গত বছর বিখ্যাত মেডিকেল  জার্নাল দ্য ল্যানসেটের একটি সংখ্যায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম ঝুঁকি। জার্নাল অনুসারে সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা খাতে খরচ হয় ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ১০ থেকে ২৫ শতাংশ রোগীদের পর্যন্ত পৌঁছায় না। জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের কো-ডিরেক্টর ভিম কিম নুয়েনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর এই চুরির কারণে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু মারা যায়; নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ৫৭ লাখ; দরিদ্র আয়ের দেশে ৮৪ লাখ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের পাবলিক হেলথের প্রফেসর ড.

মুস্তাক খানের গবেষণা বলছে, যেসব হাসপাতালে রিসোর্স কম, সেখানেই দুর্নীতি বেশি। অর্থাৎ গরিবের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় লোপাটের জন্য বেশি দায়ী। বেশির ভাগ দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পোস্টগুলো বণ্টন হয় রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঘুষে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে রিক্রুটমেন্ট, ট্রান্সফার, পোস্টিং, প্রমোশনে মেধার তোয়াক্কা করা হয় না বললেই চলে। ফলে তৈরি হয় অনিয়ম ও চুরির সূতিকাগার। অর্থ লোপাটের কারণ ঘুষ, যার কোনো মানি রিসিট হয় না। অথচ স্বার্থসিদ্ধি হয়। স্বার্থের সংঘাতে এক দেশ অন্য দেশের বা এক কোম্পানি অন্য কোম্পানির বা এক চিকিৎসক অন্য চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রডাক্ট বা পলিসি বা মুনাফা বা রিপোর্ট সম্পর্কে অপবাদ বা প্রতিবেদন দেয়। সরকারি বা আন্তর্জাতিক অর্থ বা ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রী আত্মসাৎ করে। যেমন কভিড-১৯ এর সময় বহু দেশে আমলারা পিপিই স্বাস্থ্যসেবা দানকারী কর্মীদের না দিয়ে নিজেরাই পরে বসে ছিলেন বাসায় বা অফিসে। কভিড-১৯ অতিমারিকালে বহু স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর বরাদ্দকৃত ভাতা আজও দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত হোটেল খরচ হোটেল মালিকদের সঙ্গে ওভার প্রাইসিং করে, ৫০ শতাংশ করে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বহু দেশের রাজনৈতিক নেতা বা আমলারা। ওভার ইনভয়েস করে বিদেশ থেকে ১০ হাজার ডলারের জিনিস কেনা হয় ৫০ হাজার ডলারে; মেডিকেল সেক্টরে রিক্রুটমেন্ট, পোস্টিং, ট্রান্সফার ও প্রমোশনের সময় স্বচ্ছভাবে কারণ দর্শানো হয় না বা জনসমক্ষে আনা হয় না; সরকারি মেডিকেল সামগ্রী বা ওষুধ কালোবাজারে যে বিক্রি হয়, তার নমুনা আমাদের দেশেও বহুবার মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে র‍্যাবের অভিযানে প্রমাণিত।

বর্তমানে চীনে পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ডের কোম্পানির ইলেকট্রো-মেডিকেল যন্ত্রাদি তৈরি হচ্ছে। একই মেশিন নানা মানের নানা দামের হয়ে থাকে, কিন্তু লেভেল সবারই এক। সাপ্লাইয়ার কোটেশন দেয় বেশি দামেরটা, গ্যারান্টি দেয় এক বছরের আর ওয়ারেন্টি দেয় ১০ বছরের। নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যন্ত্র স্থাপন করে কমিশন করতেই লাগে এক বছর। ততদিনে গ্যারান্টি শেষ, বাকি থাকে ওয়ারেন্টি। কিন্তু মেশিন নষ্ট হলে সেই পার্টস আমদানি করে মেশিন ঠিক করার আগেই তা ঝরঝরা হয়ে যায়, তখন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়। সুতরাং লোকসান হয় জনগণ বা সরকারের। 

রেফারেল সিস্টেমকে তোয়াক্কা না করে বা জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ না দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সামান্য সর্দি-কাশিরও রোগী দেখেন, যা অত্যন্ত বাজে উদাহরণ তৈরি হয় ভবিষ্যৎ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তারদের জন্য। নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ওষুধ তাদের ড্রাইভার বা পিয়ন দিয়ে ওষুধের দোকানে পাঠিয়ে বিনিময়ে অর্থ আনেন, যা দিয়ে তাঁর সাপোর্ট স্টাফের বেতন দেন; মেডিকেল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের এয়ার টিকিট উপহার হিসেবে দেন। ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে অধ্যয়নরত নিজ সন্তানদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান আফ্রিকার বহু চিকিৎসক। বহু হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয় কমিশন খাওয়ার জন্য, আমলাতন্ত্রের সহায়তায়। অনেক হাসপাতালে ইলেকট্রো-মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, অথচ সেই যন্ত্র চালানোর কোনো টেকনিশিয়ানের পোস্টই ক্রিয়েট করা হয়নি। ভুয়া সার্টিফিকেটধারী ডাক্তারে আমাদের উপমহাদেশসহ আফ্রিকান দেশগুলো ছেয়ে গেছে। সিআইডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৫০০ ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে। আমাদের দেশে তো নামকরা হাসপাতালের পরিচালক ও ডাক্তারের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেটই ছিল ভুয়া; মেডিকেল ফিল্ডে ভারতের স্থান ১৯৫-এর মধ্যে ১৪৫। বহু স্বাস্থ্যসেবা দানকারী দিনের পর দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ২৬ লাখ মানুষ মারা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের ভুল চিকিৎসার কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২.৫ লাখ রোগী মারা যায় প্রতিবছর স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের ভুল চিকিৎসায়। এর ৭০ শতাংশই মারা যায় ডাক্তার, নার্স, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও রোগীর মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে। সুতরাং মানুষের জীবন নিয়ে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলা এক ধরনের দুর্নীতি। অতএব পৃথিবীতে রোগীর তুলনায় কোয়ালিফায়েড ডাক্তার, নার্স ও হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে; রোগীদের অসুবিধা পরিপূর্ণভাবে শুনতে হবে; বিহেভিরাল সায়েন্স পড়ে মনেপ্রাণে তা ধারণ করে রোগীদের সেবা দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের  মধ্যে টিমওয়ার্ক বাড়াতে হবে। এগুলোর জন্য দরকার গুড গভর্ন্যান্স, স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি সেক্টরে অটোমেশন সিস্টেম, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, থার্ড পার্টির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ অডিট, প্রত্যেকের যোগ্যতানুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক, কর্মদক্ষতা অনুযায়ী প্রণোদনা। কন্টিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন প্রোগ্রাম পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রতিটি শহরের প্রতিটি হাসপাতালে প্রতি ১৫ দিনে ন্যূনতম ১.৫ ঘণ্টার জন্য চালু থাকতেই হবে; মালপত্র কেনার সময় সাপ্লাইয়ারদের ইতিহাস ও গুণগত মান জনসমক্ষে এনে প্রতিযোগিতামূলক দাম প্রকাশ করতে হবে; রোগী ও সমাজকে আরও সচেতন করতে হবে; রোগীর ফিডব্যাক পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করতে হবে; দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মাফিয়াগিরি।  

ডা. গোলাম শওকত হোসেন: 
চিকিৎসক ও শিক্ষক 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

তামিমের কাছে গত আসরের শিরোপাটাই বেশি তৃপ্তির

শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) বিপিএল ফাইনাল ম্যাচ শুরু হওয়ার আগ থেকেই ক্রিকেটপ্রেমীদের একটাই কৌতুহলী প্রশ্ন। তামিম ইকবাল কী নিজের নাম লেখাতে পারবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং ইমরুল কায়েসের পাশে? সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তামিমও উঠে গেলেন ম্যাশ-কায়েসদের এলিট ক্লাবে। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পর এখন ফরচুন বরিশালও যে টানা দুই বিপিএলে সেরা। তবে বরিশাল অধিনায়ক তামিমের কাছে নাকি হিসেবে দ্বিতীয় গত মৌসুমের প্রথম শিরোপাটাই বিশেষ।

বিপিএলের ২০২৪ সালের আসরে প্রথমবারের মত বরিশালে নাম লেখান তামিম। সাথে ছিলেন জাতীয় দলের দীর্ঘদিনের সতীর্থ মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। এই তিনজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছাড়াও মেহেদি হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং তাইজুল ইসলামের মত জাতীয় দলের একঝাঁক ক্রিকেটার খেলেছিলেন বরিশালে।

আরো পড়ুন:

মিরাজ ম্যান অব দ্য বিপিএল, কে জিতলেন কোন পুরস্কার 

বিপিএলের রোল অব অনার

 

