ফেব্রুয়ারি এলেই নিয়ম করে একুশ আসে। আর তার পিছু পিছু আসে মাতৃভাষা নিয়ে নতুন নতুন বয়ান। কেমন আছে আমাদের মাতৃভাষা, কী তার হালচাল? বছরের এগারো মাস কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে কেবল ফেব্রুয়ারিজুড়েই চলে এসব প্রশ্নের তত্ত্বতালাশ। চারদিকে রব ওঠে, সাইনবোর্ড বাংলা করো, উচ্চশিক্ষার বইগুলো বাংলা করো, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে বাংলার একটি কোর্স বাধ্যতামূলক করো, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে বাংলা চর্চার খোঁজ লাগাও। ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতেই এসব তোড়জোড়ে ভাটা পড়ে। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে ভাষা নিয়ে আবেগপ্রবণ বিজ্ঞাপনগুলো উধাও হতে থাকে। আবার ধুলা জমে শহীদ মিনারের সিঁড়িতে।
সিঁড়িগুলো অপেক্ষা করে আরেকটি ফেব্রুয়ারির। যেমন অপেক্ষা করেন ফুল ব্যবসায়ী। যেমন অপেক্ষা করেন কালো পাঞ্জাবি ও শাড়ির বিক্রেতা। যেমন অপেক্ষা করেন দীর্ঘ-ইকার দিয়ে ভুল বানানে শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা কম্পোজিটর।
কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে প্রশ্নটি প্রতিবছরই ফিরে ফিরে আসে। কেমন আছে আমাদের মাতৃভাষা, কী তার হালচাল? জীবনের গতি আর ভাষার গতি কি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে? সহজ হচ্ছে কি তার অবাধ যাতায়াত? এই যেমন ঢাকার রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা স্থবির সময়ে কেমন রূপ পায় বিরক্তির ভাষা? একই রাস্তায়, একই সময়ে অনিয়মের ফেরে থমকে থাকা বিভিন্ন বাহনের চালকের ভাষা কী একই রকমভাবে প্রকাশ পায়? রিকশাওয়ালা, সিএনজিচালক, ট্রাকচালক, পাঠাওয়ের মোটরবাইক চালক, উবারচালক আর দামি প্রাইভেট কারের চালকের ভাষার ধরন কি একই রকম? স্থান আর সময় এক হলেও শ্রেণিচরিত্রভেদে ভাষা যে বদলে যায়, সেসব নিয়ে দিস্তা দিস্তা কথা বলেছেন সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীরা।
এমনকি একই ঘরে বয়সভেদেও বদলে যায় ভাষার বিন্যাস। এত দিন অন্তত সমাজের ভাষা বিষয়ে এমন সহজ বোধগম্য তত্ত্বই প্রচার করে গেছেন সমাজ-ভাষার গবেষকেরা। কিন্তু এই ডিজিটাল যন্ত্রপাতির নয়া দুনিয়ায় একেকটা প্রজন্মের নতুন নতুন নাম ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে সবাই কি সবার ভাষা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে?
সাহিত্যের ভাষায় কোন রীতি প্রয়োগ করা হবে—সাধু না চলিত, এ নিয়ে ইতিহাসে বিস্তর যুদ্ধ হয়ে গেছে। তারপর আমাদের দেশে টেলিভিশনের ভাষারীতি নিয়েও চলেছে তর্কযুদ্ধ। এখন চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাষা ব্যবহার নিয়ে চিন্তাপর্ব। যন্ত্র কিছু দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। যন্ত্রেরও রয়েছে পোষা তোতাপাখি। কারও জন্মদিনে বা মৃত্যু হলে সে বিলায় রেডিমেড শব্দ বা বাক্য। এইচবিডি মানে হ্যাপি বার্থ ডে, আরআইপি মানে রেস্ট ইন পিস, আরও আছে এলওএল মানে লাফ আউট লাউড। এসব কষ্ট করে টাইপ করতে না চাইলেও সমস্যা নেই। আছে বিচিত্র রঙিন ইমোজি আর মিম।
বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক। ফেসবুকের রয়েছে সাতটি রিঅ্যাকশন—লাইক, লাভ, কেয়ার, হাহা (হাসি), ওয়াও, স্যাড, অ্যাংরি। কিন্তু এর বাইরেও তো অসংখ্য অনুভূতি রয়ে যায়! হাহা হাসি না দিয়ে কেউ যদি মুচকি বা বাঁকা হাসি দিতে চায়! কেউ যদি অ্যাংরি না দিয়ে অভিমান প্রকাশ করতে চায়! অন্যদিকে ইমোজির ভুলভাল ব্যবহার নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ তো লেগেই আছে!
বাকি থাকে কমেন্ট অপশন। বাংলা টাইপ যে জানে না বা জানতে চায় না, সে লেখে রোমান হরফে হাস্যকর বাংলা। সেসব নিয়েও তৈরি হয় মিম আর টিকটক। আর রোমান হরফে বাংলা না লিখে এবার সরাসরি বাংলা বর্ণমালার অদ্ভুত ব্যবহার শুরু হয়েছে যেখানে ‘প্রিয়’ হয়ে যাচ্ছে ‘পিও’, ‘স্যরি’ হয়ে যাচ্ছে ‘ছঋ’।
কিন্তু তার চেয়েও এ শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে বড় সংকট তৈরি হচ্ছে যোগাযোগের ভাষা নিয়ে। মায়েরা কি বুঝতে পারছেন সন্তানের টিকটকের ভাষা? কিংবা বাবারা কি মন দিয়ে শুনতে পারছেন র্যাপ সংগীতের ভাষারীতি? প্রতিদিন কি বদলে যাচ্ছে না সম্মানের ভাষা। স্নেহের ভাষা! পারস্পরিক বোঝাপড়া বা সহনশীলতার ভাষা! আবুল হাসানের ‘মাতৃভাষা’ কবিতার মতো, বেদনার ভাষা! বৈষম্যের ভাষা! যেমন বলেছিলেন তিনি, ‘আর পৃথিবীতে এখনো আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!’ বিশ্বব্যাপী বদলেছে কি ক্ষুধার ভাষা?
ফারজানা সিদ্দিকা, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনায় উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা বর্ষবরণ
উৎসব মুখর পরিবেশে খুলনায় সোমবার বাংলা নববর্ষ বরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সকাল ৭টায় সার্কিট হাউজ সংলগ্ন টেনিস কমপ্লেক্সে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ছিল গান, নাচ, আবৃত্তি ও শোভাযাত্রা। অনুষ্ঠানে যোগ দেন সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
খুলনা জেলা প্রশাসন সকাল ৮টায় রেলওয়ে স্টেশন থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি শহীদ হাদিস পার্কে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার, জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার টিএম মোশাররফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল সোয়া ৭টায় বর্ষ আবাহন, সকাল ৯টায় কেন্দ্রীয় মাঠে মেলার উদ্বোধন, সকাল ১০টায় শোভাযাত্রা, পরে লাঠিখেলা ও ম্যাজিক শো এবং বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মেলার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম। মেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও আশপাশের এলাকার লোকজন জড়ো হন।
বিএনপি সকাল ৭টায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পান্তা উৎসব ও ১০টায় র্যালির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন সহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নগরীর পার্ক, নদীর ঘাটসহ বিনোদন স্পটগুলোতে দিনভর ছিল তরুণ-তরুণীদের উপচেপড়া ভিড়।