কিছু ভালো লাগছে না, সৌম্যদ্বীপ অঙ্ক কষতে বসে যায়। আবার ভালো লাগছে, সে অঙ্কই কষে। মা সোমা রানী দের ভাষায়, ‘ছেলে অঙ্ক করতে খুব পছন্দ করে।’ এবার ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উত্সব’-এ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শেষ হলো দুদিনব্যাপী চলা জাতীয় গণিত উত্সব ২০২৫। প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের আনন্দ–উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২৩তম এই উৎসবের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী পর্ব।
এবারের উৎসবে সারা দেশের ১৮ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭৫ হাজার ৫৯৬ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছে। তার মধ্যে ১৫টি আঞ্চলিক গণিত উৎসবের ১ হাজার ২০০ বিজয়ীকে নিয়ে শুক্রবার থেকে চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিজয়ী হয় ৮৫ জন। যাদের মধ্য থেকে কয়েক ধাপে বাছাই শেষে নির্বাচিত একটি দল বাংলাদেশ থেকে আগামী জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় ৬৬তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে।
সমাপনী দিনের সকাল শুরু হয়েছিল রুবিকস কিউব মেলানোর মধ্য দিয়ে। এই প্রতিযোগিতা দুটি পর্বে হয়। এরপর ব্যান্ড ‘এসেইস’ তিনটি গান পরিবেশন করে।
মঞ্চে এসে গত জানুয়ারিতে ২৬তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জেতার অভিজ্ঞতা শোনায় আট বছরের আরিয়েত্তি ইসলাম। সে জানায়, তার রোবট বানাতে ভালো লাগে। আর এ জন্য তাকে গণিতও শিখতে হচ্ছে। এ ছাড়া তামজিদ রহমান ‘ব্লাডলিংক’ নামে একটি অ্যাপ বানানোর অভিজ্ঞতা শোনায় শিক্ষার্থীদের। রক্তদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরির এই অ্যাপের জন্য গত বছর তিনি পেয়েছেন ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড।
একেক পর্ব শেষ হচ্ছিল আর মঞ্চ থেকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষার ফল নিয়ে আসবেন বিচারকেরা। শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম মজার বিষয় ছিল স্বপন দিনারের জাদু। এরপর মুখ দিয়ে নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ বিটবক্সিং করে ‘বিটমসফিয়ার’-এর সদস্যরা। একপর্যায়ে মঞ্চে আগত অতিথি ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, এই প্রতিযোগিতা শুধু গণিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার চর্চার জন্য নানা প্রতিযোগিতা ও কর্মশালা থাকে।
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, বাইরের জগতের দিকেও তাকাতে হবে। আইনস্টাইন বলেছেন, জ্ঞানের চাইতে কল্পনার জগৎ মূল্যবান। এ জন্য চারদিকে সবকিছুর দিকে তাকাতে হবে। প্রকৃতির কাছে যেতে হবে। এ ছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের ‘মাদক’, ‘মিথ্যা’ ও ‘মুখস্থ’—এই তিনকে ‘না’ বলান।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস দীর্ঘ যাত্রায় যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানান।
বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ অধ্যাপক মাহবুবুল আলম মজুমদার অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষার্থীদের বেশি চাপ দেবেন না। এই প্রতিযোগিতা মজার অভিজ্ঞতা অর্জনের। এটার জন্য কোচিং করার মতো বিষয়ে চাপ দেওয়া যাবে না। গণিতের পাশাপাশি পদার্থবিজ্ঞান ও প্রোগ্রামিংও শেখার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি আবদুল হাকিম খান, সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম আলো ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী মুনির হাসান। কমিটির সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া শরমিন খালেক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার দেব, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, টালিখাতার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত খান, সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও পেরেরা এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ফারজানা আলম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সেলর জাহিদ হোসাইন খান।
পদকজয়ী যারাএবার চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস হয়েছে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে নারায়ণগঞ্জের এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সৌম্যদ্বীপ দাস, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের আবরার জাহিদ পাঠান। একই সঙ্গে সৌম্যদ্বীপ প্রাইমারি ও জুনিয়র ক্যাটাগরির মধ্য থেকে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অলিম্পিয়াড হয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কারও পেয়েছে। এ ছাড়া সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোহাম্মদ মারজুক রহমান এবং হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম কলেজের মো. রায়হান সিদ্দিকী।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্মৃতি পুরস্কারের মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে চট্টগ্রাম কলেজের মো. রায়হান সিদ্দিকী, জেবুন্নেসা হাশেম পুরস্কার আগা খান একাডেমির ফাতিমাহ শেখ, জামিলুর রেজা চৌধুরী নান্দনিক সমাধান ও তাজিমা এইচ মজুমদার পুরস্কার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মনামী জামান, আবিদ রেজা স্মৃতি পুরস্কার মতিঝিল সরকারি বয়েজ হাইস্কুলের প্রজেশ ভৌমিক, এম সেকেন্দার আলি স্মৃতি পুরস্কার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের এহাব ফারাজ ভুঁইয়া, গৌরাঙ্গ দেব রায় স্মৃতি পুরস্কার রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মো. জামিউল হোসেইন, সজল-কাজল স্মৃতি পুরস্কার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সাইফান সাওয়াদ, প্রকৌশলী লুৎফর রহমান স্মৃতি পুরস্কার বাকালিয়া সরকারি কলেজের জিতেন্দ্র বড়ুয়া ও খোদাদাদ খান স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের মো. নাফিস নূর তাসিন।
