বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন: ঘোষণার ৫ থেকে ১০ দিনে আদেশ প্রকাশ করতে হবে
Published: 9th, February 2025 GMT
হাইকোর্ট বিভাগের কোনো মামলায় প্রাথমিক আদেশ (রুল) ঘোষণার সর্বোচ্চ পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তা প্রকাশ করতে হবে। আদেশ ঘোষণার ক্রম অনুসারে তা প্রকাশ করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিচারকের সইসহ। আর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ঘোষণার পর তা প্রকাশ করতে হবে সর্বোচ্চ ১০ কার্যদিবসের মধ্যে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন প্রস্তাব রয়েছে।
একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় ঘোষণার পর সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে তা প্রকাশ করতে হবে। কোনো বিচারক অবসরে যাওয়ার আগে তাঁর দেওয়া সব আদেশ ও রায় চূড়ান্ত করবেন এবং তাতে সই করবেন। উল্লেখিত সময়সীমা অনুসরণ না করা হলে সংশ্লিষ্ট বিচারককে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন ২০১১ সালের ১০ মে। খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে তখন বিচারাঙ্গনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
সংস্কার কমিশন বলেছে, রায় বা আদেশ স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা মানা হয় না। যার ফলে বিচারপ্রার্থী এবং তাঁদের আইনজীবীদের অনেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধিতে রায় ঘোষণার পর সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে তা স্বাক্ষর করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ ছাড়া মামলার আদেশ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও কোনো সময়সীমা উল্লেখ নেই। এ অবস্থায় কমিশন প্রস্তাব করেছে, ‘হাইকোর্ট রুলস’ সংশোধনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সময় রাখা প্রয়োজন।
■ প্রতিটি মামলায় রায় ও আদেশ উন্মুক্ত এজলাসে ঘোষণা করতে হবে। ■ বেঞ্চ পুনর্গঠন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। ■ জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের পদ সৃষ্টির সুপারিশ।সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় ঘোষণার পর সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে বিচারকের সইসহ তা প্রকাশ করতে হবে। কোনো বিচারক অবসরে যাওয়ার আগে (প্রয়োজনে বিচারকাজ থেকে বিরত থেকে) তাঁর দেওয়া সব আদেশ ও রায় চূড়ান্ত করবেন এবং তাতে সই করবেন। অবসর গ্রহণের পর বিচারক কোনো রায় বা আদেশে সই করবেন না। এই বিধান প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া সমীচীন বলে মনে করে কমিশন। আর আদেশ-রায় ঘোষণা ও তাতে সই করার বিষয়টি (উল্লেখিত সময় অনুযায়ী) অনুসরণ না করা হলে সংশ্লিষ্ট বিচারককে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গতকাল শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল গত বছরের ৩ অক্টোবর। ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যায়গুলোর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা; সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়; আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস; বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা; আদালত ব্যবস্থাপনা; বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘব; বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ; মামলাজট হ্রাস; মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ এবং বিচারাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ—এ রকম নানা বিষয় রয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামে একটি পরিচ্ছদ রয়েছে। এর ভূমিকায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০।
বেঞ্চ পুনর্গঠন বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নসংস্কার কমিশন বলেছে, সংবিধানের ১০৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ গঠন ও পুনর্গঠনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত। বেঞ্চ গঠনের বিষয়ে কিছু বিধান থাকলেও মূলত প্রধান বিচারপতি এককভাবে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। স্বচ্ছতা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ কোন কোন বিবেচ্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বেঞ্চ গঠন এবং পুনর্গঠন করা হবে, সে বিষয়ে বিচারক, আইনজীবী এবং বিচারপ্রার্থীদের একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক।
শুনানির জন্য মামলা প্রস্তুতে দেরি হওয়ার বিষয়টি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগে একটি নতুন মামলা দায়ের হওয়ার পর নোটিশ জারির ক্ষেত্রে অনেক দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। কারণ, নোটিশ জারির জন্য আদালতের নিজস্ব জনবলের অভাব রয়েছে। নোটিশ জারির দায়িত্ব একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার ভিত্তিতে ডাক বিভাগের ওপর সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করা যেতে পারে। কোনো নোটিশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে জারির পর সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে তা ফেরত আসার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হলে একটি মামলা ওই সময়ের পর শুনানির জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া অনলাইনে মেনশন স্লিপ (নতুন মামলা) গ্রহণের ব্যবস্থার প্রচলন করা হলে কার্যতালিকায় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সহজবোধ্য বাংলা ভাষায় আদালত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ম্যানুয়াল (নির্দেশিকা) তৈরি করে তা সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে; যাতে বিচারক, আইনজীবী, আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিচারপ্রার্থীরা নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন।
অধস্তন আদালত প্রসঙ্গসংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘অধস্তন আদালত ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এর ভূমিকায় বলা হয়, অধস্তন আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন প্রায় ৪৩ লাখ মামলার অধিকাংশ (প্রায় ৩৮ লাখ) নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারপ্রার্থীদের মামলার ফলাফল জানার অধিকার রয়েছে। সে জন্য সিদ্ধান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল ‘কজলিস্টে’ (আদালতের কার্যতালিকা) মামলার ফলাফল উল্লেখ করার পাশাপাশি এবং তা জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। রায় বা আদেশের পিডিএফ কপি সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে (যেদিন সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে) ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে।
সুপারিশে কমিশন বলেছে, প্রতিদিন শুনানির জন্য ততগুলো মামলা রাখতে হবে, যতগুলো শুনানি করা বা সাক্ষ্য গ্রহণ করা একজন বিচারকের পক্ষে সম্ভব। আদালতের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য বিচারককে আইনের নির্দেশনার আলোকে প্রতিটি মামলায় রায় ও আদেশ উন্মুক্ত এজলাসে ঘোষণা করতে হবে। অধস্তন আদালতে মামলাজট দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রতিদিনের কর্মঘণ্টার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা তাঁদের সরকারি দায়িত্ব ফেলে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে অনলাইনে সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা এবং ডাক্তার সাক্ষীর সাক্ষ্যসহ শতভাগ ক্ষেত্রে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর সাক্ষ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুসারে অনলাইনে গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের পদ সৃষ্টিযেসব জেলায় মামলাজট বেশি, সেসব জেলায় জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের (জেএও) পদ সৃষ্টি করে সেখানে সিনিয়র সহকারী জজ বা সরকারি জজ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছে সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসাররা বিচারকাজ করবেন না, কিন্তু সাক্ষী ব্যবস্থাপনাসহ আদালত ব্যবস্থাপনার অন্যান্য প্রশাসনিক দিক সরাসরি তদারকি করবেন। প্রয়োজন বোধে যেসব মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিচার আদালত মনে করবেন, সেসব মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ রহণ র র জন য হওয় র সরক র করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
পহেলা বৈশাখ বাঙালির মহাঐক্যের দিন: জিএম কাদের
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের)। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত বাংলাভাষীদেরও শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানিয়েছেন তিনি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেছেন, পহেলা বৈশাখ অশুভকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যোমে সামনে এগিয়ে চলতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ব্যর্থতার সকল গ্লানি মুছে দিতেই প্রতি বছর নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির মহাঐক্যের দিন। এমন উৎসবমুখর দিন ধর্ম, বর্ণ, জাত বা গোত্রের সীমারেখা ভেঙে একসাথে একই পথে চলতে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়।
জিএম কাদের অরো বলেন, মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে কর বা রাজস্ব আদায়ের জন্য বাংলা সন গণনা শুরু হয়। কিন্তু, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি লালন ও বিকাশের অসাধারণ অধ্যায় হয়ে ওঠে আমাদের প্রিয় নেতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুপম উদোগে। ধর্ম, বর্ণ ও জাত বা গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে পহেলা বৈশাখের উৎসবে সামিল করতে পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন তিনি। এরপর থেকে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ মানেই রঙিন উৎসবে বাঙালির প্রাণের সঞ্চার।
পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন জিএম কাদের। একইসঙ্গে বাংলা নববর্ষে সবার উন্নতি, সমৃদ্ধি ও বল্যাণ কামনা করেছেন তিনি।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/রফিক