এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৪ থেকে ১৬ টাকা। ক্ষেত থেকে তা বেচা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। এক কেজি আলুতে লোকসান ৫ টাকার কাছাকাছি। লোকসান থেকে বাঁচতে উৎপাদন মৌসুমে আলু না বেচে কৃষকরা সাধারণত হিমাগারে রাখেন। এবার তা রাখতে পারছেন না। গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১ টাকা বাড়িয়ে এবার হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হয়েছে। এতে কৃষককে বাড়তি গুনতে হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৫০টি হিমাগার চালু রয়েছে। এসব হিমাগারে আলুর ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টন (৩০০ কোটি কেজি)। ৮ টাকা কেজি ভাড়া হলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মোট দিতে হবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা হিমাগারে আলু রাখতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এ ছাড়া হিমাগার মালিকরা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফা ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন কৃষকরা।

চিঠি দিয়ে ভাড়া বাড়ানো
রংপুর হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, ২০২১ সালে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৫ টাকা। ২০২২ সালে সাড়ে ৫ টাকা, ২০২৩ সালে ৬ টাকা এবং গত বছর ৭ টাকা ছিল।

চলতি বছর বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে এরই মধ্যে জেলায় জেলায় চিঠি পাঠিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার প্রামাণিকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, হিমাগারের বিপরীতে নেওয়া ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ খরচ, লোডিং-আনলোডিং ও পাল্টানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন, বোনাস, বীমা খরচ, গ্যাস বিল, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিশ্লেষণ করে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা। তার পরও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৮ টাকা।

একই সঙ্গে তারা বলেছে, গত বছর ব্যাংক সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশ হয়েছে। যদিও বিদ্যুতের বিল অপরিবর্তিত রয়েছে।

কৃষকদের দাবি, আগে আলু রাখা হতো বস্তা হিসেবে, কেজি হিসেবে নয়। এবার বস্তা হিসেবে রাখতে দিচ্ছে না হিমাগার। আগে প্রতি বস্তা ভাড়া ছিল ৩২০-৩৫০ টাকা। এক বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত রাখা যেত। এবার প্রতি বস্তায় ৫০ কেজির বেশি রাখা যাবে না। ভাড়া পড়বে ৮ টাকা হিসেবে ৪০০ টাকা।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘সব সময় হিমাগারের ভাড়া কেজিতে নির্ধারিত ছিল, বস্তাপ্রতি নয়। সংরক্ষণকারীরা এটা মানতেন না। তারা প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৩০ কেজি বাড়তি আলু রাখতেন। এতে কৃষকের লাভ হলেও লোকসান হতো হিমাগার মালিকের। তাই এবার কঠোর হয়েছি আমরা।’

বগুড়া ও জয়পুরহাটে ৫৫ হিমাগার, চাহিদার এক-চতুর্থাংশ
হিমাগার মালিকরা জানান, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ৫৫টি হিমাগার রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আলু সংরক্ষণ শুরু হবে। মৌসুমে ১০-১২ দিনে একটি হিমাগার আলুতে ভরে যায়। এত অল্প সময়ে ২ লাখ টন আলু মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু বের করা হয় আস্তে আস্তে। কোনো কোনো হিমাগার থেকে আলু বের হতে ছয় থেকে আট মাস লাগে। তাই এবার হিমাগারের ভাড়া নেওয়া হবে আলু বের করার সময়। গত বছরও আলু রাখার সময় ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

এ দুই জেলায় এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টন (২১৩ কোটি ১৫ লাখ কেজি)। এর মধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৭ লাখ ৫০ হাজার টন (৭৫ কোটি কেজি)। ভাড়া বাড়ানোয় শুধু এ দুই জেলায় বাড়তি গুনতে হবে ৭৫ কোটি টাকা।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, এক বিঘা জমিতে ৮০ থেকে ৯০ মণ আলু হয়। যদি প্রতি কেজি ১০-১২ টাকা দরে বেচি, তাহলে লাভ তো দূরের কথা খরচ উঠবে না। আবার ক্ষেতে না বেচে যে হিমাগারে রাখব, সেই সুযোগ বন্ধ।

জয়পুরহাটের কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, হিমাগার মালিকরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ভাড়া বাড়াচ্ছেন। এবারও বাড়িয়েছেন। আমরা মাঠে ঘাম, শ্রম ঝরিয়ে ফসল ফলিয়ে লোকসান করব, আর তারা বসে থেকে সেই ফসলের ফায়দা লুটবেন– এটি সিন্ডিকেট ছাড়া আর কিছু নয়।

