Samakal:
2025-03-12@11:38:11 GMT

তরুণদের মানসিক বিকাশের অভাব

Published: 9th, February 2025 GMT

তরুণদের মানসিক বিকাশের অভাব

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক জরিপের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মাধ্যমে তাদের জীবন অবসান ঘটিয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৩২ আর ২০২৩ সালে ৫১৩ জন। মনে হতে পারে, শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার কমেছে। বাস্তবতা ভিন্ন কিছু বলছে।

মনে রাখতে হবে, এ সংখ্যা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে নেওয়া। সব আত্মহত্যার ঘটনা পত্রিকায় রিপোর্ট হয় না। এ ছাড়া গত বছরের উল্লেখযোগ্য সময় ছিল আন্দোলন। তারপর ঘটনাবহুল সময়। যখন ছিল না থানা পুলিশের তেমন কোনো কার্যক্রম। এ ধরনের সংবাদে নিয়ে জনমানুষের আগ্রহ রয়েছে। তারপরও বলব, এই ৩১০ জনের অপমৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন– বিশেষ করে যখন মনে হয় রাষ্ট্র কিশোর-কিশোরীদের এ ধরনের অকালমৃত্যু প্রতিরোধে বারবার বলা সত্ত্বেও তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। এ মৃত্যুগুলো প্রতিরোধ সম্ভব। শুধু দরকার কিছু সদিচ্ছা।

জরিপে উঠে আসা একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে, আত্মহত্যাকারীর ৬০ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী– যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৯-এর মধ্যে। প্রতিবারের মতো এবারও মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যা করেছে। এ বয়সীদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়াটা সত্যিই বেদনাদায়ক। প্রতিটি মৃত্যুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজ, পরিবার আর রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নির্মোহতা আর নির্মমতা। কত মৃত্যু হলে রাষ্ট্রের টনক নড়বে? এ প্রশ্ন রাখছি নীতিনির্ধারকদের কাছে। 

কেন উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী– যাদের স্বপ্ন বোনার কথা, জীবনের জয়গানে ব্যস্ত থাকার কথা, তারা সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটাচ্ছে? আঁচলের জরিপে প্রকাশ্যে উঠে আসা কারণগুলোর প্রধান তিনটি হচ্ছে– অভিমান, রোমান্টিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং শিক্ষাজীবনের চাপ বা আকাঙ্ক্ষিত ফলাফলে ব্যর্থতা। মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি, এ আত্মহত্যার পেছনে অপ্রকাশ্য একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে– এ বয়সী মানুষের সঠিক মানসিক বিকাশ না হওয়া। বিশেষ করে রেজিলিয়েন্স ক্ষমতা তৈরি না হওয়া। রেজিলিয়েন্সের সংজ্ঞা হলো, ভীষণ প্রতিকূলতা বা ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়ার পরও আবারও ফিরে আসা। পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানো। আরেকটা কারণ হতে পারে, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি। এ দুটি উপাদানই শিশুর বেড়ে ওঠার সময়ের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। রেজিলিয়েন্স আর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গড়ে ওঠার প্রাথমিক উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার। তারপরই স্কুল। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়া অনেক প্রশ্ন এনে দিয়েছে। তাহলে কি আমাদের পরিবারগুলো শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছে? স্কুলগুলো কি সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারছে না; যা কিশোর-কিশোরীর রেজিলিয়েন্স আর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গড়ে উঠতে সহায়ক হবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবার দরকার আছে, বিশেষ করে আমরা সত্যিই যদি এ বয়সীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে আগ্রহী হই।  

একটি জিনিস স্পষ্ট করে বলতে চাই, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা আসলেই সম্ভব। তার আগে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে প্রতিটি আত্মহত্যার। খুঁজে দেখতে হবে কোথায় ঘাটতি। কোথায় আমাদের ব্যর্থতা। শুধু পরিবারের ওপর, স্কুলের ওপর দায় না চাপিয়ে সেখানে আর কী কী পরিবর্তন আনা দরকার সেটি নিয়ে কাজ করতে  হবে। কীভাবে শিশুকে গড়ে তোলা হলে তাদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ হবে। তাদের মধ্যে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা তৈরি হবে। ব্যর্থতা-অপ্রাপ্তির সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে নিতে শিখবে সেটি নিশ্চিত করা এখন জরুরি। না হলে এটি সহজেই অনুমান করতে পারি, আগামী সময়ে শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সব বয়সীর মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। 

শুধু শিক্ষার্থী নয়, সামগ্রিকভাবে সব ক্ষেত্রেই মেয়েরা কেন বারবারই আত্মহত্যার জরিপে ‘এগিয়ে’ আছে? নারী, শিশু আর কিশোরীদের আত্মহত্যা বেশি করার পেছনে আমাদের সমাজে বিদ্যমান নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বৈষম্যের অন্যতম কারণ বলেই মনে করি। আঁচলের জরিপে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে কারণগুলো বের করা হয়েছে। গুণগত গবেষণা করা হলে আত্মহত্যার পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত কারণগুলো আরও ভালোভাবে জানা যেত। যেসব পরিবারে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে সেসব পরিবারে কীভাবে শিশুকে বিশেষ করে মেয়েশিশুর সঙ্গে আচরণ করা হচ্ছে। সেখানে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক কেমন। তাদের জীবনের টানাপোড়েনগুলো কেমন। সে পরিবার বা সেই সমাজে আত্মহত্যাকে উৎসাহিত করে এমন কোনো উপাদান আছে কিনা। এ তথ্যগুলো আত্মহত্যা অনুৎসাহিত করে এমন পরিবার বা সমাজব্যবস্থা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

কীভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায়? ইতোমধ্যে কিছু বিষয় ওপরে তুলে ধরেছি। এটি রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান– শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আত্মহত্যা কখনোই ঠেকানো সম্ভব নয়। মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিন। প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার বা তার থেকেও বেশি মানুষের আত্মহত্যা জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার দাবি রাখে, সেই দাবি করছি না। অন্যান্য স্বাস্থ্য দুর্যোগে জনগণের সুরক্ষায় যেমন টাস্কফোর্স গঠন করে প্রতিকার-প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করে সুরক্ষাবলয় তৈরি করুন। প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসকদের মতামত নিন। আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ে অনেক গবেষণা আছে। সেখান থেকে আমাদের দেশের উপযোগী দিকনির্দেশনা আর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করুন।  

সব শেষে এটাই বলব, আত্মহত্যা প্রতিরোধে লেখা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। সেগুলো শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। দেশের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়শোনা, বছরজুড়ে পরীক্ষা, ভর্তিযুদ্ধ, যোগ্যতা প্রমাণের যুদ্ধতে ভারাক্রান্ত। তাদের ওপর পড়াশোনার বোঝা চাপিয়ে আরও মানসিক চাপ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। যারা আত্মহত্যা করার ঝুঁকিতে আছে তাদের তিরস্কার, সমালোচনা না করে, তাদের প্রতি সমানুভূতি প্রকাশ করে, তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে, তাদের পাশে থেকে ভালোবাসা দিয়ে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে বড় সাহায্য করতে পারেন পরিবার-পরিজন আর শিক্ষকরা। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে আত্মহত্যা প্রতিরোধ, আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের শনাক্ত করা, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে আর কী করা যাবে না এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন– রেজিলিয়েন্স আর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা তৈরির কার্যক্রম, সেই উপযোগী খেলাধুলা, শরীরচর্চা, বিভিন্ন কোর্স, মানসিক স্বাস্থ্য ক্লাব বাধ্যতামূলক করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করাও এখন সময়ের দাবি। আত্মহত্যারই ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করা আর তাদের যথাযথ কাউন্সেলিং করার মাধ্যমে একজন মনোবিজ্ঞানী আত্মহত্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মন ব জ ঞ ন ব শ ষ কর পর ব র আম দ র জ বন র র ওপর দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

একঝলক (১২ মার্চ ২০২৫)

ছবি: তাফসিলুল আজিজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