রাজধানীর ধোলাইখালে ভারী ইঞ্জিন তৈরির এক দোকানে দৈনিক ২০০ টাকা হাজিরায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে তিন কিশোর। তাদের একজন ১৩ বছর বয়সী রাইসুল জানায়, সকাল ৯টায় কাজ শুরু করতে হয়; শেষ হয় রাত ৯টায়। কাজের চাপ থাকলে রাত ১২টা পর্যন্তও থাকতে হয়। ১২ ঘণ্টার শ্রমের বিনিময়ে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পায়। রাইসুলের বাবা মারা গেছেন। ছোট আরও দুই ভাইবোন রয়েছে। মা অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়েই স্কুলে যাওয়ার এই বয়সে রাইসুলকে কাজ করতে হচ্ছে ওয়ার্কশপে।

কলতাবাজারের মহসীন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে এক দোকানে পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ মেরামত করাসহ নতুন যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করে ১২ বছর বয়সী সাইফুল। সে জানায়, দিনমজুর বাবার আয় কম। মা পরের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তাকে এই ওয়ার্কশপে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কাজ শিখলেও সপ্তাহে ৩০০ টাকা পায়। শুধু রাইসুল বা সাইফুল নয়, ধোলাইখাল, কলতাবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোর নানা দোকানে এমন বহু শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) টার্গেট ৮ দশমিক ৭-এর অধীনে ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রথাগত শিশুশ্রম নির্মূলের পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসপ্রথা ও মানব পাচার, শিশুদের সৈনিক হিসেবে ব্যবহারসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারও সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি, ২০১০’ ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত চার স্তরবিশিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। উল্টো দেশে শিশুশ্রম ক্রমেই বাড়ছে।

বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই শিশুশ্রম সমস্যা প্রকট ছিল। গবেষণা বলছে, ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়া এবং পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বহু পরিবার শিশু-কিশোরদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। অথচ জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় চলতি বছরের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ২৭ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় কাজ করে। বেশির ভাগ শিশুর মাসিক আয় আড়াই থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকার মধ্যে। শিশুদের কাজে নিযুক্ত করলে স্বল্প মজুরি দেওয়া সম্ভব; খাটানো যায় বেশি। তাই তাদের নিয়োগে আগ্রহী থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ছোট কারখানার মালিকরাও। সর্বশেষ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় ২০২৩ সালের মার্চে।

তাতে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮৬ হাজার। বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু। যেসব কাজে শিশুদের শারীরিক ও অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সেগুলোকে সরকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকাভুক্ত করে। ২০২২ সালে ৪৩ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ফেলা হয়।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে গত ১২ বছরে ৩০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে শিশুদের ফিরিয়ে কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ শিশুকে ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিশুকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ থেকে ফেরানো যায়নি।

এডুকো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক (চাইল্ড লেবার ইলিমিনেশন) আফজাল কবির খান বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ তিনবার (২০০২, ২০১৩ ও সর্বশেষ ২০২২ সালে) হয়েছে। প্রতিবারের প্রতিবেদনেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। শিশুশ্রম নিরসনের কথা মুখে বললেও সব সরকারই প্রায়োরিটি কনসেপ্টের মধ্যে শিশুশ্রমকে রাখেনি। গত দশকেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; কিন্তু শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কার্যত বেড়েছে। তাই শিশুশ্রম নিরসনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো সরকারের পরিকল্পনায় এ বিষয়টি প্রাধান্য না পাওয়া। শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৩ জন সচিব সংযুক্ত থাকলেও সভায় দুই থেকে তিনজনের উপস্থিতি দেখা যায়। তাই শিশুশ্রম নিরসন করতে চাইলে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন খুব প্রয়োজন।

সম্প্রতি ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’র ১২তম সভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.

) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিশুশ্রম কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি পুরো বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও সংগঠনের আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার সব খাতে শিশুশ্রম নিরসনে বদ্ধপরিকর।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প ক জ কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে

দেশে রোগমুক্ত সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ একটি বড় বাধা। একইসাথে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ ও গুণগত প্যাকেজিং অত্যন্ত জরুরি।

রাজধানীর বিআইপি কনফারেন্স রুমে সোমবার (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত “সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল: অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়” শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এসব বিষয় তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এই কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরত ২৬ জন সাংবাদিক অংশ নেন।

কর্মশালায় জানানো হয়, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, প্রাক্‌-বিদ্যালয়গামী প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দুইজন শিশু ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিতে ভুগছে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ ব্যতীত ভোজ্যতেল বাজারজাত করা নিষিদ্ধ। আইসিডিডিআর,বি-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে মোট ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই ড্রামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ নেই, আর ৩৪ শতাংশ তেলে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাত্রায়। মাত্র ৭ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইন অনুসারে ভিটামিন ‘এ’–এর নির্ধারিত পরিমাণ পাওয়া গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আইনটির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কর্মশালায় জানানো হয়, নন-ফুড গ্রেড উপকরণে তৈরি ড্রাম দিয়ে ভোজ্যতেল পরিবহন করা হয়-যেগুলো আগে কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট/মবিল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের ড্রামে সংরক্ষিত খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি এতে ভেজাল মেশানোর আশঙ্কাও থাকে। এই পুরোনো ড্রামগুলোতে কোনো লেবেল বা উৎস সম্পর্কিত তথ্য না থাকায় তেলের উৎপত্তিস্থল বা সরবরাহকারীকে শনাক্ত করা যায় না। তাই খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ আইন বাস্তবায়নে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কর্মশালায় জানানো হয়, জুলাই ২০২২ এর পর থেকে ড্রামে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বর ২০২২ এর পর থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই নিরাপদ ভোজ্যতেল ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।

ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুসহ নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব রিকেটস ও হাড় ক্ষয়ের পাশাপাশি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে সহজেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন পেতে পারে।

এছাড়াও কর্মশালায় ভোজ্যতেলে গুণগতমানের প্যাকেজিং নিশ্চিতের উপরও জোর দেওয়া হয়। সাধারণত সূর্যরশ্মিসহ যেকোন আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন ‘এ’ নষ্ট হতে থাকে এবং একপর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভোজ্যতেল বাজারজাত হয় যেসব বোতলে সেগুলোর অধিকাংশই আলো প্রতিরোধী না হওয়ায় ভোজ্যতেলের গুণগত ও পুষ্টিমান হ্রাস পায়। সে কারণে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ের জন্য আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কর্মশালায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগের পরিচালক (উপসচিব) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের কনসালটেন্ট সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার; ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম; দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ডেপুটি এডিটর সাজ্জাদুর রহমান এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।

কর্মশালায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি এডভোকেসি বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল এবং প্রজ্ঞা'র কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার।

ঢাকা/হাসান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভিটামিনসমৃদ্ধ ভোজ্যতেল পাওয়ায় বাধা খোলা ড্রাম
  • খাল-ফসলি জমির মাটি ইটভাটায়
  • আইপিএলে আরও ম্যাচ বাড়ানোর পরিকল্পনা
  • ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে