মাঘের কনকনে ঠান্ডায় ঘন কুয়াশায় মধ্যে কাজের সন্ধানে রেললাইনের ওপর বসে আছেন মধ্যবয়সী মো. বাবুল মিয়া। কেউ না কেউ শ্রমিক হিসেবে কাজে নিতে আসবেন—এই আশায় ভোর সাতটা থেকে সেই অপেক্ষা। কিন্তু সকাল আটটা বাজলেও তাঁকে কেউ কাজের জন্য নিতে আসেননি। তাই চোখেমুখে রাজ্যের চিন্তা। কাজ না পেলে চাল-ডাল কেনা হবে না তাঁর।

বাবুল মিয়ার বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ভালুকা গ্রামে। সন্তানদের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি অনেকটাই বিরক্ত হন। সন্তানদের প্রতি তাঁর অনেক অভিমান। বাবুলের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁদের মধ্যে ছেলেরা বড়। তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে শহরে থাকেন। আর একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর সবার ছোট মেয়েটি তাঁর সঙ্গে থাকে। এত কষ্ট করে সন্তানদের লালন-পালন করে কী লাভ—দীর্ঘশ্বাসে এমন মন্তব্য তাঁর। দুই ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিন্তু কেউ তাঁদের খবর রাখে না। তিনি বলেন, ‘দুই সন্তানের কেউই ছয় মাসে একবারও খোঁজ নেয় না, কেমন আছি।’

গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে জামালপুর শহরের গেটপাড় এলাকায় শ্রমিকের হাটে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রতিদিন খুব ভোরে মেলান্দহ রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে জামালপুর শহরের ওই শ্রমিকের হাটে আসেন কাজের জন্য। আবার কাজ করে সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে যান।

বাবুল বলেন, ‘গরিবের কষ্ট কেউ বোঝে না। বিল্ডিং বানানোর জোগালি খাটি। আবার ওই কাম না পাইলে, মাটি কাটার কামলার কামও করি। সবকিছুর দাম বাইড়ে গেছে। মানুষ বিল্ডিং এহন কম বানায়। তাই কাম নাই। দিন আনি দিন খাই, ঘরে বাজার নাই। ঠিকমতো সংসার চালাতে পারি না। ঠিকমতো একটু ডাইল-ভাতও জুগার করতে পারি না। কাজ পেলে-প্রতিদিন ৫০০ টেহা পাই। এর মধ্যে নিজে কিছু খাই এবং গাড়ি ভাড়া লাগে। তাইলে আর কই টেহা থাকে। ওই টেহা দিয়ে সংসার চালাতে হই।’

বাবুল আরও বলেন, এলাকায় তেমন একটা কাজ নেই। একসময় অনেক সম্পদ ছিল। সেগুলো তাঁর বাবাই বিক্রি করে গেছেন। নিজের বলতে সাড়ে তিন শতাংশ জমি রয়েছে। সেখানে একটি ঘর আছে।

আক্ষেপ করে বাবুল মিয়া বলেন, ‘এই সংসারে কতই না কষ্ট করছি। নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিছি। লালন-পালন করে বড় করে তুলছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজ সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞাস করে না, কেমন আছি। কখনো জিজ্ঞাস পর্যন্ত করে না, আমরা খাইছি কি না। কী লাভ সন্তানদের মানুষ করে। শেষ বয়সে হাড়ভাঙা কাম করে পেট চালাই। ছেলেদের বিবেক নাই। আল্লাহর ওপর ভরসা করি। তাঁরা (সন্তান) না দেখলেও আল্লাহ আছেন একজন। তিনি যেভাবেই চালাক, সেইভাবেই চলছি। যত দিন পিণ্ডে (শরীর) আছে, তত দিন এভাবেই চলব। তারপর আল্লাহ যা করেন। এখন আর সন্তানদের প্রতি কোনো চাওয়া নাই।’

বাবুল মিয়া প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন ওই শ্রমিকদের হাটে কাজের জন্য আছেন। কিন্তু কোনো দিন কাজ পান আবার কোনো দিন কাজ না পেয়ে বাড়িতে ফিরে যান। আগের থেকে কাজ কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন সংসার চালাতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তিনি বলেন, ‘দু-এক দিন পরপর কাজ পাইলেও ৫০০ ট্যাহা ইনকাম হয়। সেই ট্যাহা নিয়ে বাজারে গেলে এক দিনেই শেষ। বাজারে জিনিসের দামে আগুন। গরিব মানুষ কমনে বাঁচবে? যাদের ট্যাহা আছে, তাদের আছেই; আর যাদের নাই, তাদের কিছুই নাই।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমানো নিয়ে দরকষাকষি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের শেষ তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করতে হবে। একই সঙ্গে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সংস্থাটির অতিরিক্ত আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ দুই লক্ষ্যমাত্রার কোনোটিই অর্জন সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অনুরোধ জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। 

গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে সংস্থাটির চেয়ারম্যানসহ কাস্টমস, আয়কর ও ভ্যাট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এসব বৈঠকে কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফের শর্তের কথা মাথায় রেখে কিছু ক্ষেত্রে করহার বাড়ানো, কর অব্যাহতি তুলে দেওয়াসহ নীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে আশা করা হচ্ছে, রাজস্ব আহরণ বেশ বাড়বে। তবে যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তা সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত নয়। তাই এ লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার অনুরোধ করেন তারা। এ বিষয়ে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বেশ ইতিবাচক বলেও বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। 

বৈঠকের বিষয়ে এনবিআরের কর্মকর্তারা সমকালকে বলেন, গত জুন শেষে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছর শেষে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। এর জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের পরবর্তী তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার বাকি রাজস্ব আদায় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারা আরও বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাড়তি ৫৭ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এসব বাড়তি রাজস্ব কীভাবে আদায় হবে তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি অসম্ভব। তাই লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, দেশের রাজস্ব খাত সংস্কারে উদ্যোগী মনোভাবের কথাও তাদের জানানো হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দল বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। সামনে আরও বৈঠক হবে। আশা করা হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনবে আইএমএফ।

আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের আগে বাংলাদেশ কতটা শর্ত পূরণ করেছে, তা পর্যালোচনায় ঢাকা সফর করছে প্রতিনিধি দলটি। এ দুই কিস্তির জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কর রাজস্বের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তার চেয়ে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি গত রোববার থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। মিশনটি আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