নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণাসহ বিভিন্ন দাবিতে সারা দেশের জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে সভা-সমাবেশ করবে বিএনপি। আগামী মঙ্গলবার থেকে পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শনিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
রিজভী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে উত্তরণের জন্য নির্বাচনী রূপরেখা ঘোষণার দাবিতে এবং পতিত ফ্যাসিবাদের নানা চক্রান্তের অপচেষ্টা মোকাবিলাসহ বিভিন্ন জনদাবিতে এই কর্মসূচি হবে। তিনি আরও বলেন, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্টদের সহযোগীরা এখন প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। যারা ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি, এমন লোকদের চিহ্নিত করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সফল হওয়া কঠিন।

রিজভী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্ধৃত করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সব পদক্ষেপ সবার কাছে সাফল্য হিসেবে বিবেচিত না–ও হতে পারে। কিন্তু এই সরকারের ব্যর্থতা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা হিসেবেই পরিগণিত হবে। এ কারণে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল দেখতে চায়। কিন্তু সরকার নিজেদের সফল দেখতে চায় কি না, এটিও ভাবার বিষয় রয়েছে। সরকারের ‘কর্ম–পরিকল্পনার রোডম্যাপে’ কম গুরুত্তপূর্ণ ইস্যু বাদ দিয়ে জনগণের নিত্যদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

‘গাজীপুরের জাহাঙ্গীর মাস্টারপ্ল্যানারদের একজন’

রুহুল কবির রিজভী বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে এবং ষড়যন্ত্রমূলক অডিও রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক উসকানি প্রদান করছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার উসকানিতে ইতিমধ্যে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সারা দেশে গুপ্ত হামলা, ঝটিকা মিছিল ও গণসংযোগ শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর নারকীয় আক্রমণ চালিয়েছে। ১৫ জনের বেশি গুরুতর জখম হয়েছেন।

পতিত সরকারের গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর ফ্যাসিস্টদের নিয়ে ভার্চ্যুয়ালি মিটিং করে বলেছেন, ‘যে শহরে আমরা দিনের বেলা ঘুরতে পারি না, সে শহরের কাউকে আমরা ঘুমাইতে দেব না।’ আওয়ামী লীগের নয়া প্রজেক্টের মাস্টারপ্ল্যানারদের একজন সে। এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা।

‘বেনজীর ষড়যন্ত্রমূলক সভা করছেন’

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সে ষড়যন্ত্রমূলক সভা করছেন বলে উল্লেখ করেন রিজভী। তিনি বলেন,  রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেনজীরের গোপনীয় ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের খবর প্রকাশ্যে আসার পরও প্রশাসন নির্বিকার। বেনজীরের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

‘আওয়ামী দুর্বৃত্তদের বিচারে সরকার কঠোর নয়’

রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, গত ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যাকারী আওয়ামী দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়ে যতটা কঠোর হওয়া দরকার ছিল, উল্টো বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই গণহত্যার বিচার হতে হবে। কিন্তু আসামিদের গ্রেপ্তার, জেলে ও দেশের বাইরে রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র আওয় ম ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলা কেন বিভ্রান্তিকর

২ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড কি জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক আরিফ রহমান প্রবন্ধটিতে দাবি করছেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট সময়ে সংঘটিত সহিংস নিধনযজ্ঞকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত’...বা ‘একাডেমিক ও নৈতিক যুক্তিতে এ ঘটনা যে গণহত্যা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

লেখক জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করলেও নামজাদা কয়েকজন গবেষকের সংজ্ঞা ও মডেল ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আরিফের লেখার মূল যে স্পিরিট—‘রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ যে কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঘটনাই তার এক গভীর শিক্ষা’-এর সঙ্গে পরিপূর্ণ একমত হয়েও তাঁর অবস্থানের আইনি/যৌক্তিক দুর্বলতা ও এর সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কা থেকে এই লেখার অবতারণা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ‘গণহত্যা’ শব্দের দুই ধরনের ব্যবহার রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ‘গণহত্যা’ দিয়ে আসলে বোঝানো হয়ে থাকে একসঙ্গে একের অধিক মানুষকে হত্যা করা; সেখানে ইংরেজি ‘ম্যাসাকার’ বা ‘মাসকিলিং’ অর্থে এটা ব্যবহৃত হয়।

ষাটের দশক থেকে আজতক এ ভূখণ্ডে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যেখানে একের অধিক লোক মারা গেছেন, সব কটাকেই রাজনৈতিক পরিসরের জনপ্রিয় বুলিতে ‘গণহত্যা’ বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা সংঘটনের বহু আগেও যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতা/হত্যাযজ্ঞ বোঝাতে ‘গণহত্যা’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তেমনি বর্তমানে পিলখানা বা শাপলার রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ সম্বোধনও বহুল প্রচলিত। এখানে গণহত্যা ও মাসকিলিং আসলে সমার্থক।

 এর বাইরে দ্বিতীয় আরেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে: ‘জেনোসাইড’ অর্থে। ‘জেনোসাইড’–এর অর্থ ও সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইন বা জেনোসাইড কনভেনশনে খুবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অভিধান থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ‘জেনোসাইড’–এর পরিভাষা হিসেবেও ‘গণহত্যা’ ব্যবহারের চল রয়েছে।

কিন্তু আইনে জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যে কয়েকটা অপরাধমূলক কাজ বা অ্যাক্টকে জেনোসাইড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাতে হত্যা বা মাসকিলিং আরও অনেকগুলো অপরাধের একটি। সেখানে দেখা যায়, কাউকে ‘হত্যা’ না করেও আসলে ‘জেনোসাইড’ চালানো সম্ভব, কেননা সেখানে হত্যার বাইরে আরও কিছু অপরাধমূলক কাজের উল্লেখ রয়েছে, যেমন, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন বা জোরপূর্বক জন্মদানে বাধা প্রদান বা এক গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।

কিন্তু ‘গণহত্যা’ ব্যবহার করলে কেবল ‘হত্যা’কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অনেকেই জেনোসাইডের পরিভাষা হিসেবে গণহত্যা ব্যবহার না করে সরাসরি জেনোসাইড বা গোষ্ঠীনিধন/বা জাতিনিধন বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আরিফ রহমান তাঁর কলামে চব্বিশের হত্যাকাণ্ডকে যে ‘গণহত্যা’ বলতে চান, সেটা আসলে ‘জেনোসাইড’ অর্থে। রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ইতিমধ্যে এটা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু ‘জেনোসাইড’ অর্থে একে ‘গণহত্যা’ বলাটা বিভ্রান্তিকর। কেন, সেটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রথমত, ‘জেনোসাইড’ হচ্ছে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অপরাধ। আরিফ রহমানও বলছেন, ‘একটি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত অভিযান’। ‘জেনোসাইড’ শব্দের প্রবর্তক রাফায়েল লেমকিন থেকে শুরু করে জেনোসাইড কনভেনশন হয়ে প্রায় প্রত্যেক গবেষক পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত।

১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে যখন এই আইন চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন বহু বাহাসের পর গোষ্ঠীর চারটি বর্গকে ‘সুরক্ষিত গোষ্ঠী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে: জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী; অর্থাৎ, এই চার বর্গের কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা পূর্ণ ধ্বংস করার নিয়তে (ইনটেনশন) যদি কিছু নির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজ করা হয়, তাহলে সেটা জেনোসাইড হবে।

এই ‘গোষ্ঠী পরিচয়’–এর নির্দিষ্টতাই অপরাপর অপরাধ থেকে একে পৃথক করে। আন্তর্জাতিক আইনে কেন ‘রাজনৈতিক’ বর্গ নেই, সেটা নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, লিও কুপারসহ সবাই বাস্তবিক কারণেই এই আইনকে আলাপের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে থাকেন।

এখন চব্বিশের ঘটনায় ভিকটিমরা (ভুক্তভোগী) আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার আওতায় পড়েন না। অর্থাৎ, কেবল জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে কেউ হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হননি। আরিফ রহমান সে কারণে আন্তর্জাতিক আইন ধরে আলাপ না করে বিভিন্ন গবেষকের মারফতে আলোচনা করেছেন, যাঁরা ‘রাজনৈতিক’ বর্গের অনুপস্থিতির কারণে জেনোসাইডের সংজ্ঞার সমালোচনাও করেছেন বা তাদের আলোচনার সুবিধার্থে সংজ্ঞাকে খুবই শিথিল আকারে ব্যবহার করেছেন।

আরিফ যে গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ৮টি (পরে স্ট্যান্টন আরও দুটো ধাপ বাড়িয়েছিলেন) ধাপের মডেল ব্যবহার করেছেন, সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টনও কিন্তু কনভেনশনের সংজ্ঞা ও পরিচয়ের ওই চারটি বর্গকে কবুল করেই আলোচনা করেছেন। তিনি কেবল জেনোসাইডকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে কিছু ধাপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেন এটা আগে থেকে মোকাবিলা করা যায়।

অন্যদিকে, আরিফ যদি গবেষকদের বরাত দিয়ে ‘রাজনৈতিক’ বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করতেও চান, তাহলেও চব্বিশের সহিংসতাকে এটাতে আটানো সম্ভব হবে না। কারণ, কোনো নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ছিল না।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই ছিল, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যানারের বাইরে গিয়ে এটা সংঘটিত হয়েছে। তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক মতামত থাকলেও, বা একটা বিশেষ মুহূর্তে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সমাবেশ তৈরি হলেও, এটাকে নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী বলা সম্ভব হবে না।

প্রথমত, এখানে যেকোনো সুরক্ষিত গ্রুপ বা গোষ্ঠী হওয়ার জন্য সেটাকে স্থায়ী (পারমানেন্ট) ও স্থিতিশীল (স্টেবল) হতে হবে; রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোয় গোষ্ঠী প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত জন্মসূত্রে নির্ধারিত হবেন যা সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, আরিফ যেভাবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জনতাকে ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেটা করতে গেলে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ এতই শিথিল হয়ে পড়ে যে আইনের দিক থেকে এটা আর অর্থবহ থাকে না। যেকোনো দলবদ্ধ গোষ্ঠীকে আসলে সে অর্থে ‘রাজনৈতিক’ বলা সম্ভব, এমনকি অনেক জাতীয় বা নৃগোষ্ঠীকেও কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্মাণ বলেও সাব্যস্ত করতে পারবেন।

এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংজ্ঞায় পূর্বে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, এটা বাদ না দিলে আমাদের আইন অনুযায়ী চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলা যেতে পারত! কিন্তু, ওপরে এটাই বলার চেষ্টা করা হলো যে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ থাকলেও চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বা জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বলা সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ না বললে কি অপরাধকে লঘু করা হয়? আমাদের উত্তর হচ্ছে, না। জেনোসাইডকে ‘ক্রাইম অব অল ক্রাইমস’ বলে সাব্যস্ত করার যে বহুল রেওয়াজ রয়েছে, তাতে মনে হয়, আইনে বুঝি একধরনের অপরাধের ক্রমবিন্যাস বা হায়ার্কি রয়েছে!

এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইড প্রমাণের মানদণ্ড খুব উঁচু, কোনো ঘটনাকে জেনোসাইড প্রমাণ করতে খুব কসরত করতে
হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোনো হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’–এর খোপে ঢোকানোর প্রয়াস খুব লক্ষণীয়।

সম্প্রতি গবেষকেরা (যেমন ডার্ক মোজেস) বলছেন, এই মনোভাব মানে এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং সবকিছু এটাতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রবণতা, তা আদতে ক্ষতিকর। এটা বিভিন্ন সহিংসতা ও অপরাধের বিবিধ মাত্রাকে কাটছাঁট করে, তার ধরন ও প্রকৃতিকে ঠিকঠাকমতো বুঝতে দেয় না।

ফলে হত্যাযজ্ঞমাত্রই ‘জেনোসাইড’ বা সে অর্থে গণহত্যা বলে দাবি করলে, একদিকে যেমন গণহত্যা/জেনোসাইড বর্গ হিসেবে অর্থহীন হয়ে উঠে, তেমনি যেসব ঘটনা আসলেই জেনোসাইড, সেগুলো লঘু হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেকেই হরেদরে ঘটনাকে জেনোসাইড ব্যবহার করতে সতর্ক করেন।

চব্বিশের ঘটনাকে যদি জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা না বলি, তাহলে অপরাধের কোন ব্যানারে আলোচনা করা যেতে পারে? আরিফ নিজেও তাঁর লেখায় যেসব প্রতিবেদনের কথা বলছেন, সেখানেও এর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে। যেমন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং পুরো প্রতিবেদনে নানা কায়দায় সেটাকেই প্রমাণ করা হয়েছে। চব্বিশের সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাই যৌক্তিক ও সঠিক। এটাকে জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বললে মারাত্মক আইনি বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

তাই আমরা মনে করি যে আন্তর্জাতিক আইনে কোনোভাবেই চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলে প্রমাণ করা যাবে না। এটাকে জোর করে যদি ‘জেনোসাইড’ অর্থে গণহত্যা বলা হয়ে থাকে, তাহলে কিছুদিন পর মূল অপরাধীরাই বলতে শুরু করবেন যে এটাকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না; ফলে নৈতিকভাবে দায়মুক্তি ঘটেছে বলে প্রচারণার সুযোগ পাবেন।

এ রকম তৎপরতা থেকে এ ধরনের ‘ভুল’ চিহ্নায়ন দুই তরিকার বিপদ ঘটাবে। এক. খোদ চব্বিশের সহিংসতাকে পুরোপুরি বুঝতে সহায়ক হবে না এবং অপরাধীদের প্রচারণার সুযোগ করে দেবে; দুই. যেগুলো আসলেই ‘জেনোসাইড’মূলক ঘটনা, সেগুলোকে লঘু করে তুলবে।

সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক

উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাসদের বিক্ষোভ
  • ইসলামী আন্দোলনকে বাইপাস করে সংসদে যাওয়ার সুযোগ নেই: চরমোনাই পীর
  • গাজায় গণহত‌্যা: জিএম কা‌দে‌রের নেতৃ‌ত্বে রাজধানী‌তে বি‌ক্ষোভ
  • নির্বাচন ও সংস্কার মুখোমুখি করা গণ–অভ্যুত্থান ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
  • ‘ইসরায়েলের পণ্য বর্জনের জিহাদ শুরু করতে হবে’
  • জুলাই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলা কেন বিভ্রান্তিকর
  • নববর্ষ বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার দাবি কবিতা পরিষদের 
  • নিরাপত্তা উপদেষ্টার নিয়োগ বাতিলের দাবি বিপ্লবী পরিষদের
  • নববর্ষের ঐতিহ্য রক্ষায় জাতীয় কবিতা পরিষদের পাঁচ দাবি
  • ভাসানচরকে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে