জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে অভিজ্ঞতা: জিয়া থেকে হাসিনা
Published: 9th, February 2025 GMT
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রশাসন সংস্কারের ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু এবং ক্ষমতালোভী আমলাদের তৎপরতা চলছে। সংস্থাপন বিভাগ (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তাদের হাতে থাকায় প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। এটিও একটি বড় লজ্জার বিষয় যে, ওই সময়ে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলের প্রতিভাবান নেতানেত্রীরা তা দেখেও দেখেননি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে এসবে ইন্ধন জুগিয়েছেন।
আমার চাকরিজীবনের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ঘটনাটি বলার আগে জানাতে চাই, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি পদে সমাসীন হন, তখন আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান। শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ রাষ্ট্রপতির শিক্ষা কমিশনে আমাকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেন। সেখানে কাজ করার সুবাদে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ‘স্টেট গেস্ট’(রাষ্ট্রীয় অতিথি) হিসেবে বিদেশ সফর করার সুযোগ পাই।
১৯৭৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কোনো একটি জনসভায় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন ‘.
নিবন্ধটিতে আমি লিখেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে অনভিপ্রেতভাবে প্রচলিত ঔপনিবেশিক শাসন পদ্ধতির স্থলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির শাসন বাঞ্ছনীয় এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশ প্রচলিত সার্ভিস সিস্টেমের স্থলে বিষয়ভিত্তিক সমমানে, সমমর্যাদায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্যাডার সার্ভিস গঠন একান্ত কাম্য।
সৌভাগ্যক্রমে লেখাটি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নজরে আসে। তিনি তৎকালীন কেবিনেট সচিব মাহাবুবুজ্জামানকে নির্দেশ দেন প্রশাসন সংস্কার করার জন্য। অতঃপর মাহাবুবুজ্জামান প্রশাসন পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসকল্পে সনাতন সার্ভিসের স্থলে সমমানের, সমমর্যাদায় বিষয়ভিত্তিক ২৪টি ক্যাডার সার্ভিস গঠন করেন। এখানে সব ক্যাডার সার্ভিসে বেতনই হয় পদমর্যাদার ভিত্তিতে।
এছাড়া রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জেলা পর্যায়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চালু করা গভর্নরের স্থলে জেলা সমন্বয়কারী (ডিস্ট্রিক কো-অর্ডিনেটর) পদ সৃষ্টি করেন এবং তাতে সংসদ সদস্যদের নিয়োগদান শুরু করেন। আমলারা তা সহ্য করেননি। তারা জেলা সমন্বয়কারীর অর্গানোগ্রাম তৈরি থেকে বিরত থাকেন। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান আকস্মিক এক ক্যুতে চট্টগ্রামে নিহত হলে জেলা সমন্বয়কারী নিয়োগ ভন্ডুল হয়ে যায়। অন্যদিকে আমলারা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে উপেক্ষা করে ২৩টি ক্যাডার সার্ভিসবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন।
এমনকি বিচারপতি সাত্তার নিয়ম অনুয়ায়ী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৩ জুলাই সিভিল সার্ভিস অ্যাডমিন (প্রশাসন) ক্যাডারের সভাপতি বিজ্ঞাপনাকারে দৈনিক ইত্তেফাকে তাদের কিছু ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবিসহ অনেক দাবি তুলে ধরেন। এতে প্রশাসন ক্যাডার বাদে ২৩ ক্যাডারের হাজার হাজার কর্মকর্তা বিক্ষুব্ধ হন এবং ১৯৮২ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে একত্র হয়ে ২৩ ক্যাডারবিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো ফেরত চান। রাষ্ট্রপতি সাত্তার বাধ্য হয়ে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ।
আমলারা এবার আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে ষড়যন্ত্রে নামেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ সুযোগ বুঝে পরদিনই–১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ–রাষ্ট্রপতি সাত্তারের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। এই পদে আসীন হয়ে তিনি সিভিল সার্ভিস অ্যাডমিন ক্যাডারের পক্ষাবলম্বন করেন এবং আগের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের মেনে নেওয়া ২৩ ক্যাডারের দাবি ছুড়ে ফেলে দেন। অতঃপর ১৯৮৬ সালে বেতনই পদমর্যাদার ভিত্তি–এ নিয়মও এরশাদ বাতিল করে দেন।
কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা ভুয়া ভোটের জোগান দিয়ে দীর্ঘ ৯ বছর এরশাদকে ক্ষমতায় থাকতে সহযোগিতা করেন। অতঃপর ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন। তিনি জিয়াউর রহমান সূচিত প্রশাসন সংস্কার কর্মসূচি চালু করলেন না। এমনকি ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ড. কামাল সিদ্দিকীর অনুরোধে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের জন্য তিনি বিদেশে প্রশিক্ষণ বিষয়ক ১৪২৬ কোটি টাকার সিপিটি প্রোগ্রাম অনুমোদন দেন। এই পর্যায়ে বিশিষ্ট লেখক বদরুদ্দীন উমর যুগান্তরে লিখলেন, ‘পর্দার অন্তরালে বাংলাদেশের আমলারা’। তিনি দেখালেন কীভাবে আমলারা ডক্টরেট করে অন্যান্য ক্যাডারের লোকজনকে পদানত করার ব্যবস্থা করেছেন।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলেন শেখ হাসিনা। তিনি এক সাবেক আমলা এইচ টি ইমামকে হাতে নিলেন এবং তাঁকে আসল দুটি পদ– রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উপদেষ্টা পদে বসালেন। এর ফলে আমলারা সব যুগের বন্ধন ছিন্ন করে সরকারের সমুদয় গুরুত্বপূর্ণ পদ কুক্ষিগত করে নেন। তারা বানের জলের মতো সব জায়গায় ঢুকে পড়েন। এই আমলাদের সাহায্যেই একের পর এক জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচন করে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকেন তিনি। এর পরিণামস্বরূপ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাছাড়া হয়ে দেশত্যাগ করেন।
আমার মতে, এই জয় অব্যাহত রাখতে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব এবং প্রধান সংস্কারের বিষয় হলো, প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের অবৈধভাবে দখল করা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে বসিয়ে দেওয়া। এটি না হলে অর্থাৎ সিভিল সার্ভিসে প্রশাসন ক্যাডারের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে না দিলে প্রশাসন সংস্কার পূর্ণতা পাবে না।
সংস্থাপন বিভাগ (জনপ্রশাসন), কেবিনেট ডিভিশন এবং ২৬ ক্যাডারের সমুদয় মন্ত্রণালয় জবরদখল করে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা সরকারের মধ্যে এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এরফলে অতীতে তারা বিভিন্ন সরকারকে তাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য করেছে। ভবিষ্যতেও যে এর পুনরাবৃত্তি হবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কাজেই অন্তত ২৬ ক্যাডারের মন্ত্রণালয়গুলো ২৬ ক্যাডারকেই ছেড়ে দেওয়া অতিশয় মঙ্গলজনক।
প্রফেসর মো. আসাদুজ্জামান: স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২৬ ক য ড র র ষ ট রপত ক ষমত য় র রহম ন মন ত র র জন য আমল র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বেনাপোল সীমান্তে শিশুসহ আটক ১৪
যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার ধান্যখোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় শিশুসহ ১৪ বাংলাদেশিকে আটক বিজিবি।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। আটকরা দেশের নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা।
যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, অবৈধ পথে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় ধান্যখোলা বিওপি’র জেলেপাড়া পোস্টের টহল দলের বিজিবি সদস্যরা শিশুসহ ১৪ জন বাংলাদেশি নারী-পুরুষকে আটক করেছেন। আটকদের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা দিয়ে বেনাপোল পোর্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিএইচ