গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কয়েক মাস ধরে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তৃণমূলে ব্যাপকভাবে সভা-সমাবেশ করছেন। খেলাধুলা, ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আয়োজনে যোগ দিয়েও তাঁরা কুশল বিনিময় করছেন। এমন অবস্থায় আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯টি সংসদীয় আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দলটি ‘নির্বাচনী মাঠে’ নেমেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে গতকাল শনিবার সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি মো.

শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত দুই বছর আগে সারা দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করেছিল। এসব নাম কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়ায় এখন অঞ্চল থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে প্রার্থী বাড়তে-কমতে পারে। এমনকি এখনকার ঘোষিত তালিকাও পরিমার্জিত হতে পারে।

বৃহস্পতিবার রাতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। প্রার্থীদের মধ্যে সিলেট-১ আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানানো হয়।

এ ছাড়া সিলেট-২ আসনে অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান, সিলেট-৩ আসনে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ, সিলেট-৪ আসনে জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, সিলেট-৫ আসনে জেলার নায়েবে আমির আনোয়ার হোসেন খান ও সিলেট-৬ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মৌলভীবাজারের চারটি আসনে যেসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন মৌলভীবাজার-১ আসনে আমিনুল ইসলাম, মৌলভীবাজার-২ আসনে জেলা আমির এম শাহেদ আলী, মৌলভীবাজার-৩ আসনে সাবেক জেলা আমির আবদুল মান্নান ও মৌলভীবাজার-৪ আসনে আবদুর রব।

সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি আসনেও প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ-১ আসনে সুনামগঞ্জ জেলার আমির তোফায়েল আহমেদ খান, সুনামগঞ্জ-২ আসনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির, সুনামগঞ্জ-৩ আসনে সিলেটের জজ কোর্টের এপিপি ইয়াছিন খান, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে সুনামগঞ্জ জেলার নায়েবে আমির মুহাম্মদ শামসউদদীন ও সুনামগঞ্জ-৫ আসনে গোবিন্দনগর ফাজিল মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুস সালাম আল মাদানীকে প্রার্থী করা হয়েছে।

এ ছাড়া হবিগঞ্জ-১ আসনে সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি মো. শাহজাহান আলী, হবিগঞ্জ-২ আসনে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের শুরা সদস্য শেখ জিল্লুর রহমান আজমী, হবিগঞ্জ-৩ আসনে হবিগঞ্জ জেলার সেক্রেটারি কাজী মহসিন আহমেদ ও হবিগঞ্জ-৪ আসনে হবিগঞ্জ জেলা আমির কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান প্রার্থী হবেন বলে দলটি জানিয়েছে।

সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী হিসেবে জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনের ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি সিলেট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারিও। তিনি বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নেতৃত্ব চান তরুণ প্রজন্ম। জামায়াতও সেটি বিবেচনায় নিয়ে দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী নির্বাচন করেছে। আগে থেকেই যেন প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ গোছাতে পারেন এবং কর্মী-সমর্থকেরা সক্রিয় থাকতে পারেন, সেটা বিবেচনায় নিয়েই প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ ২ আসন ৩ আসন ৪ আসন ১ আসন

এছাড়াও পড়ুন:

বাঙালির প্রাণের উৎসব আজ

রৌদ্রকরোজ্জ্বল বৈশাখী দিন ফিরে এল আবার। সুরে-বাণীতে, সাজসজ্জায়, আহারে-বিহারে, আনন্দ-উল্লাসে আজ সোমবার বাংলার নতুন বছর ১৪৩২ বরণ করে নেবে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব মানুষ। পুরোনো ব্যর্থতা ঝেরে ফেলে সবার কল্যাণ কামনায় উদ্‌যাপিত হবে নববর্ষের উৎসব। নববর্ষকে আবাহন জানিয়ে বহুকণ্ঠে ধ্বনিত হবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...।’

বাংলা নববর্ষের চেয়ে বড় কোনো সর্বজনীন উৎসব দেশে আর নেই। এ কারণে মানুষে মানুষে মহাপ্রাণের মিলন ঘটানোর বর্ষবরণের এই উৎসব গভীর তাৎপর্যময় হয়ে আছে আমাদের জীবনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এবার নতুন পরিবেশে বর্ষবরণ উৎসব বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য তাই ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।

মূল প্রতিপাদ্য সামনে রেখে জাতীয়ভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে আগেই জানিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। উৎসব অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সব জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রমনার বটমূলে বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান আয়োজন করবে ছায়ানট।

রাজধানীর বর্ষবরণের অন্যতম বর্ণাঢ্য আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রা। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র বদলে এবার ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামকরণ করা হয়েছে। এই শোভাযাত্রার যে মোটিফগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে

২০ ফুট উচ্চতার ‘স্বৈরাচারের মুখাকৃতি’ নামের মোটিফটি শনিবার ভোররাতে কে বা কারা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনার পরও তাদের শোভাযাত্রা বর্ণাঢ্যভাবেই পথে নামবে পয়লা বৈশাখ সকালে।

পয়লা বৈশাখের উৎসব গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল, তার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে তার প্রতিবাদে বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বৈশাখী উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট প্রথমবারের মতো আয়োজন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। কালক্রমে বর্ষবরণ উৎসবে যুক্ত হয় আরও অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। চারুকলার শোভাযাত্রা বর্ণাঢ্য করে তোলে আয়োজন। বহু সংগঠনের অংশগ্রহণে বর্ষবরণ বহু প্রাণের বিপুল উৎসবে পরিণত হয়।

বাংলা বর্ষবরণের উৎসব যত আড়ম্বর, উৎসাহের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হয়, ব্যবহারিক জীবনে বাংলা সনের প্রয়োগ তেমন ব্যাপক নয়। প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্ম, শিক্ষা, ব্যবসা—সবই গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি অনুসরণ করেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে বাংলা দিনপঞ্জি পুরোপুরি অব্যবহৃতও নয়। কৃষকেরা চাষাবাদ, ফসল রোপণ, ফসল তোলার ক্ষেত্রে বাংলা সনের হিসাব অনুসরণ করেন। অনেক ধর্ম সম্প্রদায়ও তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে। কাজেই সমাজে নানা ক্ষেত্রে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রয়োগ রয়েছে। সে কারণে নতুন বছর শুরু হলে নতুন প্রত্যাশা নিয়েই মানুষ তাকে বরণ করে নেয়।

নতুন বছরকে বরণ করার রীতি পৃথিবীর বহু দেশের সংস্কৃতিতে বহমান। আমাদের দেশে বছরের পয়লা দিনটিকে কেন্দ্র করে এই উৎসবে তুলে ধরা হয় দেশের গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। রাজধানীতে রমনার বটমূলে এবার ৫৮তম বারের মতো ছায়ানট আয়োজন করবে তাদের বর্ষবরণের প্রভাতি অনুষ্ঠান। এবার তাদের অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে ভৈরবীতে রাগালাপের মধ্য দিয়ে শুরু হবে প্রায় দুই ঘণ্টার এ অনুষ্ঠান।

এ ছাড়া ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুরের ধারার আয়োজনে সকাল ৬টায় শুরু হবে সহস্রকণ্ঠের গানে গানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

চারুকলা অনুষদের আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হবে সকাল নয়টায়। আগেই জানানো হয়েছে, এবার শোভাযাত্রায় বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকগুলো নিয়ে অংশ নেবেন। শোভাযাত্রাটি টিএসসি, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি হয়ে আবার চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে।

সকাল থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হবে বিসিকের সঙ্গে যৌথ আয়োজনে সপ্তাহব্যাপী লোক ও কারুশিল্প মেলা। এ ছাড়া বেলা সাড়ে তিনটা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হবে বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের আয়োজনে ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে থাকবে একক ও দলীয় আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বেলা তিনটা থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে চলবে বৈশাখী ব্যান্ড শো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় চীনা কারিগরি দলের পরিবেশনায় শুরু হবে বর্ণাঢ্য ড্রোন শো।

এসব প্রধান অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেক এলাকাভিত্তিক এবং বহুতল আবাসিক ভবনগুলোতে ছোট ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। বরাবরের মতো ট্রাকে ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ করে অনেক সংগঠন শহর ঘুরে সংগীত, আবৃত্তি পরিবেশন করবে।

রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশেই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হবে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও প্রবাসী বাঙালিরা নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেবেন। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব অনুষ্ঠানের সঙ্গেও দেশবাসীর এক রকমের সংযোগ ঘটে। এমন নানা আয়োজন উদ্যোগের ভেতর দিয়ে কালক্রমে বাংলা নববর্ষের উৎসব আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। প্রসারিত হচ্ছে বিপুল পরিসরে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