ইলন মাস্ক যেভাবে বিশ্বের ১ নম্বর সমস্যা হয়ে উঠলেন
Published: 9th, February 2025 GMT
ইলন মাস্ক এখন শুধু প্রযুক্তি ব্যবসায়ী নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও একটি বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তাঁর কিছু কর্মকাণ্ড ও মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁর একটি অঙ্গভঙ্গিকে অনেকেই ‘নাৎসি সালাম’ বলে মনে করেছিলেন।
তিনি মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিকে ‘অপরাধী সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে এটির ‘মৃত্যু’ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া তিনি নতুন সরকারি বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির (ডজ) প্রধান হিসেবে কঠোর ব্যয় সংকোচনের নীতি অনুসরণ করছেন, যা অনেকের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নেই। তিনি কট্টর ডানপন্থী ট্রাম্প ও তাঁর মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) আন্দোলনকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছেন। তিনি এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া মাস্ক তাঁর ‘বিশ্বভ্রমণ’ শুরু করেছেন। তিনি চরম ডানপন্থী মতাদর্শ উসকে দিচ্ছেন এবং যুক্তরাজ্যে তাঁর অনুগত উগ্রপন্থী নেতাদের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছেন।
গত এক বছরে মাস্ক যুক্তরাজ্যের কট্টর ডানপন্থী ব্যক্তিদের (যেমন টমি রবিনসন ও নাইজেল ফারাজ) বারবার সমর্থন দিয়েছেন। জানুয়ারির শুরুতে তিনি আবারও ‘ফ্রি টমি রবিনসন!’ লিখে টুইট করেন এবং রবিনসনের বিতর্কিত তথ্যচিত্র ‘সাইলেন্সড্’-এর লিংক শেয়ার করেন। ওই তথ্যচিত্রে রবিনসন ভুলভাবে দাবি করেন, সিরীয় শরণার্থী কিশোর জামাল হিজাজি ইংরেজ স্কুলছাত্রীদের আক্রমণ করেছিল এবং এক সহপাঠীকে ছুরিকাঘাতের হুমকি দিয়েছিল।
২০১৮ সালে ইয়র্কশায়ারের এক স্কুলে জামাল হিজাজিকে মারধরের একটি ভিডিও ভাইরাল হলে টমি রবিনসন একই ধরনের দাবি করেছিলেন। তিনি ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন, যা ১০ লাখের বেশি মানুষ দেখেছিল। ফলে হিজাজির পরিবার মৃত্যুর হুমকির মুখে পড়ে।
পরবর্তী সময় মার্কিন ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত টমি রবিনসনের বিরুদ্ধে জামাল হিজাজি মানহানির মামলা করেন। সে মামলায় রবিনসন পরাজিত হন। আদালত হিজাজিকে ১ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড (প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে এবং ৫ লাখ পাউন্ড (প্রায় ৬ লাখ ২৬ হাজার ডলার) আইনগত খরচ বহন করতে নির্দেশ দেন রবিনসনকে। পাশাপাশি তাঁকে হিজাজির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে পুনরাবৃত্তি করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
টমি রবিনসন ‘সাইল্যান্সড্’ নামের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে আবারও জামাল হিজাজির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন। তিনি এটি লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে দেখান এবং অনলাইনে ছড়িয়ে দেন, যা আদালতের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে। এ জন্য তাঁকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু ইলন মাস্ক এসব উপেক্ষা করে রবিনসনকে সমর্থন করেন। তিনি এ ঘটনাকে ব্যবহার করে প্রচার করতে চান, পশ্চিমা দেশে ব্যাপক অভিবাসন নারীদের জন্য হুমকি। এ ধারণা ব্রিটেনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর মাস্ক সেটাকেই কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন।
গত গ্রীষ্মে এক রুয়ান্ডান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি তিনজন ব্রিটিশ কিশোরীকে হত্যার পর যুক্তরাজ্যে সহিংস অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ ও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তবে আসল উত্তেজনা তৈরি হয় মিথ্যা প্রচারের কারণে, যেখানে কট্টর ডানপন্থীরা, বিশেষ করে টমি রবিনসন, ভুল তথ্য ছড়িয়ে দাবি করেন, হত্যাকারী আল সাকাতি নামের ১৭ বছর বয়সী একজন আশ্রয়প্রার্থী।
এ ছাড়া ব্রিটেনে এক দশক ধরে আলোচিত ‘গ্রুমিং গ্যাং স্ক্যান্ডাল’কেও (এমন একটি প্রচারণা যেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পুরুষেরা শ্বেতাঙ্গ কিশোরীদের নিপীড়ন করেছে) মাস্ক ও কট্টর ডানপন্থীরা বর্ণবাদী ও অভিবাসনবিরোধী প্রচারণার জন্য ব্যবহার করছেন।
২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওল্ডহ্যামে তথাকথিত ‘গোপন তথ্য লুকানোর’ ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মাস্ক সত্যকে উপেক্ষা করে ‘গোপন তথ্য লুকানোর’ ধারণা ছড়িয়ে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন।
সম্প্রতি মাস্ক দাবি করেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার (যিনি ২০০৮-২০১৩ সালে ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস, সংক্ষেপে ‘সিপিএস’ পরিচালনা করেছেন) ‘দলবদ্ধ ধর্ষণের’ বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। টুইটে তিনি লেখেন, ‘স্টারমার ব্রিটেনের ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগী ছিলেন এবং তাঁর বিচার হওয়া উচিত।’
মাস্ক যুক্তরাজ্যের উপমন্ত্রী জেস ফিলিপসকে ‘ধর্ষণের সমর্থক’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং রাজা চার্লসকে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
মাস্কের টুইট ও টমি রবিনসনের মতো ব্যক্তিদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন হয়তো যুক্তরাজ্যে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন আনবে না, তবে তিনি স্পষ্টভাবেই দেশটিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কট্টর ডানপন্থার উত্থানের ক্ষেত্র তৈরি করছেন।
মাস্ক তাঁর বিশ্বব্যাপী কট্টর ডানপন্থা উসকে দেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জার্মানিতেও হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি দেশটির কট্টর ডানপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) প্রকাশ্য সমর্থক হয়েছেন। ডিসেম্বরের শেষ দিকে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এএফডিকে জার্মানির ‘শেষ আশার আলো’ বলে উল্লেখ করেন। সে লেখায় তিনি বলেন, অভিবাসন সীমিত করার মাধ্যমে দলটি দেশকে নিরাপদ রাখতে ও জার্মান সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারবে।
জানুয়ারির শুরুতে মাস্ক এক্সে এক সরাসরি আলোচনায় এএফডির নেতা অ্যালিস ভিডেলের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, শুধু এএফডি–ই দেশকে অভিবাসনজনিত অপরাধ বৃদ্ধির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। ভিডেলও বিতর্কিত মন্তব্য করে বলেন, হিটলার আসলে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক ছিলেন।
জানুয়ারির শেষ দিকে মাস্ক ভিডিও লিংকের মাধ্যমে জার্মানির হাল্লেতে এএফডির এক সমাবেশে বক্তৃতা দেন। সেখানেও তিনি এএফডিকে জার্মানির ভবিষ্যতের ‘সর্বশেষ আশা’ বলে অভিহিত করেন।
এই প্রকাশ্য সমর্থন এবং ভিডেলকে প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার মাধ্যমে মাস্ক সম্ভবত এএফডিকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ট্রাম্পের মতো জয়ী করতে সাহায্য করতে চাইছেন।
ট্রাম্প কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানে ভূমিকা রাখছেন। তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যেখানে মাস্কও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন।
এ ছাড়া মাস্ক প্রকাশ্যে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেয়ির প্রশংসা করেছেন। মিলেয়ির কঠোর অর্থনৈতিক নীতিগুলো তার ‘ডজ’ নীতির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মিলেয়ি ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন।
গত সেপ্টেম্বরে মাস্ক এল সালভাদরের বিতর্কিত নেতা নায়িব বুকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নায়িব বুকেল কঠোর অপরাধ দমন নীতি ও গণহারে লোকজনকে জেলে পাঠানোর জন্য বিশাল কারাগার বানানোর জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এখন খবর পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডিত অপরাধীদের বুকেলের কারাগারে পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে। বুকেলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফি নিয়ে তাদের কয়েদিদের রাখার মাধ্যমে তিনি নিজের কারাগারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চান।
মাস্কের ডানপন্থী প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে তিনি কোনো মন্তব্য না করলেও কিছু দেশে তা প্রভাব ফেলছে। পোল্যান্ডে এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোটার মাস্ক–সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
এটি ঠিক, মাস্কের বৈশ্বিক ডানপন্থী বিপ্লবের প্রচেষ্টা এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। তাঁর কিছু পদক্ষেপ সফল হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে তিনি হয়তো যে রকম প্রভাব চাচ্ছেন, তা না–ও হতে পারে। তবে এটি চিন্তার বিষয় যে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে মাস্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছেন।
সোমদীপ সেন রস্কিল্ড ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অধ্যয়নের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ড নপন থ র জন ত ক কর ছ ল কর ছ ন র জন য অপর ধ করছ ন সমর থ
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়বে না
আমাদের বিকাশের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা শিক্ষার নিম্নমান। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের ভাবতে হচ্ছে, আমরা কি অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তির ওপর ভর করেই চলব? এমনকি আমাদের দেশের ভালো ব্যবস্থাপকের কাজও কি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছে চলে যাবে?
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম থাকবে দেশের। তবে সে পথ যে খুব বেশি মসৃণ হবে না, তা বোঝা যায় শিক্ষার মান ও শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা দেখে।
শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ভিন্ন বিষয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৯, ১৯৭১ সালে যা ছিল ১৬ দশমিক ৮। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলাদক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম বারবার পরিবর্তন। তৃতীয়ত, একমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাব। চতুর্থত, শিক্ষা প্রশাসনে ন্যূনতম জবাবদিহির অভাব। শিক্ষকদের দুষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার।
ইউনেসকোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বরাদ্দ ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া দেশগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে কোনো আপস করেনি। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হওয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হচ্ছে না, তেমনি বেহাল কারিকুলামের। বারবার পরিবর্তন হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বিনিয়োগ কম ও কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহের অভাব থাকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অনেক পিছিয়ে।
দেশের শিক্ষা খাতে সিংহভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে ব্যয় হয় যৎসামান্যই। কিছুটা থাকলেও গবেষণায় নিবেদিত লোক পাওয়া যায় না। বিশ্বব্যাপীই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল ভালোভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছে।
বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে আরও প্রায় এক যুগ আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালে। ২০৪০ সালে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা শেষ হবে ২০৫০ সালে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা।
এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বাড়ালেই হবে না; মানসম্মত ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
কর্মক্ষম প্রত্যেক মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে শিক্ষায় বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কারণে আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকেও পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে অন্তত ১১ ধরনের। ধরনভেদে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমেও রয়েছে ভিন্নতা।
স্বাধীনতার এত বছর পরও ইংরেজি, বাংলা আর মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে আমরা ন্যূনতম সমন্বয় সাধন করতে পারিনি। অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের দেশেও জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে স্বল্প বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই নিয়মিতভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তাঁরা এখানে যথার্থই বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলেন।
স্বল্প রাজস্ব আয়ের দেশে এটা তো অবশ্যই বিরাট সমস্যা। তবে এটাও বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, বরাদ্দের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বরাদ্দের টাকার গুণগত ব্যবহার এবং ব্যবহারে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। শিক্ষা খাত যেখানে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই জাতি তার অগ্রগতিকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক