শহর-গ্রাম সর্বত্র শব্দদূষণে মানুষ অতিষ্ঠ। শব্দদূষণের বড় কারণ দীর্ঘক্ষণ উচ্চ স্বরে মাইক চলা। একটি মাইকে ১০০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ তৈরি হয়। অথচ মানুষের জন্য এর সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল। এর চেয়ে অধিক মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হৃদযন্ত্রের কম্পন বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে হজম শক্তি কমে; মাংসপেশির খিঁচুনি হয় এবং শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, শব্দদূষণজনিত কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যা ম্যালেরিয়া ও এইডসে মৃত্যুর চেয়ে বেশে। এ তো গেল স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা। মাইকের অধিক শব্দের কারণে বাসাবাড়ির শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে; বয়োজ্যেষ্ঠদের ঘুম বিঘ্নিত হয়। শীতের সময় ধর্মীয় কাজে তথা ওয়াজ-মাহফিলের নামে রাতভর মাইক বাজানোর প্রচলন আমরা দেখছি। এতে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হয়। এমনকি বাসাবাড়িতে অবস্থানকারীদের ইবাদতেও বিঘ্ন ঘটে। রাস্তায় পণ্যের বিজ্ঞাপন, মিছিল-মিটিং, সমাবেশ, নির্বাচনী প্রচারকাজ এবং বিভিন্ন দিবসে পাড়া-মহল্লায় উচ্চস্বরে গান বাজানোর মাধ্যমেও শব্দদূষণ হয়ে থাকে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর অধীন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। কর্তৃপক্ষ সে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু স্বয়ং এই বিধিমালাই ধর্মীয় কাজে মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে আছে। কারণ সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে এর বাইরে রাখা হয়েছে।
যদিও মাইক ব্যবহার করে ধর্মীয় কাজ করার চেয়ে নীরবে ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে অধিক পুণ্য হাসিল করা যায়। ইসলামে ফরজ ইবাদতে সবচেয়ে পুণ্য লাভ করা যায়। অথচ এগুলো পালনে কোনো ক্ষতিকর শব্দের সৃষ্টি হয় না। মসজিদে নামাজ আদায়কালে শুধু ইমাম সাহেব মুখে কোরআন তেলাওয়াত করেন; সেটাও আবার পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে তিন ওয়াক্তে। বাড়িতে নামাজ পড়লেও কোনো শব্দের সৃষ্টি হয় না। রোজা পালনে কোনো শব্দ নেই। জাকাত প্রদানেও নেই। হজে শুধু বছরে একবার নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত লোকেরা মুখে ‘লাব্বাইক’ উচ্চারণ করেন; তাতে পরিবেশ দূষণ করার মতো শব্দ সৃষ্টি হয় না।
শব্দদূষণের সম্ভাব্য সব উৎস বন্ধ করা দরকার। আমাদের শব্দদূষণ আইন আছে বটে, কিন্তু এর প্রয়োগ কতটা আছে? নববর্ষেও সরকারের পক্ষ থেকে আতশবাজি বন্ধের মাধ্যমে শব্দদূষণ না করার অনুরোধ জানানো হয়ে থাকে। বাস্তবে রাজধানীতে যেই শব্দদূষণ দেখা যায়, তা দুঃখজনক। শব্দদূষণ আইনের প্রয়োগ জরুরি। তার আগে আইনটি বাস্তবতার আলোকে সংশোধন করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অনেক কিছুই সংস্কার করার কাজে মনোনিবেশ করেছে অন্তবর্তী সরকার। আশা করি, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালার আলোচিত ধারায় সংশোধন আনা করা যেতে পারে। আইন সংশোধন যদি সম্ভব নাও হয়, কিছু নীতিমালা প্রণীত হলেও করা দরকার, যা ধর্মীয় কাজে মাইক ব্যবহারের নির্দেশিকা হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
শেষে এসে ইংরেজি সাহিত্যের সেই বাঘ শিকারের গল্পের কথা বলা যাক। জনৈক ব্যক্তি তার প্রভাব প্রতিপত্তি প্রদর্শনের জন্য বাঘ শিকারের ইচ্ছা পোষণ করেন। দিনক্ষণ দেখে তিনি একদিন বনে গেলেন। গাছের তলায় ছাগল বেঁধে মাচায় অপেক্ষা করছেন। একসময় ছাগল খেতে বাঘ এলে লোকটা গুলি ছুড়লেন। বাঘ মারা গেল কিন্তু বাঘের গায়ে কোনো রক্ত বা গুলির চিহ্ন নেই। পোস্টমর্টেম করে জানা গেল, গুলিতে নয়; গুলির শব্দে বাঘটি মারা গেছে। সেই বাঘের মতো আমরাও অদৃশ্য উচ্চশব্দের ‘আঘাতে’ মারা যাচ্ছি না তো?
