শিক্ষার্থীরা নয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার পেছনে রয়েছে সন্ত্রাসীরা: হর্ষবর্ধন শ্রীংলা
Published: 8th, February 2025 GMT
‘শিক্ষার্থীরা নয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার পেছনে রয়েছে সন্ত্রাসীরা।’ গত বছরের ৫ আগস্ট ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক ঢাকার ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধাননগরে একটি বেসরকারি সংস্থার আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘ইন্ডিয়াস ফরেন পলিসি রোডম্যাপ উইথ ফোকাস অন ইমিডিয়েট নেইবারহুড' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে শ্রীংলা বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু ওটা কেবল বঙ্গবন্ধুর বাড়িই ছিল না, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যেসব স্মারক, আর্কাইভ, নথি ছিল। তাই আমার মনে হয় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, কাহিনি আছে সেটাকে ধ্বংস করার একটা প্রচেষ্টা। আমার মনে হয় না এর পেছনে কোনো শিক্ষার্থীরা ছিল, তারা সবাই সন্ত্রাসী। বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটছে সেটা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে একেবারেই সুখকর নয়।”
বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকার অমর্যাদা, ভারতবিরোধী স্লোগান এবং উপদেষ্টাদের প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এদিন শ্রিংলা বলেন, “আমরা কঠোরভাবে এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি। একাধিক প্রেস স্টেটমেন্ট আমরা জারি করেছি। এছাড়া বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে কড়া ভাষায় জানানো হয়েছে, এসব চলবে না।”
আরো পড়ুন:
ঢাকা-দিল্লির পাল্টাপাল্টি তলব
শেখ হাসিনার বক্তব্যের জন্য ভারত দায়ী নয়: রণধীর জয়সওয়াল
ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শ্রীংলা বলেন, “বাংলাদেশ নিরাপদ থাকাটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত রয়েছে ভারতের। বাংলাদেশে যদি অস্থিরতা বা প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয় তার প্রভাব এপারেও পড়বে।”
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা যে লড়াই দেখেছিলাম, সেই ধারনাকে ঘুরিয়ে দেয়ার। ঢাকার জগন্নাথ হলের সরস্বতী পুজো এবং দুর্গাপূজার উদাহরণ তুলে বলেন শেখ হাসিনা বলেছিলেন "ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এখন সেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ন্যারেটিভও বদলে গিয়েছে।”
কলকাতা/সুচরিতা/এসবি
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের রাজনীতি
নামাজ-রোজার মতোই পহেলা বৈশাখ-পাহাড়ি উৎসব আমাদের সংস্কৃতি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ সরকার।
প্রতি বছর এপ্রিলে সংস্কৃতি আলোচনায় আমরা মেতে উঠি। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ মেতে ওঠা।
কেন এই মেতে ওঠা?
মেতে ওঠার ইতিহাসটি নতুন তো নয়ই, উল্টো এই মেতে ওঠার সঙ্গে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরস্পরের হাত ধরে চলছে, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এখনও পূর্ণতা পায়নি বলে প্রতি বছর এই মেতে ওঠা। সাধারণ ধারণায় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লাখ লাখ পাকিস্তানি এ দেশে রয়ে গেছে। পরাজিত জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ও তাদের তৎপরতা যে কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূমিতে একটি বাস্তবতা। মধ্যযুগে বা সামন্তকালে এমন পরাজিতদের সাধারণত হত্যা করা হতো অথবা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। এ বাস্তবতার মোকাবিলায় আদালত বা আইনি প্রক্রিয়ায় পরাজিতদের বিচার আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় চর্চা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে ‘বিচার’ একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও, তৎকালীন বিজয়ী বা বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারীরা মানবতার সর্বশেষ চর্চাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তবে তারা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন এবং শীর্ষ নেতাসহ অসংখ্য জন নিহত হন। এ রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রতি বছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে মাতিয়ে তোলে। কেন সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনা এপ্রিলে বা পহেলা বৈশাখে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সাংস্কৃতিক’ কর্মীদের অবদান রাজনৈতিক কর্মীদের চেয়ে কম নয়। ভাষা আন্দোলন দিয়ে যার শুরু হলেও, কাগমারী সাহিত্য সম্মেলন কিংবা অনুরূপ আয়োজন শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে হয়েছে তা নয়, পাড়ায় পাড়ায় যে সংস্কৃতির চর্চা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ আয়োজন একটি স্বীকৃত মাইলফলক। এটিই পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনার অন্যতম কারণ।
সংস্কৃতি বিষয়টি আসলে কী?
বাউল গান যেমন আমাদের সংস্কৃতি, তেমনি হিন্দুর পূজা, সাওতালি নাচ, চাকমার পূজা, মুসলমানের নামাজ আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সব উপাদান ভূমি থেকে উৎসারিত হয় তা নয়। বাণিজ্য বিনিময়, আমদানি ও শাসনের মধ্য দিয়ে চাপিয়ে দেওয়াও বহু কিছু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়। এ দেশের নারীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি, ইংরেজ শাসনের প্রভাবে ব্লাউস তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যে বাউল গান ছিল বৌদ্ধ পরবর্তী ব্রাহ্মণবাদের সমালোচক, সে বাউল গান হয়ে উঠেছে ইসলামের তত্ত্বালোচক। মনে রাখতে হবে এ দেশে ইসলাম যখন আসে, তখন কোনো মাদ্রাসা পাস মুফতি এ দেশে ছিলেন না। লোককবি, গায়কেরাই ইসলামের তত্ত্বালোচনা করেছিলেন বলেই ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ দেশে। এ দেশে মাদ্রাসা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে ইংরেজদের ইচ্ছায়। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় দফা মাদ্রাসা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। তৃতীয় দফা বা বর্তমান রূপের মাদ্রাসা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। অর্থাৎ এই যে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তা ভূমিজাত নয়, বিদেশি শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের চাপিয়ে দেওয়া।
একটি জাতি যখন স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীন থাকতে চায় তখন তাকে সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান নিয়ে ভাবতে হয়। কোনটি তার স্বাধীনতার পক্ষে, কোনটি তার স্বাধীনতার বিপক্ষে তা চিনতে পারতে হয়। সাধারণভাবে ভূমি থেকে যা উৎসারিত তা হচ্ছে নিজস্ব। আমদানিকৃত এবং ভূমি কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত উপাদানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা ‘অন্ধকার’ ডেকে আনতে পারে। ইসলামী সংস্কৃতি বা আরব-পারস্য-তুর্কি সংস্কৃতি বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত হয়েছে। হাজার বছর ধরে তা জীবনচর্চারও অংশ। সে অর্থে তা এখন বাংলার সংস্কৃতিও বটে, কিন্তু তা সতর্কতার সঙ্গে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চর্চা না হলে দেশের স্বাধীনতাই বিপন্ন হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভূমি থেকে যা উৎসারিত বা নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে কীভাবে চিনব ও চর্চা করব?
এই চেনা ও চর্চার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের বিশেষত গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্বকে স্বীকার করেও বলতে হয় এ কাজে মুখ্য ভূমিকা গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের। তাদের প্রধান শত্রুও আবার বুদ্ধিজীবীরাই। তাই তাদের কাজটি সহজ নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীতা বহু উপাদানকে চিহ্নিত করেছেন, পাকিস্তানকালে সে সবই হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্ত্র। লোকগান, যাত্রাপালা, কবিগান, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত ইত্যাদি। এমন কি নামাজ-মোনাজাতও এই অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৫-এর পর ভূমিজ উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে, নিগ্রহ চালানো হয়েছে কি হয়নি তা এখানে আলোচ্য নয়, এখানে আলোচ্য এটাই যে সংগীত ও চলচ্চিত্রের মতো সাংস্কৃতিক পণ্যের বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করে ভূমিজ উপাদানগুলোর যথাযথ ব্যবহারের ওপর। দেশের জনপ্রিয় গান ও চলচ্চিত্রগুলো তার সাক্ষী। লোকজ বিবিধ পণ্য এক পহেলা বৈশাখেই যে অর্থনৈতিক লেনদেন ঘটায় তা সারাবছরের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে, এমনকি বিদেশি বিনিয়োগোর ‘স্বাধীনতা’ হরণের ঝুঁকিকেও মোকাবিলা করে ভূমিজ পণ্য বা লোক পণ্য।
পহেলা বৈশাখের যে আয়োজনটি বিগত বছরগুলোয় ‘সংস্কৃতি’বিষয়ক আলোচনার কেন্দ্রে তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র চর্চায় ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন যেমন একটি মাইলফলক, এটিও তেমনি। এর প্রভাব ব্যাপক। এই শোভাযাত্রার প্রভাবে দেশে এখন বিবিধ রকম শোভাযাত্রা হয়ে থাকে সেটা যেমন রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, তেমনি স্রেফ সামাজিক। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আকাশ থেকে হঠাৎ পতিত কোনো ঘটনা নয়। এটি দেশে প্রচলিত হাজার বছরের বিবিধ শোভাযাত্রারই একটি সংঘটিত তথা আধুনিক রূপ বা নাগরিক রূপ। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এ শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে। যার ফলে প্রতিবছর এ শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করেই বৈশাখী সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় আমরা মেতে উঠছি প্রতিবছর। এ আলোচনার মধ্য দিয়েই দেশের স্বাধীনতা সুসংহত হবে; তবে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিতে হবে স্বরূপ সন্ধানের। ব্রিটিশ কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পর মৌলিক সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর সন্ধানে বুদ্ধিজীবীদের অনীহা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই হুমকিস্বরূপ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর জন্ম দিয়েছে, আরও দেবে। এ উপাদানগুলো স্রেফ বিনোদনের বিষয় নয়; অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও রয়েছে তার বিশাল ভূমিকা।
পরিশেষ
ইউরোপীয় ড্রাম আমরা বাজাব, আরবি তাবলও বাজাব, কিন্তু ঢোল ভুলে নয়। এই ঢোল বাজাতে পারাতেই আমাদের স্বাধীনতা। v