ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, স্থাপনাসহ অন্যান্য স্থাপনা ও ম্যুরাল–ভাস্কর্যে হামলা–ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দুই দিনে তিনটি বিবৃতি দিয়েছেন। এতে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগই প্রকাশিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পত্তি ধ্বংস থেকে বিরত থাকা এবং পতিত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি কিংবা অন্য কোনো নাগরিকের ওপর আক্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তা সত্ত্বেও গতকাল শনিবার বিচ্ছিন্নভাবে দু–এক জায়গায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
৩২ নম্বরের বাড়ি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য স্থাপনায় হামলা–ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। বিএনপি চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের প্রতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। টিআইবি, ব্লাস্টসহ বেশ কিছু সংগঠন এবং ২৬ বিশিষ্ট নাগরিকের যৌথ বিবৃতিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
কয়েক দিন ধরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটল, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা বন্ধ করতে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের অনেক জেলায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুরে পাল্টাপাল্টি হামলায় আহত কয়েকজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। গত বছরের জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি, পুরো ঘটনাকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর উসকানিমূলক বক্তৃতা ছাত্র–জনতাকে ক্ষুব্ধ করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু উসকানির জবাব সহিংসতা হতে পারে না। সভা, সমাবেশ, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভসহ গণতান্ত্রিক পথেই এর জবাব দিতে হবে।
ছাত্র–জনতার ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল সারা দেশে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটি এমন সময়ে ঘটল, যখন আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতির কারণে প্রায় ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনর্গঠনে সরকার কাজ করছে, রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনগুলোও তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে এসব কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতাসহ অংশীজনদের সঙ্গে যে আলোচনার কথা আছে, সেদিকে সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে। এ অবস্থা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার প্রতি সরকারের বেশি মনোযোগ দাবি করে।
প্রধান উপদেষ্টা যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কোনো অবস্থায় কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া যাবে না।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা এবং তাঁর সহযোগীদের বিচারকাজ যখন প্রক্রিয়াধীন, তখন এ ধরনের হামলার ঘটনা বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা দেবে এবং বিচারপ্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অতএব সব পক্ষকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, সেটিকে সফল করতে হলে সরকারকে সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে।
আমরা আশা করতে চাই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী দল–মতনির্বিশেষে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। গতকাল সারা দেশে যৌথ অভিযান ‘ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে। এটা জনগণকে তখনই স্বস্তি দেবে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কুণ্ঠিত হবে না। দেশবাসী সেটাই দেখতে চায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ আওয় ম ধ নমন সরক র র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
ভাঙচুরের দায় সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ২৬ নাগরিক। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা-পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরই অনেকাংশে বর্তায়। এসব ঘটনার বিচার দাবি করেন তারা।
গতকাল শুক্রবার দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘৫ ফেব্রুয়ারি যেভাবে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি ক্রেন, বুলডোজার ব্যবহার করে ধূলিসাৎ করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে অন্য যেসব স্থাপনা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে ধ্বংস করা হয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দেখে
একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, স্তম্ভিত ও লজ্জিত। এ ঘটনার আমরা বিচার চাই।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এমন লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। ঘটনাটির আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর সম্পূর্ণ সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানাতে চাই; কিন্তু কার কাছে জানাব? আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো হয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, কিংবা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল; কিন্তু কেন? তাদের জনগণের কর ও অর্থে লালন-পালন করা হয় কি নীরব দর্শক হয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য? যখন তাদেরই নাকের ডগায় প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন তারা নীরব-নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালনের অর্থ কী? অপরাধের সহযোগী হওয়ার সমার্থক নয়?’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কোনো ধরনের গণউত্তেজক সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স কেবল ফ্যাসিবাদের কর্মী-সমর্থক এবং তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকদের নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই উৎসাহিত করবে। বিগত পতিত সরকার ও তার সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে নানা নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। পাশাপাশি তারা দেশে এখন আইনের শাসন নেই বলে দেশ-বিদেশে যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তার হাতও এতে শক্তিশালী হবে। তাই পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কোনো অসত্য ভাষণ বা উস্কানিমূলক উক্তিকে উসিলা করে এমন কোনো কাজ করা বা তাকে সমর্থন করা চলবে না, যাতে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ইতোমধ্যে যা ঘটানো হয়েছে, সেসব ঘটনাকে আইনের আওতায় এনে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিচার করতে হবে।’
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা-পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যে কোনো দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থান কিংবা স্থাপনা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সেই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বাড়ি বা অন্য কোনো স্থাপনা– ওই স্থানে কারা কোন সময় বসবাস করেছেন বা কাদের নাম জড়িত, সেই নিরিখে বিচার্য নয়। মূল্যায়ন যে যেভাবেই করুক, তার ওপরে তার সুরক্ষার প্রশ্নটি নির্ভর করে না। এটা সভ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
তারা আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই এভাবে ঐতিহাসিক স্থান ও কীর্তিগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সুরক্ষা করা হয়। অনেক নির্মম নির্দয় শাসকের বাসভবনও দর্শকরা তাই দেখতে পান। তাদের কীর্তি-অপকীর্তি সম্পর্কেও বহু বছর পরও মানুষ জানতে পারেন। আমরা তাই ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবিস্তার ব্যাখ্যা দাবি করছি এবং এর সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবহেলাসহ যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহি ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙার সঙ্গে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শক্তি প্রদর্শনের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটা এক ধরনের গণউত্তেজক সন্ত্রাসের প্রদর্শন বলেই জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, যা ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভাবমূর্তিকেই ম্লান করে দেয়। এটা আমাদের গভীর উদ্বেগের বিষয় যে, তারুণ্য আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মূল শক্তি হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, সেই তরুণদের একাংশকে কোনো দেশি বা বিদেশি অপশক্তি বিপথে পরিচালিত করতে নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে কিনা– এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটিও আজ খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, আনু মুহাম্মদ, খুশী কবির, পারভীন হাসান, ড. ইফতেখারুজ্জামান, শামসুল হুদা, সারা হোসেন, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সুব্রত চৌধুরী, নুর খান, শাহনাজ হুদা, নোভা আহমেদ, জোবাইদা নাসরীন, মোহাম্মদ সেলিম হোসেন, শাহ-ই-মবিন জিন্নাহ, জাকির হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, মনীন্দ্র কুমার নাথ, সাঈদ আহমেদ, মিনহাজুল হক চৌধুরী, আশরাফ আলী, শাহাদত আলম, রেজাউল হক, হানা শামস আহমেদ ও মুক্তাশ্রী চাকমা।