হোসেন আল-আমিন:
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জলবায়ু ন্যায়বিচারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে সমাবেশ
জলবায়ু সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধ, নবায়নযোগ্য শক্তির সম্প্রসারণ ও টেকসই কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবিতে সমাবেশ করেছেন অসংখ্য তরুণ-তরুণী।
শুক্রবার (১১ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের যুব প্ল্যাটফর্ম অ্যাক্টিভিস্টা বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজিত সমাবেশে বিশ্বনেতাদের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়।
সমাবেশ শেষে র্যালি করা হয়। র্যালিটি খামারবাড়ি থেকে আড়ং মোড় ঘুরে জাতীয় সংসদের সামনে দিয়ে আবার খামারবাড়ির সামনে এসে শেষ হয়।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তরুণ জলবায়ুকর্মীরা স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, চিত্রকর্ম, গান, নাটক এবং পোস্টার প্রদর্শনের মাধ্যমে জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি জানান। ‘ডোন্ট সেল আওয়ার ফিউচার’, ‘ফিক্স দ্য ফাইন্যান্স’, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করো, ‘ক্ষতিকারক কৃষিচর্চায় বিনিয়োগ বন্ধ করো’, ‘ক্লাইমেট জাস্টিস নাউ’ এবং ‘জলবায়ু সহনশীল টেকসই কৃষি চর্চায় বিনিয়োগ করুন’ ইত্যাদি লেখা ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড হাতে সমাবেশে যোগ দেন জলবায়ু আন্দোলনকারীরা। তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, ক্লাইমেট জাস্টিস’, ‘ব্যাংক তুমি ভালো হয়ে যাও, জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে দাও’, ‘জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ, ডেকে আনছে আমাদের দুর্যোগ’, ‘বেঁচে থাকার অধিকার, চাই জলবায়ু সুবিচার’, ‘নিড সলিউশন, নট পলিউশন’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
সমাবেশ থেকে টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর ও ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনে চলমান অমানবিক যুদ্ধের প্রতিবাদ ও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়।
সমাবেশে জলবায়ু যোদ্ধারা বলেন, উন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়নের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করছে। তারা নব্য ঔপনিবেশিক শোষণ, যুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে এ পৃথিবীকে ধ্বংস করছে। পুঁজিবাদী মানসিকতা নিয়ে সর্বোচ্চ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমণকারীরা জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়নের মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মানুষের চেয়ে মুনাফাই মুখ্য। এটি পৃথিবীতে বাস্তুতন্ত্র এবং জলবায়ুকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করছে। ফলে, বিরূপ প্রভাব পড়ছে দক্ষিণের দেশগুলোর তরুণ, কৃষক, নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোতে। এটি অনুন্নত দেশগুলোর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কাছে তাদের পরিবেশগত ঋণ বহু গুণ বাড়িয়ে তুলছে। এই অবস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে টেকসই প্রকল্প এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আহ্বান এসেছে গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইকে।
জলবায়ু সংকট নিরসন, এ বিষয়ে ন্যায়বিচার দাবি ও জনগণকে সচেতন করতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও অ্যাক্টিভিস্টা বাংলাদেশসহ ১৮ জেলার ৩৩টি যুব সংগঠনের ৩ হাজারের অধিক জলবায়ুকর্মী এই স্ট্রাইকে অংশ নেন। একই সময়ে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেট, কুষ্টিয়া, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, পটুয়াখালী, টেকনাফ, বান্দরবান, বরগুনা ও নারায়ণগঞ্জসহ লোকাল রাইটস প্রোগ্রাম (এলআরপি) এবং বেশকিছু লোকাল ইয়ুথ হাবের তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরাও গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইকে সংহতি প্রকাশ করেন।
এ সময় ফিলিস্তিনে চলমান অমানবিক যুদ্ধ বন্ধে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। যুদ্ধে অসংখ্য শিশু, নারী ও বৃদ্ধের মৃত্যুতে গভীর সহানুভূতি ও শোক প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা/হাসান/রফিক