ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, অযথা সময়ক্ষেপণ করে সরকারে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তাঁদের। তাঁরা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র মেরামতের মৌলিক শর্ত পূরণ করতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সংস্কারগুলো অতি জরুরি, সেগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলে যেতে চান।

আজ শনিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা এ কথা বলেন। ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গতকালই প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিশনগুলো হলো সংবিধান, বিচার, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা হয়েছে।

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে তিনভাবে বাস্তবায়নের কথা আছে বলে উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, একটি হলো আশু করণীয় (সংবিধান সংস্কার কমিশনের আশু করণীয় নেই)। আরেকটি হলো মধ্যমেয়াদি এবং একটি হলো দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদিগুলো নির্বাচন–পরবর্তী সরকার করবে। আশু করণীয়গুলোও পরিষ্কার, তাঁরা আশা করছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের সাপেক্ষে নির্বাচনের আগেই করা হবে। আর মধ্যমেয়াদিগুলো নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে কমিশনের আশু কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের কথাও জানান তিনি। তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশন আশু করণীয়ও দিয়েছে। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি হবে না, তা রাজনৈতিকগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। যদি তারা রাজি থাকে, তাহলে রোজার মধ্যেও আলোচনা চলবে।

সংস্কার কমিশনের আশু করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করতে কত দিন লাগতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, আশু করণীয় ইতিমধ্যে কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিবেদনে আশু করণীয় ছয় মাসের মধ্যেও বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর বিবেচনায় আশু করণীয়ের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ এক মাসের মধ্যেই করা সম্ভব।

আশু করণীয়গুলো বাস্তবায়ন করে নির্বাচন করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, আশু করণীয়র ক্ষেত্রে নির্বাচন–সংক্রান্ত যেসব বিষয় আছে, সেগুলো অবশ্যই ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধন কমিশনের ক্ষেত্রেও ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করে।

নির্বাচন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যে দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছে, এটি বলার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। আর নির্বাচনের সময়রেখা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তাঁর প্রেস সচিব বারবার পরিষ্কার করেছেন যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে।

জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপিও একটি ঘোষণাপত্র (খসড়া) তৈরি করেছে। তারা বলেছে, সেটি তাদের জোটসঙ্গীদের দিয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সেটি চূড়ান্ত হলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বসবে। ছাত্রনেতারাও যথেষ্ট সংযম, ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি আশা করেন, এ প্রক্রিয়া বেগবান করার চেষ্টা করা হবে। কারণ, এটা আইনি দলিল নয়, রাজনৈতিক দলিল, ঐক্যের দলিল।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সরকারের ছয় মাসের মাথায় পতিত স্বৈরাচারের লোকজন ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের কারণে, নাকি সরকারের দুর্বলতার কারণে এটি হচ্ছে? জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, সরকারের সহনশীলতা, অবাধ মতপ্রকাশের পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সরকারের অসীম শ্রদ্ধাবোধের কারণে এগুলো হচ্ছে।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ–প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইন উপদ ষ ট ন উপদ ষ ট ঐকমত য র সরক র র করণ য়

এছাড়াও পড়ুন:

সব অংশীদারকে আন্তরিক হতে হবে

রাজনৈতিক ঐকমত্যের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংলাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে, তাতে দেশবাসীর মনে নতুন করে আশাবাদ জেগেছে বলা যায়। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গত বছর সরকার যে ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচারবিষয়ক সংস্কার কমিশন।

বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণকালে একে জাতীয় ও বিশ্বের সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সংস্কার কমিশনগুলোর এই সুপারিশ ইতিহাসে স্থান করে নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে এবং কমিশনপ্রধানেরা মিলিত হয়ে আশুকরণীয়, মধ্যকরণীয় ও নির্বাচনের পরে করণীয় বিষয়ে সুপারিশমালা পেশ করবেন। আর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সব রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের পক্ষের শক্তি, সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

আমরা মনে করি, বিভিন্ন কমিশন যেখানে কাজ শেষ করেছে, সেখান থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার ও অংশীজনদের কাজ শুরু হবে। এই অংশীজনদের মধ্যে আছে অন্তর্বর্তী সরকার, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ এসেছে, এর আগে যেসব সংলাপ হয়েছে, তাতে তারা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়নি। এবার সংলাপটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে সব পক্ষ খোলামেলাভাবে ও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।

নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে—রাজনৈতিক মহলে যে বিতর্ক আছে, সেটা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হলে এর অবসান হবে।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ রাজনৈতিক পটভূমিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের সমর্থন ও সহায়তা না পেলে তারা কোনো কাজে সফল হবে না। আবার অন্তর্বর্তী সরকারও অংশীজনদের বাদ দিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলে তা-ও সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়া থাকতে হবে।

আমরা যতটা জানি, কোনো দলই সংস্কারের বিষয়ে আপত্তি করেনি। তবে সংস্কারের মাত্রা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও মতভেদ থাকতে পারে। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এটা অস্বাভাবিক নয়। কথা হলো এই ভিন্নমতকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব? আলোচনা ও যুক্তিতর্কই এ ক্ষেত্রেই একমাত্র পথ।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জনমনে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা পূরণ করার দায়িত্ব যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের, তেমনি আন্দোলনের অংশীজনদেরও। তাঁরা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে যে দৃঢ় ঐক্যের পরিচয় দিয়েছেন, নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়েও তাঁরা ঐকমত্যে পৌঁছাবেন বলে আশা করা যায়। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা যে সংগঠন বা দলের হয়ে কথা বলছেন, তাঁরা কেবল তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন না। প্রতিনিধিত্ব করছেন ১৭ কোটি মানুষকে। জনমানুষের প্রত্যাশাকে সবাইকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

বিগত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। অতএব অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন একটি নির্বাচন করতে হবে, সেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন, সব প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য সংস্কারের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। নির্বাচনের দিন-তারিখ কিংবা সংস্কারের মাত্রা কী হবে—এগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠারও কোনো বিকল্প নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উস্কানি চলতে থাকলে তিন বছরেও ভোট সম্ভব নয়
  • ৬ মাস পর এসে সরকার কঠিন সময়ে: মাহমুদুর রহমান মান্না
  • আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে শিগগিরই পদক্ষেপ: আসিফ মাহমুদ
  • সব অংশীদারকে আন্তরিক হতে হবে
  • মনির হায়দারকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