আমার ছোট ভাই, যার নাম সদ্য সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। ৫ আগস্ট ২০২৪, ততক্ষণে সরকারের পতন হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় পুলিশের গুলিতে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে সদ্য। তার স্মৃতি প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বুকে অজস্র কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সেই প্রাণহীন বাড়িটা শুধু তার স্মৃতিতে ভেসে থাকে। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব যেন আমাদের শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে। যদিও প্রায় ছয় মাস হতে চলল।
সম্পর্কের বিচারে আমার ফুফাতো ভাই। আমি তাদের বাসাতেই আমার ফুফুর হাতে বড় হয়েছি। আজ মনে হয়, সদ্যকে পড়াশোনা নিয়ে এত বকাঝকা না করলেই ভালো হতো। কী করব, সে তো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে আমাদের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। স্বপ্ন ছিল, সেরাদের সেরা হবে। এখন আমাদের দিন শুরু হয় চোখের পানিতে। অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে বা অফিসের ডেস্কে বসে। ঘরে কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদে, কেউ বিছানায় শুয়ে, কেউ খেতে বসে। আমরা কেউ কারও কাছে প্রশ্ন করি না– কারণটা সবাই জানি। সেই সদ্য, যে আমাদের ঘর আলো করে জন্মেছিল, যে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠছিল। সে আজ কোথাও নেই। এটি কীভাবে সম্ভব!
রাস্তাঘাটে ফুডপান্ডার লোগো দেখলেই চোখ ভিজে যায়। ফুফা সদ্যকে ফুডপান্ডার কথা বলে ক্ষ্যাপাতেন। সে হেসে হেসে আরও বায়না করত। তোমার শরীরটা কতটা নরম আর তুলতুলে ছিল, তা ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় দৌড়ানোর সময় আমার নখ লেগে গিয়েছিল ওর পেটে, এতেই চামড়ায় ক্ষত হয়। আজ মনে হয়, হয়তো সেই নরম শরীরটাই বুলেটকে এত সহজে ভেতরে টেনে নিয়েছিল।
সদ্য কি জানে ওর অনুপস্থিতিতে মায়ের দিনগুলো কীভাবে কাটছে? এখন আর তাঁর কোনো ব্যস্ততা নেই। কোন শিক্ষক কখন আসবে, ওর পড়া তৈরি হয়েছে কিনা– এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই। দুপুরে রান্নার তাড়াও নেই। স্যারের জন্য সব গুছিয়ে রাখতে হবে না যে! মায়ের সেই ছুটোছুটির জীবনটা এখন থেমে গেছে। এই থামার নাম তো জীবন নয়।
ওর প্রিয় খাবারগুলো দেখলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। শুকনা পাটশাক, পালং ডাল আর গরুর মাংস পেলে সদ্য যে কত খুশি হতো! বাসায় ঢুকেই ‘মা, মা’ বলে চিৎকার করত। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে সারাদিনের গল্প বলত– স্কুলে কী কী হলো, স্যার কী বললেন, সানিম, শ্রেয়াস, ফাইজা এমনকি ফাইজার মা কী বললেন সব.
ছোটবেলায় সদ্য ‘দিনরাত’ বলতে পারত না, বলত ‘রোদের দিনে, রাতের দিনে’। ভাত খেতে বসে আধো আধো বুলিতে বলত, ‘সাদা ভাত আর গোল ডিম দাও।’ ওকে নিয়ে আমার কেন জানি না, ছোটবেলার কথাগুলোই বেশি মনে পড়ে। সদ্য খালাকে ডাকত ‘আম্মনি’, যেন নামেই সব ভালোবাসা। হিলটন ভাই ছিল ওর ‘বন্ধু’, মেজো মামা আর মামির দুষ্টুমি ওর কাছে ‘দুষ্টু মামা’ আর ‘দুষ্টু মামি’ হয়ে উঠেছিল। রাজ্য ছিল ‘সুন্দর আব্বা’ আর আমার ছেলেকে ডাকত ‘পাণ্ডু মামু’। সেই ডাকগুলো ছিল এত বিশেষ! এসব নামে তাদের আর কেউ ডাকবে না।
আর আমাকে? আমাকে ডাকত ‘বড় আপি’। সেই ডাকের সুরটা যেন এখনও কানে বাজে। সেই ডাক আর কখনও শোনা হবে না– এ ভাবনাই বুকের ভেতর এক দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে গেছে।
পছন্দের ‘কুংফু পান্ডা’ সিনেমা যে সদ্য কতবার দেখেছে, তার কোনো হিসাব নেই। দেখার সময় হা হা করে এত হাসত যে, ওর শরীরের থুলথুলে মাংসগুলো ঝাঁকিয়ে উঠত। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে।
সাদা ভাতের প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল বলে ওর মা এখনও কান্না থামাতে পারে না। মৃত্যুর পর বারবার বলতে থাকে, ‘‘আমি আর কখনও ভাত খাব না। তোমরা আর কখনও আমাকে ভাত সাধবে না। আমার ছেলে বলত, ‘মা, এই কয়টা ভাত খাব আমি! আমাকে আরও ভাত দাও।’ আমার ছেলে যদি এক বেলা একটু কম খেত, পরের বেলা আমি বেশি করে দিতাম।’’
ওর স্বাস্থ্য একটু বেড়ে যাচ্ছিল, তাই ওর মা ভাত একটু কমিয়ে দিত। এখন মনে হয়, যদি জানত, সময় এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তাহলে হয়তো কিছুই কমিয়ে দিত না।
তিশমা হঠাৎ হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে। টিভির রিমোট নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয় না বলেই হয়তো তার এই কান্না। সদ্য আর তিশমা, দুই ভাইবোন। দু’জনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত বন্ধন– একদিকে খুনসুটি আর অন্যদিকে নিঃশর্ত টান। তিশমা কথা বলতে পারে না বলে তার প্রতি টানটা যেন আরও গভীর ছিল, আরও দায়িত্ববোধে ভরা। সদ্যই ছিল তিশমার নিঃশব্দ ভাষার শ্রোতা, তার আনন্দের সঙ্গী। তার নীরব কান্নার সান্ত্বনা।
৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল দেশের ইতিহাসের একটি অদ্ভুত মুহূর্ত, যখন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনগণের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে গিয়েছিল এবং দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিন। সরকারের নির্দেশে এতদিন যে পুলিশ বাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালিয়েছে, সরকারের পতনের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে। সাভারে ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বিনা অপরাধে আমাদের প্রিয় ভাই সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। যে কিনা শুধু মানুষের ঢল আর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাস্তার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন আমরা একদিকে দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় দেখেছি, অন্যদিকে হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনকে। সদ্যর নিথর দেহ নিয়ে যাওয়ার আগে যখন ওকে শেষবারের মতো দেখার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছিল, সেই মুহূর্তটি জীবনের সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হয়ে থাকবে। ওর মা গায়ে হাত রাখার সাহসটুকুও জোগাড় করতে পারল না। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনবার ওর শরীরের ওপর দিয়ে আদরের ভঙ্গি করল, যেন সদ্যকে শেষবার ছুঁয়ে না দেখলেও নিজের সব ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাতে পারল। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেই মা, বাবা কিংবা বোনের অনুভূতি অনুভব করা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র আম র ছ র জন য আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
রংপুরে বাঁধ নিয়ে শঙ্কিত মানুষ
