্র; প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ; ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ; প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ভোটিংয়ের ব্যবস্থা এবং অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থা।
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠনপ্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং ইসিকে আরও ক্ষমতা দিতে বেশ কিছু আইন বিধিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। তারা ‘নির্বাচন কমিশন আইন’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তাবও করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনারদের জন্য একটি আচরণবিধিমালা এবং সংসদের সীমানা নির্ধারণ আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের বেশ কিছু জায়গায় সংশোধনী আনার কথা বলেছে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা, পর্যবেক্ষক নীতিমালা ও নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা প্রস্তাব করা হয়েছে।
■ অগ্রাধিকার হিসেবে ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। ■ ফেরারি আসামিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। ■ ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন করা। ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা।ফেরারি আসামিদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গৃহীত হলে তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য করা এবং দলের পদে অযোগ্য করা, ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন করা, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের বিধান করার মতো সুপারিশ রেখেছে কমিশন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন স্থগিত, বাতিল এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষমতা আরও বাড়াতে আইনের সংশোধন, নির্বাচনের পরিবেশ নেই মনে করলে ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত রাখার বিধান, নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার জায়গা তৈরির কথাও বলেছে সংস্কার কমিশন।
‘টাকার খেলা’ বন্ধে সুপারিশ নেই যে কারণেসংস্কার কমিশন বলেছে, টাকার খেলা রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করেছে। টাকা দিয়ে কেনা যায়-এমন গণতন্ত্র দেশে বিরাজ করছে। দৃশ্যমান নির্বাচনী ব্যয় নিরীক্ষণের সুপারিশ করা হলেও ‘অদৃশ্য’ নির্বাচনী ব্যয়, মনোনয়ন-বাণিজ্য ও ভোট কেনাবেচা বন্ধের ব্যাপারে কমিশন সুপারিশ রাখতে পারেনি। কমিশন মনে করে, এগুলো বন্ধ করা না–করা নির্ভর করবে রাজনীতিবিদদের এবং তাঁদের নৈতিকতাবোধের ওপর।
গ্রহণযোগ্য নয় তিনটি নির্বাচনসংস্কার কমিশন বলেছে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সক্ষম নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করতে হলে এর গঠনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও কারসাজিমুক্ত করা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে বলা থাকলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত তা করা হয়নি। ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন করা হলেও ওই আইনের অধীনেও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের অধীন টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনেই প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এই দুই নির্বাচন নিয়ে সংস্কার কমিশন বলেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো একটি নির্বাচনব্যবস্থায় কোনো ভোট পড়ার আগেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ইতিহাস সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই। অন্যদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনকে একেবারে নিজের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘রাতের ভোট’-এর তকমা পাওয়া ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির নজির তৈরি হয়েছিল, সেটাও সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
২০২৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত ও তাদের দলের পৃষ্ঠপোষকতায় দাঁড়ানো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। যাকে অনেকে ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের অধীন এই তিনটি নির্বাচনকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যায় না বলে সংস্কার কমিশন মনে করে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্কারের সার্থকতা তার বাস্তবায়নে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন নির্ভর করবে চারটি পক্ষের ওপর—অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও জনগণ। এর মধ্যে প্রস্তাবগুলো কত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, সেটা নির্ভর করতে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহের ওপর।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই ব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে তাঁরা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন। এগুলোতে দ্বিমত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় বলে কমিশন মনে করে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য ক ত কর আইন র সরক র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশু ধর্ষণসহ নারী নিপীড়ন, খুন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বুধবার সমাবেশ, মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এসব কর্মসূচি থেকে ধর্ষকদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম (এনজিসিএএফ)। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা এ দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার। সম্মাননা পাওয়া দুই কৃতী নারী হলেন– লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা এবং লেখক, সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির মাধ্যমে নারীর নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি। গতকাল এক বিবৃতিতে কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম ও আহ্বায়ক ডা. ফওজিয়া মোসলেম এ দাবি জানান।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পাহাড় ও সমতলে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে ‘ঢাকাস্থ আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দ’। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত সমাবেশে এই দাবি জানানো হয়। বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে এক আদিবাসী নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে এ আয়োজন করে সংগঠনটি।
শিশু ধর্ষণের দ্রুত বিচার, মাগুরা মেডিকেল কলেজ বাতিলের পাঁয়তারা বন্ধ করা, মব ভায়োলেন্স বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার দাবিতে মাগুরায় মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। গতকাল গণকমিটি মাগুরা জেলার উদ্যোগে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে গতকাল নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, নারী উন্নয়ন ফোরাম ও স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতি। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় ধর্ষণের প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও পথসভা করেছে গুরুদাসপুর যুব ব্লাড ডোনার অ্যাসোসিয়েশন।
সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে পটুয়াখালীতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও খুনের প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মানববন্ধন করেছে সোনারগাঁ নাগরিক সমাজ নামে একটি সামাজিক সংগঠন।
নোয়াখালীতে মানববন্ধন-সমাবেশ থেকে ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়ন সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত কর্মসূচিতে এই দাবি জানানো হয়। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। সকালে উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ চত্বরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি)