বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। দুপাড় প্রায় ২৩০ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাদের কাছে জানতে পারলাম, এ বছর তিস্তা নদীর ৪৫ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ। এর মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার ভয়াবহ। আমি গত ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কলোমিটারের ১০০ কিলোমিটার নৌপথে ঘুরেছি। অবশিষ্ট ১৫ কিলোমিটার ঘুরেছি ফেব্রুয়ারির শুরুতে। দেখলাম নদীর একেক স্থানে একেক অবস্থা। বিশেষ করে তিস্তা নদীর বাম তীরে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর এবং চিলমারী উপজেলা অংশে একটানা দীর্ঘ ভাঙন আছে। ভাঙন আছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধাতেও। এই ভাঙনের প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে এসব অঞ্চলে এ বছর স্মরণকালের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। 

রাজারহাটে গতিয়াশামে বাম তীরে দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় নদী ভেঙে ভেঙে অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। কাউনিয়ার তিস্তা সেতুতে দাঁড়িয়ে নদীর পূর্ব দিকে তাকালেই সেটি বোঝা যায়। তিস্তা কয়েক বছর ধরে যে ভয়ংকর আচরণ করে আসছে, এ বছরও যদি একই ঘটনা ঘটে, তাহলে গতিয়াশামে তিস্তার নতুন পথ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন আর বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। ৪৫ কিলোমিটারের ভাঙনপ্রবণ এলাকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই আড়াই শ কোটি টাকা হয়ে উঠতে পারে এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি প্রতিরোধমূলক শক্তি। এটি খুবই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা। 

তিস্তায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, এই ধোয়া তুলে গত আট বছরে কোনো কাজ করা হয়নি। যখন তিস্তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং ভাঙে, তখন কিছু জিও ব্যাগ (বালুভর্তি বস্তা) ফেলা হয়। পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে অনেক কম ব্যয়ে এর সুরক্ষা সম্ভব ছিল। 

আগের সরকারগুলো রংপুর অঞ্চলের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ সব সময়ই করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকার সেই বৈষম্য করবে না বলে আমারা মনে করি। প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন আর বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। ৪৫ কিলোমিটারের ভাঙনপ্রবণ এলাকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই আড়াই শ কোটি টাকা হয়ে উঠতে পারে এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি প্রতিরোধমূলক শক্তি। এটি খুবই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা। 

এরপরই প্রয়োজন হবে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তিস্তা স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য একটি মহাপরিল্পনার কথা আমরা কেবল শুনে এসেছি। বাস্তবে এর কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। অনেকটা ছেলে ভোলানো ছড়ার মতো। সারা দেশে যখন তিন লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বিগত সরকার বাস্তবায়ন করেছে, তখন রংপুরের জন্য সামান্য ১০ হাজার কোটি টাকাও তিন-চার বছরে দিতে পারেনি। অথচ রংপুরে কোনো মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়নি, আসলে সদিচ্ছাই ছিল না। 

২০১৬ সাল থেকে আমরা শুনে এসেছি তিস্তা নদীর মহাপরিকল্পনার জন্য সমীক্ষা করা হয়েছে। পাউবোর সদ্য সাবেক মহাপরিচালক আমিরুল ইসলাম ভুঁইয়া গত বন্যায় এসেছিলেন তিস্তার ভাঙন পরিস্থিতি দেখার জন্য। যদিও তাঁর আসায় কেবল অর্থের অপচয় হয়েছে। তিস্তার কোনো উপকার হয়নি। কারণ, ওই সময়ে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি কিন্তু পাউবো থেকে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

আমিরুল সাহেব তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন বাস্তবে তিস্তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। পাউবোর কয়েকজন প্রকৌশলী বলেছেন, ২০১৬ সালে যা হয়েছে, সেটিকে একটি ধারণাপত্র বলা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে শুনেছি চীন একটি সমীক্ষা করেছিল কিন্তু সে প্রতিবেদন নাকি সরকারের কাছে দেয়নি। এসবের অর্থ দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের তিস্তা নদীর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পা গ্রহণের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের একটি কারিগরি টিমকে বাংলাদেশে আহ্বান জনানোর কথা বলেছিলেন। এতেও বোঝা যায় সরকার তিস্তা নদীর জন্য কোনো সমীক্ষা করেনি।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তিস্তা ব্যবস্থাপনামূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। যার শুরু হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, শেষ হবে পরবর্তী সরকারের সময়ে। বর্তমান সরকারেরও এটি একটি উল্লেখযোগ্য জনবান্ধব কাজ হতে পারে। নদীটি বাঁচবে, ভাঙন বন্ধ হবে, কৃষি এবং কৃষিনির্ভর সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। 

বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বছর তিনেক আগেও তিস্তার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ দেখে গেছেন। ফলে তিস্তাপাড়ের মানুষ তাঁর ওপর বেশি ভরসা রেখেছেন। কয়েক দিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এসেছিলেন। তিনি জেনে গেছেন তিস্তা সংকটের কথা। এই দুজন উপদেষ্টা আবারও তিস্তায় আসছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেকগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে। রিভারাইন পিপলের মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে তিস্তা সুরক্ষার আন্দোলন করছি। ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’, ‘রংপুর বিভাগ বৈষম্য নিরসন আন্দোলন’, ‘তিস্তা ফোরাম’, ‘তিস্তা নদী রক্ষা কমিটি’ ও তিস্তা সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে।

সম্প্রতি বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলু ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ ব্যানারে ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদিনব্যাপী বৃহৎ কর্মসূচি দিয়েছেন। সরকারকে বুঝতে হবে কেন একটি নদীর ভাঙন দূর করার জন্য এতগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে।

প্রথমত কয়েক দিনের মধ্যে সরকারকে তিস্তার ভাঙন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত তিস্তা ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতের কাছ ন্যায়সংগত পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদীসংগঠক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ রহণ করত এক ল খ ক ট সরক র র ব যবস থ প রকল প র জন য বছর ত

এছাড়াও পড়ুন:

সিকৃবির ক্যাফেটেরিয়া: খাবারের দাম বেশি, মান খারাপ

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের উচ্চমূল্য এবং মান নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনের খাবারের জন্য অতিরিক্ত টাকা গুণতে হলেও খাবারের স্বাদ, গুণগত মান এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট তারা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাফেটেরিয়ায় রান্নার জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন খাবারের দাম মাত্রাতিরিক্ত। অথচ ক্যাম্পাসের বাইরের দোকানগুলোত একই দামে ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তর থেকে দেওয়া খাবারের মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, ভাতের প্যাকেজ মাছ/মুরগি ও সবজিসহ ৫৫ টাকা, সেখানে সবজি হিসেবে সামান্য আলু ছাড়া কিছুই দেওয়া হয় না। এছাড়াও মাছ মাংসের সাইজ যথেষ্ট ছোট। তালিকায় ডিম মামলেটের দাম ধরা হয়েছে ২০ টাকা, যা ডিমের বাজার মূল্যের দ্বিগুণ।

এছাড়াও গরুর মাংসের কথা উল্লেখ থাকলেও কখনো এগুলো রান্না কিংবা পরিবেশন করতে দেখেননি শিক্ষার্থীরা। এমনকি পরোটা, সিঙ্গারা, সমুচা,জিলাপির দাম আকার অনুযায়ী বেশি। 

ক্যাফের পরিবেশ নিয়েও রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষার্থীরা জানান, আগে থেকে কয়েকবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এখনো কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি। অনেকেই বলছেন, নিয়মিত তদারকি এবং কঠোর ব্যবস্থাপনা ছাড়া এ সমস্যা কাটবে না।

এছাড়া শিক্ষার্থীরা ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে বেশকিছু দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে, নিরাপদ খাবার পানি এবং পানির গ্লাস পরিষ্কার রাখা, সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা,  খাবারের মাঝে অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু যেন না থাকে, খাবারের গুণগত মান বাড়ানো, খাদ্য তালিকায় উল্লেখিত খাবারের পর্যাপ্ততা, গরুর মাংস, রোস্ট, অন্যান্য সবজি, বিভিন্ন ভর্তার ব্যবস্থা করা, ওয়াশরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা এবং ক্যান্টিনের বেসিনে হ্যান্ডওয়াশের ব্যাবস্থা করা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেটেরিনারি অনুষদের এক শিক্ষার্থী বলেন, “একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া হিসেবে আমাদেরটা মানসম্মত নয়। আমাদের ক্যাফেতে বসার পরিবেশ মোটামুটি ঠিক থাকলেও খাবার মান খুবই নিম্নমানের । বিশেষ করে বেকারি থেকে যে খাবারগুলো আনা হয়, সেগুলো ভালোভাবে দেখে আনা হয় না। খাবারে অনেক সময় পিপঁড়া পাওয়া যায়। এছাড়া আমাদের ক্যাফেতে কোনো বহুমাত্রিকতা নাই । সকাল ও বিকেলে খাবারের মেনুতে নুডুলস, চটপটিসহ বহুমাত্রিক চার্ট যুক্ত করা প্রয়োজন।”

শিক্ষার্থী মো. মুরাদ আলম বলেন, “আমার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ক্যাফেটেরিয়ার গল্প শুনে মনে হয়েছে, সিকৃবির ক্যাফেটেরিয়া বাইরের অন্য দুই-একটা হোটেলের মত। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব, যেন খাবারের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করার দিকে নজর দেওয়া হয়।”

অভিযোগের বিষয়ে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালক নুরে আলম শাহিন বলেন, “খাবারের মূল্য ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তর থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আগে মুরগিসহ ভাতের প্যাকেজ ৬০ টাকা ছিল, সেটা কমিয়ে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া খাবারের তালিকায় মুরগির রোস্ট যুক্ত করা হয়েছে। এ দামে ভালো খাবার দেওয়ার চেষ্টা করছি।”

খাবারের মান ও ক্যান্টিনের পরিছন্নতা নিয়ে তিনি বলেন, “আমি নিজেই প্রতিদিন রাতে ক্যাফেটেরিয়া পরিষ্কার করি। আমরা হলের ডাইনিং থেকেও ভালো চাল ব্যাবহার করি। সবজি হিসেবে আলু ভাজা, বেগুন ভাজা দিচ্ছি। অন্যান্য সবজির দাম নাগালের মধ্যে থাকলে সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা করব।”

সিকৃবির ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামিউল আহসান তালুকদার বলেন, “গত সপ্তাহে ক্যাফেটেরিয়া ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে আমরা মিটিং করে খাবারের মূল্যের একটি তালিকা দিয়েছি, যা পূর্বে ছিল না। এখানে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা নির্দিষ্ট না। শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও বাজারের মূল্যের ওপর নির্ভর করে এই তালিকা আমরা পরিবর্তন করব।”

ক্যাফেটেরিয়ার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি, যেন খাবার পরিবেশনের জায়গাসহ সম্পূর্ণ ক্যাফে পরিষ্কার রাখা হয়। এতে কোনো ব্যত্যয় হলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।”

ঢাকা/আইনুল/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