বটতলী বাজারের ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, হিমাগার ভাড়া যত বাড়বে, ব্যবসায়ীরা তত বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। আর এর চাপ পড়বে ভোক্তাদের ওপর। প্রশাসনের এখনই হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর এ দুই জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় হিমাগার সংখ্যা কম। এ  কারণে মালিকরা সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে।

জয়পুরহাটের কৃষক কামাল হোসেন বলেন, যখন আমরা আলু বিক্রি করি, তখন দাম থাকে না। পরে যখন দাম বাড়ে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করে। এখন হিমাগারেও রাখতে পারছি না, কারণ ঘোষিত ভাড়ায় আলু রাখা সম্ভব নয়।

বগুড়ার শিবগঞ্জের কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, এত টাকা দিয়ে আলু রেখে পরে বেচলেও লাভ হবে না। তাহলে কী করব?

কৃষকরা দাবি করছেন, সরকার যদি সরাসরি তাদের কাছ থেকে আলু কিনে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করত এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করত, তাহলে সংকট কিছুটা কমত।

রংপুরে বেকায়দায় কৃষক
রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ বছর এক লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টন। কৃষি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সাতমাথার ক্ষুব্ধ চাষি আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘দাম না পাওয়ায় আলু আবাদ করি এবার হামার কোমর পড়ি গেইচে বাহে। লাভের আশায় হিমাগারোত থোমো তারও বুদ্দি নাই। ওমরা ভাড়া বাড়াইচে। মরণ ছাড়া হামার কৃষকের কোনো পথ নাই।’

রংপুরের আলু ব্যবসায়ী আরমান আলী অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে দাম না থাকলেও এবারে আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ কারণে হিমাগার মালিকরা ভাড়া বাড়িয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

বগুড়া জেলা কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন জানান, হিমাগারে আলু রাখার ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। শ্রমিক খরচ ও বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে কৃষকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ বাজারে এখন কম দাম হলেও পরে দাম বাড়ে।

জয়পুরহাট কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, সংরক্ষণ ভাড়া বাড়লে এর চাপ ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা আলুর দাম বাড়িয়ে দেবেন। আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। সব পক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা হবে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, এ বছর শুধু ব্যাংকের সুদহার বাড়ার কারণে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে ব্যয় বেড়ে ৫ দশমিক ৮ টাকা দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতে ব্যয় হয় ১ দশমিক ১০ টাকা। অথচ গত বছর সব খরচ মিলিয়ে ব্যয় ছিল কেজিতে ৬ টাকা। 

জেলা প্রশাসনের বাণিজ্য শাখার শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ হিমাগার বা কোল্ডস্টোরেজের লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন করে থাকে। আর পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। জানতে চাইলে বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, ‘হিমাগার মালিকদের সঙ্গে কথা বলব। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।’

প্রতিবাদ কর্মসূচি

এদিকে, ভাড়া কমানো এবং বস্তা হিসাবে আলু রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন। তারা আগামী সোমবার রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। তাদের দাবি, অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য ১০০ টাকা আদায় বন্ধ, প্রতি কেজি আলুর ভাড়া দেড় টাকা নির্ধারণ, অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগে প্রতি উপজেলায় বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণ এবং হিমাগারে প্রকৃত কৃষকের জন্য ৬০ ভাগ জায়গা বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন রংপুরের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, ‘আলু চাষ করে যে সময় চাষিরা বিশাল অঙ্কের লোকসান গুনছে, ঠিক সে সময় হিমাগার ভাড়া বাড়ানো কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এতে ঠিক আগের মতোই হিমাগার মালিকসহ ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন ঠিকই; চাষিরা বঞ্চিতই থাকবেন।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল হ ম গ র ম ল কর হ স ন বল ন ব যবস য় গত বছর

এছাড়াও পড়ুন:

সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের লভ্যাংশ ঘোষণা

সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স পিএলসির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩ টাকা ০৮ পয়সা।

এছাড়া, ৩০ জুন ২০২৪ শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সমন্বিত সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ১৫ পয়সা।

এই লভ্যাংশ অনুমোদনের জন্য আগামী ২৪ মার্চ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করবে কোম্পানিটি। এর জন্য রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি।

 

এসকেএস

সম্পর্কিত নিবন্ধ