তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে ছেলে ভোলানোর গল্প আর কত দিন
Published: 8th, February 2025 GMT
বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। দুপাড় প্রায় ২৩০ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাদের কাছে জানতে পারলাম, এ বছর তিস্তা নদীর ৪৫ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ। এর মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার ভয়াবহ। আমি গত ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কলোমিটারের ১০০ কিলোমিটার নৌপথে ঘুরেছি। অবশিষ্ট ১৫ কিলোমিটার ঘুরেছি ফেব্রুয়ারির শুরুতে। দেখলাম নদীর একেক স্থানে একেক অবস্থা। বিশেষ করে তিস্তা নদীর বাম তীরে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর এবং চিলমারী উপজেলা অংশে একটানা দীর্ঘ ভাঙন আছে। ভাঙন আছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধাতেও। এই ভাঙনের প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে এসব অঞ্চলে এ বছর স্মরণকালের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।
রাজারহাটে গতিয়াশামে বাম তীরে দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় নদী ভেঙে ভেঙে অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। কাউনিয়ার তিস্তা সেতুতে দাঁড়িয়ে নদীর পূর্ব দিকে তাকালেই সেটি বোঝা যায়। তিস্তা কয়েক বছর ধরে যে ভয়ংকর আচরণ করে আসছে, এ বছরও যদি একই ঘটনা ঘটে, তাহলে গতিয়াশামে তিস্তার নতুন পথ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন আর বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। ৪৫ কিলোমিটারের ভাঙনপ্রবণ এলাকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই আড়াই শ কোটি টাকা হয়ে উঠতে পারে এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি প্রতিরোধমূলক শক্তি। এটি খুবই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা।তিস্তায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, এই ধোয়া তুলে গত আট বছরে কোনো কাজ করা হয়নি। যখন তিস্তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং ভাঙে, তখন কিছু জিও ব্যাগ (বালুভর্তি বস্তা) ফেলা হয়। পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে অনেক কম ব্যয়ে এর সুরক্ষা সম্ভব ছিল।
আগের সরকারগুলো রংপুর অঞ্চলের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ সব সময়ই করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকার সেই বৈষম্য করবে না বলে আমারা মনে করি। প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন আর বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। ৪৫ কিলোমিটারের ভাঙনপ্রবণ এলাকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই আড়াই শ কোটি টাকা হয়ে উঠতে পারে এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি প্রতিরোধমূলক শক্তি। এটি খুবই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা।
এরপরই প্রয়োজন হবে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তিস্তা স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য একটি মহাপরিল্পনার কথা আমরা কেবল শুনে এসেছি। বাস্তবে এর কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। অনেকটা ছেলে ভোলানো ছড়ার মতো। সারা দেশে যখন তিন লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বিগত সরকার বাস্তবায়ন করেছে, তখন রংপুরের জন্য সামান্য ১০ হাজার কোটি টাকাও তিন-চার বছরে দিতে পারেনি। অথচ রংপুরে কোনো মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়নি, আসলে সদিচ্ছাই ছিল না।
২০১৬ সাল থেকে আমরা শুনে এসেছি তিস্তা নদীর মহাপরিকল্পনার জন্য সমীক্ষা করা হয়েছে। পাউবোর সদ্য সাবেক মহাপরিচালক আমিরুল ইসলাম ভুঁইয়া গত বন্যায় এসেছিলেন তিস্তার ভাঙন পরিস্থিতি দেখার জন্য। যদিও তাঁর আসায় কেবল অর্থের অপচয় হয়েছে। তিস্তার কোনো উপকার হয়নি। কারণ, ওই সময়ে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি কিন্তু পাউবো থেকে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
আমিরুল সাহেব তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন বাস্তবে তিস্তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। পাউবোর কয়েকজন প্রকৌশলী বলেছেন, ২০১৬ সালে যা হয়েছে, সেটিকে একটি ধারণাপত্র বলা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে শুনেছি চীন একটি সমীক্ষা করেছিল কিন্তু সে প্রতিবেদন নাকি সরকারের কাছে দেয়নি। এসবের অর্থ দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের তিস্তা নদীর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পা গ্রহণের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের একটি কারিগরি টিমকে বাংলাদেশে আহ্বান জনানোর কথা বলেছিলেন। এতেও বোঝা যায় সরকার তিস্তা নদীর জন্য কোনো সমীক্ষা করেনি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তিস্তা ব্যবস্থাপনামূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। যার শুরু হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে, শেষ হবে পরবর্তী সরকারের সময়ে। বর্তমান সরকারেরও এটি একটি উল্লেখযোগ্য জনবান্ধব কাজ হতে পারে। নদীটি বাঁচবে, ভাঙন বন্ধ হবে, কৃষি এবং কৃষিনির্ভর সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বছর তিনেক আগেও তিস্তার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ দেখে গেছেন। ফলে তিস্তাপাড়ের মানুষ তাঁর ওপর বেশি ভরসা রেখেছেন। কয়েক দিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এসেছিলেন। তিনি জেনে গেছেন তিস্তা সংকটের কথা। এই দুজন উপদেষ্টা আবারও তিস্তায় আসছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তিস্তা নদীর ভয়াবহ ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেকগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে। রিভারাইন পিপলের মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে তিস্তা সুরক্ষার আন্দোলন করছি। ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’, ‘রংপুর বিভাগ বৈষম্য নিরসন আন্দোলন’, ‘তিস্তা ফোরাম’, ‘তিস্তা নদী রক্ষা কমিটি’ ও তিস্তা সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে।