‘সামনোত তো বষ্যা আসি গেইল। সবায় খালি কতায় কয়, এলাও বান্দের কোনো কাম (বাঁধের কাজ) হইল না। কায় জানে বাহে, এইবার বান্দ ভাঙলে হামারও বুজি এটেকোনা থাকা হবার নয়।’
আসন্ন বর্ষায় পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কায় এমন অভিব্যক্তি রংপুরের গঙ্গাচড়ার ধামুর এলাকায় তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধের বাসিন্দা শহর বানুর। কয়েক বছর ধরে তিস্তার পানি কখনও কমে, আবার কখনও বেড়ে যায়। পানিপ্রবাহের এ অস্বাভাবিকতায় প্রতিরক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর ওপর রয়েছে দখল-দূষণ। এসব কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। আগামী বর্ষা ঘিরে নাজুক এ বাঁধ নিয়ে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তিস্তাপারের মানুষ। তারা দ্রুত বাঁধটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে নীলফামারীর জলঢাকা থেকে রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তা রেল সেতু পর্যন্ত ৪৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তিস্তা রেল সেতু থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত আরও ২১ কিলোমিটার রয়েছে এই বাঁধের অংশ। ২০১৯ সালে সর্বশেষ ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ সংস্কারের কাজ করা হয়েছে। বামতীর বাঁধ রয়েছে তিস্তা ব্যারাজ থেকে লালমনিরহাট হয়ে কুড়িগ্রামের উলিপুর পর্যন্ত মোট ১২০ কিলোমিটার। ডানতীর বাঁধের নীলফামারীর জলঢাকার শৌলমারী এলাকায় দুই কিলোমিটার, আলসিয়াপাড়ায় এক কিলোমিটার ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বলেও সূত্র জানায়।
সরেজমিন দেখা যায়, রংপুরের গঙ্গাচড়ার মর্নেয়া থেকে নোহালী পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধের ওপর বসতি গেড়েছে নদীভাঙনের শিকার ১০ হাজার পরিবার। বসতির ভারে তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধ হুমকিতে পড়েছে। বাঁধের বেশির ভাগ স্থান কেটে সমতল করে স্থানীয় দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকায় জলঢাকার শৌলমারী ও গঙ্গাচড়ার নোহালী সীমান্ত থেকে রংপুরের কাউনিয়ার নিচপাড়া পর্যন্ত দখলদারদের কবলে চলে যায়। হুমকির মুখে পড়ে ডানতীরের বাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বহুবার উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েও দখলদারদের উচ্ছেদ করতে পারেনি। বাঁধটি অবৈধ দখলদারদের পাশাপাশি ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধের প্রস্থ ১৪ ফুট থাকার কথা থাকলেও এখন অনেক স্থানেই তা নেই।
কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকার নওশের আলী বলেন, গত দুই বছরের বন্যায় বিভিন্ন উপবাঁধসহ বিনবিনা এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধের বিশাল এলাকা বিলীন হয়ে গেলেও তা সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো পদক্ষেপ নেই। এসব কারণে তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
গঙ্গাচড়া সদরের গান্নারপার এলাকার গোলাম মওলা বলেন, পানি বাড়া-কমার কারণে বাঁধে পানির ধাক্কা লেগে বিভিন্ন স্থানে মাটি সরে গেছে। বর্ষা শুরুর আগে বাঁধ মেরামত করা না গেলে বিশাল এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
একই এলাকার মনছুর আলী বলেন, প্রতিবছরই এখানকার ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তিস্তা। গোটা মৌসুমজুড়ে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। ঠিকানাহীন পরিবারগুলো প্রতিবছর বাঁধ কেটে বস্তি গড়ে তুলছে। এতে বাঁধ নাজুক হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, ‘খুব দ্রুত তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার করা প্রয়োজন। না হলে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করলে গোটা রংপুর শহর তলিয়ে যাবে।’
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালের পর বাঁধের সংস্কার কাজ করা হয়নি। ওই সময় বাঁধে বসবাসকারীদের উচ্ছেদও করা হয়েছিল। মাঝখানে আবারও বাঁধে বসতি গড়ে উঠেছে। এতে বাঁধের বেশকিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সংস্কার করা হবে।