পদকজয়ী ও বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে অতিথিরা সনদ, ক্রেস্ট, মেডেল ও টি-শার্ট তুলে দেন।
প্রাইমারি ক্যাটাগরির বিজয়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সৌম্যদ্বীপ দাস প্রথম আলোকে বলে, ‘গণিত একটি আর্ট। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের গণিত অনুশীলন করি। গণিত ছাড়াও পদার্থবিজ্ঞান ভালো লাগে। আমি এআই নিয়ে কাজ করতে চাই।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কল জ র ম
এছাড়াও পড়ুন:
নববর্ষের শোভাযাত্রায় থাকছে ২৭ নৃগোষ্ঠীও
সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আয়োজিত হবে এবারের চৈত্রসংক্রান্তি এবং বর্ষবরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় নববর্ষের শোভাযাত্রায় বাঙালিসহ অংশ নেবে ২৭ নৃগোষ্ঠীও। এ ছাড়া দুই শতাধিক তরুণ মিউজিশিয়ান গিটার ও ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে হাজির হবেন এই শোভাযাত্রায়।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর বড় পরিসরে চৈত্র বিদায় ও বাংলা নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবের আয়োজন করেছে সরকার। এবারের নববর্ষের আয়োজনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি হতে যাচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক। তার জন্য প্রস্তুত পাহাড় থেকে সমতল– পুরো দেশ।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, এবার পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক উৎসব নতুন মাত্রায় উদযাপন করা হবে।
রাজধানী ও সারাদেশের চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষে কী কী আয়োজন রয়েছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, আমাদের উৎসবটা এবার চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু হচ্ছে। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ঢাকা শহরে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে কনসার্ট হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ বছর পহেলা বৈশাখে সুরের ধারার প্রভাতি আয়োজনটি হবে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে। ছায়ানট রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে ভোর সোয়া ৬ টায়। এ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীকে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে সম্পৃক্ত করে পাহাড়ের বৈশাখী আয়োজনে বিস্তৃত করা হচ্ছে। আগামী ১৩ এপ্রিল দেশের ১২টি জেলার আধ্যাত্মিক ধারার সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সন্ধ্যায় নবপ্রাণ আন্দোলন রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ‘বাংলার উৎসব’ শিরোনামে বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
পহেলা বৈশাখের দিন বিকেল ৩টায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বৈশাখী ব্যান্ডশোর আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ড্রোন শোতে ফুটিয়ে তোলা হবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এতে সহযোগিতা করছে চীন দূতাবাস।
পহেলা বৈশাখের সকাল থেকে বাংলা একাডেমিতে বিসিক আয়োজন করছে বৈশাখী মেলা। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে শুরু হবে ১৫ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
আগের দিন থেকে ৩০টি জেলায় শুরু হবে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী লোকনাট্য উৎসব। ১৫ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১২টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শিত হবে অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী।
এর আগে দুপুর ১২টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা সেমিনার কক্ষে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংস্কৃতি উপদেষ্টা ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন, বাংলা ব্যান্ড মিউজিশিয়ান্সের পক্ষ থেকে ওয়ারফেজ ব্যান্ডের সদস্য শেখ মনিরুল আলম টিপু ও বিভিন্ন ব্যান্ড দলের সদস্য।
এতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, এ বছর পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় প্রথমবারের মতো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীসহ দুই শতাধিক ব্যান্ড মিউজিশিয়ান অংশগ্রহণ করবেন। ব্যান্ড মিউজিশিয়ানরা পৃথিবীর শান্তি কামনায়, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য সম্মিলিতভাবে একটি গান গাইবেন।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ১৩ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হবে ‘ব্যান্ড শো’। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড দলগুলো।