সম্প্রতি বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলু ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ ব্যানারে ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদিনব্যাপী বৃহৎ কর্মসূচি দিয়েছেন। সরকারকে বুঝতে হবে কেন একটি নদীর ভাঙন দূর করার জন্য এতগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে।
প্রথমত কয়েক দিনের মধ্যে সরকারকে তিস্তার ভাঙন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত তিস্তা ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতের কাছ ন্যায়সংগত পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদীসংগঠক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ রহণ করত এক ল খ ক ট সরক র র ব যবস থ প রকল প র জন য বছর ত
এছাড়াও পড়ুন:
তিন জেলায় ধর্ষণের শিকার তিন স্কুলশিক্ষার্থী
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় আপন মামার বিরুদ্ধে ভাগনিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগী পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ও ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে ধর্ষণ করে তার মামা। বিষয়টি জানার পর ৫ মার্চ ভুক্তভোগীর এক আত্মীয় মেঘনা থানায় মামলা করেন। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত পলাতক। মেঘনা থানার ওসি আব্দুল জলিল জানান, আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় মসজিদের শৌচাগারে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রকে ধর্ষণের অভিযোগে মো. নুরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৪ মার্চের এ ঘটনা ৬ মার্চ জানাজানি হয়। সোমবার নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কবিরহাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা না করায় তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে দ্বীন ইসলাম তোফাজ্জল নামে এক শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার রাতে অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে বাড়ির বাইরে থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে ভুক্তভোগীর বাবার করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
বারিধারায় শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ: রাজধানীর বারিধারায় ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে সজল হোসেন পলাশ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গুলশান থানার এসআই নাঈম উদ্দিন সুজন বলেন, ভুক্তভোগীর মা জানিয়েছেন, রোববার সকালে সজল শিশুটিকে বাসায় একা পেয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় মেয়েটির মা কাজের জন্য বাইরে ছিলেন। পরে বিষয়টি জানতে পেরে গুলশান থানায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করেন শিশুটির মা। সজল তাদের পূর্বপরিচিত।
ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গ্রেপ্তার: চট্টগ্রামে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে রোববার রাতে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাবার পাশবিকতার দৃশ্য মায়ের পরামর্শে মোবাইল ফোনে ধারণ করে শিশুটি। কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল করিম এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ঝালকাঠিতে কলেজছাত্র গ্রেপ্তার: ঝালকাঠির রাজাপুরে সহপাঠীকে ধর্ষণ ও গর্ভপাত করানোর অভিযোগে কাজী ফাহাদ নামে এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার রাতে রাজাপুর থানায় মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার ফাহাদকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো পান্নু মোল্লা ও তার ভাবী শারমিন আক্তার। ঘটনার পর কাউকে না বলার জন্য শিশুটিকে শাসিয়ে দেয় শারমিন। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে খাবার দেওয়ার কথা বলে ডেকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে নুরুল ইসলাম নামে এক চা দোকানিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে উল্টো অপবাদ পাওয়া জান্নাত বেগম (১৭) নামে এক কিশোরী আত্মহত্যার ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি রাকিব হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভোরে কুমিল্লার লাকসাম এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে একই মামলার আসামি হেলালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রামে আইনজীবী পল্টন দাশের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে এক নারী আইনজীবীর করা ধর্ষণ মামলার বিচার শুরু হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোস্তাক আহমেদের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বাদী প্রথমে সাক্ষ্য দেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ১৩ মে নির্ধারণ করেছেন আদালত।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতা)