বাড়ছে শিশুশ্রম, সম্ভাবনা নেই এসডিজির লক্ষ্য পূরণের
Published: 8th, February 2025 GMT
রাজধানীর ধোলাইখালে ভারী ইঞ্জিন তৈরির এক দোকানে দৈনিক ২০০ টাকা হাজিরায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে তিন কিশোর। তাদের একজন ১৩ বছর বয়সী রাইসুল জানায়, সকাল ৯টায় কাজ শুরু করতে হয়; শেষ হয় রাত ৯টায়। কাজের চাপ থাকলে রাত ১২টা পর্যন্তও থাকতে হয়। ১২ ঘণ্টার শ্রমের বিনিময়ে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পায়। রাইসুলের বাবা মারা গেছেন। ছোট আরও দুই ভাইবোন রয়েছে। মা অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়েই স্কুলে যাওয়ার এই বয়সে রাইসুলকে কাজ করতে হচ্ছে ওয়ার্কশপে।
কলতাবাজারের মহসীন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে এক দোকানে পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ মেরামত করাসহ নতুন যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করে ১২ বছর বয়সী সাইফুল। সে জানায়, দিনমজুর বাবার আয় কম। মা পরের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তাকে এই ওয়ার্কশপে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কাজ শিখলেও সপ্তাহে ৩০০ টাকা পায়। শুধু রাইসুল বা সাইফুল নয়, ধোলাইখাল, কলতাবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোর নানা দোকানে এমন বহু শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) টার্গেট ৮ দশমিক ৭-এর অধীনে ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রথাগত শিশুশ্রম নির্মূলের পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসপ্রথা ও মানব পাচার, শিশুদের সৈনিক হিসেবে ব্যবহারসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারও সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি, ২০১০’ ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত চার স্তরবিশিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। উল্টো দেশে শিশুশ্রম ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই শিশুশ্রম সমস্যা প্রকট ছিল। গবেষণা বলছে, ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়া এবং পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বহু পরিবার শিশু-কিশোরদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। অথচ জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় চলতি বছরের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ২৭ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় কাজ করে। বেশির ভাগ শিশুর মাসিক আয় আড়াই থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকার মধ্যে। শিশুদের কাজে নিযুক্ত করলে স্বল্প মজুরি দেওয়া সম্ভব; খাটানো যায় বেশি। তাই তাদের নিয়োগে আগ্রহী থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ছোট কারখানার মালিকরাও। সর্বশেষ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় ২০২৩ সালের মার্চে।
তাতে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮৬ হাজার। বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু। যেসব কাজে শিশুদের শারীরিক ও অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সেগুলোকে সরকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকাভুক্ত করে। ২০২২ সালে ৪৩ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ফেলা হয়।
শিশুশ্রম প্রতিরোধে গত ১২ বছরে ৩০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে শিশুদের ফিরিয়ে কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ শিশুকে ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিশুকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ থেকে ফেরানো যায়নি।
এডুকো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক (চাইল্ড লেবার ইলিমিনেশন) আফজাল কবির খান বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ তিনবার (২০০২, ২০১৩ ও সর্বশেষ ২০২২ সালে) হয়েছে। প্রতিবারের প্রতিবেদনেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। শিশুশ্রম নিরসনের কথা মুখে বললেও সব সরকারই প্রায়োরিটি কনসেপ্টের মধ্যে শিশুশ্রমকে রাখেনি। গত দশকেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; কিন্তু শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কার্যত বেড়েছে। তাই শিশুশ্রম নিরসনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো সরকারের পরিকল্পনায় এ বিষয়টি প্রাধান্য না পাওয়া। শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৩ জন সচিব সংযুক্ত থাকলেও সভায় দুই থেকে তিনজনের উপস্থিতি দেখা যায়। তাই শিশুশ্রম নিরসন করতে চাইলে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন খুব প্রয়োজন।
সম্প্রতি ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’র ১২তম সভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প ক জ কর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৮ মাসে বাংলাদেশের ৪৭তম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হওয়ার দাবিটি ভুয়া: রিউমর স্ক্যানার
‘মাত্র ৮ মাসে বাংলাদেশ ৪৭তম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে’ এবং ‘৪০তম থেকে ৭ পিছিয়ে বাংলাদেশ ৪৭তম ক্ষমতাধর দেশ’ এমন দুটি দাবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে ছড়িয়ে পড়া দুটি দাবিই ভুয়া বলছে তথ্য যাচাই বা ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। রিমউর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে র্যাঙ্কিংটি ২০২৪ সালের। অর্থাৎ যে সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার দাবি করা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে বলছে, যে র্যাঙ্কিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটি আজই বা এ বছর প্রকাশ হয়নি। তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। মূলত জরিপের তথ্য ব্যবহার করে র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়। এই র্যাঙ্কিংয়ের জরিপ হয়েছে ২০২৪ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত। অর্থাৎ সর্বশেষ যে র্যাঙ্কিং ইউএস নিউজের ওয়েবসাইটে রয়েছে, তা বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হওয়া জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়েছিল।
দাবিগুলোর সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইউএস নিউজ নামে একটি ওয়েবসাইটের নাম। ইউএস নিউজ মূলত মার্কিন মিডিয়া কোম্পানি, যারা সংবাদের পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিভিন্ন ক্যাটাগরির র্যাঙ্কিং ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে আসছে।
রিউমর স্ক্যানার ইউএস নিউজের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন সময়ের আর্কাইভ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, সাইটটি প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরে এই র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে এবং এ–সংক্রান্ত জরিপ হয় সে বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে।
রিমউর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে ২০২৩ সালের র্যাঙ্কিংটি প্রকাশিত হয় সে বছরের ৬ সেপ্টেম্বর (জরিপ হয় সে বছরের ১৭ মার্চ থেকে ১২ জুন)। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান পাওয়ারে ৪০তম, ওভারঅল: ৬৯তম (মোট ৮৭ দেশের মধ্যে)। একইভাবে ২০২২ সালেরটি প্রকাশিত হয় সে বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর (জরিপ হয় সে বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ১৩ জুলাই)। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান পাওয়ারে ৪৪তম, ওভারঅল: ৭১তম (মোট ৮৫ দেশের মধ্যে)।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ থেকে রিউমর স্ক্যানার নিশ্চিত হয়েছে যে ২০২৫ সালের র্যাঙ্কিং এখনো প্রকাশ করেনি ইউএস নিউজ। রেওয়াজ অনুযায়ী তা চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হবে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১২৩তম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে বর্তমানে ৪৭তম অবস্থানে এসেছে। তবে ওয়েবসাইটটির আর্কাইভ বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, বাংলাদেশ এই র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় ২০২২ সালে। ওই বছর থেকে পরবর্তী সময়গুলোতে র্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে: ২০২২ সালে ৮৫টি, ২০২৩ সালে ৮৭টি এবং ২০২৪ সালে ৮৯টি। এ পর্যন্ত কোনো বছরেই র্যাঙ্কিংয়ে ১২৩টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, ফলে বাংলাদেশের কখনো ১২৩তম অবস্থানে থাকার দাবি বাস্তবসম্মত নয়।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের এই র্যাঙ্কিং নিয়ে হঠাৎ আলোচনা শুরুর প্রেক্ষাপটও জানার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার। ৬ এপ্রিল রাতে গ্লোবাল স্ট্যাস্টিসটিক নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ইউএস নিউজকে সূত্র দেখিয়ে প্রথম এ–সংক্রান্ত পোস্টটি করা হয়। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।