তবে দলটিতে ডেভিড মিলার ছাড়া বড় নামের বিদেশী কেউ ছিলেন না। কিলার খ্যাত মিলারও খেলেছিলেন শেষ কয়েকটা ম্যাচ। তবে কাইল মায়ার্স ছিলেন আসরের শুরু থেকেই। অন্যদিকে জেমস ফুলার এবং ওবেড ম্যাকয়ের মত কার্যকরী বিদেশীরা যোগ দিয়েছিলেন শেষের দিকে।

এতকিছুর পরও কুড়ি ওভারের সংস্করণের উপযোগী দেশি ক্রিকেটার বেশি ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস এবং রংপুর রাইডার্সের। অন্যদিকে এই দুই দলের বিদেশি কোটায় খেলেছিল আইপিএল-বিগ ব্যাশ কাঁপানো সব ক্রিকেটাররা। সে তুলনায় খানিকটা পিছিয়েই ছিল বরিশাল। তবে দলটির ম্যানেজম্যান্ট থেকে ক্রিকেটার, সবাই ছিলেন এক সুতোয় গাঁথা। অন্যদিকে তামিমের নেতৃত্বগুণে ফেভারিট কুমিল্লাকে হারিয়ে বিপিএলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বরিশাল।

২০২৪ এর বিপিএলের বরিশাল প্রথম চার ম্যাচে মাত্র একটি জিতে শুরুতেই চাপে পড়েছিল। পরে লিগ পর্বের শেষ পাঁচ ম্যাচে চারটি জিতে তৃতীয় হয়ে প্লে-অফের টিকেট নিশ্চিত করে তারা। দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে সে কথায় উঠে এসেছে তামিমের কন্ঠে, “আমার কাছে মনে হয়, গতবারের যাত্রাটা ছিল এপিক! সেটি আমার হৃদয়ের খুব খুব কাছের। কিছু দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম, সেবার অর্ধেক টুর্নামেন্ট থেকেই আমরা বাদ পড়ার এক ম্যাচ দূরে ছিলাম। সেখান থেকে জিততে জিততে সেমি-ফাইনালে (প্লে-অফে) এসে পুরোপুরি ভিন্ন দল হয়ে যাওয়া। ব্যাটিং ও বোলিংয়ে মেয়ার্সের অবদান অসাধারণ ছিল। এমনকি আজকেও। তো ওই ট্রফিটা জেতা... প্রথমবার বরিশালের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বরিশালের মানুষের জন্য। সেটি আমাদের হৃদয়ের খুব কাছের।”

পরিসংখ্যান বলছে গতবছরের সঙ্গে বরিশালের এবারের পারফরম্যান্সেরও বিস্তর ব্যবধান। এই ব্যাপারটাও যোগ করেলেন তামিম, “এই বছর আমরা আসরজুড়ে দাপট দেখিয়েছি। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে দুই ম্যাচ ও চিটাগং কিংসের বিপক্ষে এক ম্যাচ শুধু (হেরেছে)... এর বাইরে পুরো টুর্নামেন্ট আধিপত্য দেখিয়েছি। আমাদের যখন ১৭০-১৮০ রানের চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে, খুব ভালো রেসপন্স করেছি। আজকেও, খুলনার সঙ্গেও। এটিও বিশেষ অনুভূতির। তবে দুটির মধ্যে বেছে নিতে বললে আমি সবসময় প্রথমটি নেবো।”

দুবারই শিরোপা জয়েই দারুণ অবদান রেখেছেন তামিম। গত আসরের সর্বোচ্চ ৪৯২ রান ছিল এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। এবারের ফাইনালে দুইশ ছুঁই-ছুঁই রান তাড়া করতে নেমে চিটাগংয়ের পেসার বিনোরা ফার্নান্দোকে যেভাবে চার্জ করে খেললেন তাতেই ম্যাচের মোমেন্টাম বদলে গিয়েছে। বিনোরা এবারের আসরের সবচেয়ে কৃপণ বোলার ছিলেন। অন্যদিকে তামিম ২০২৫ আসরে করেছেন ৪১৩ রান।
“আমার কথা... আমার মনে হয়, অন্যটি (২০২৪ সালের) ভালো ছিল। বিশেষ করে এই কারণে যে... যা কিছু ঘটেছিল, এরপর যেভাবে ফিরে এসেছি, আমি রান করেছি। প্রায় সব পুরস্কার মনে হয় পেয়েছিলাম। সেটি বিশেষ ছিল। তবে আজকের ইনিংস... এই ধরনের ইনিংস আমাকে বিশ্বাসটা দেয় আমার মধ্যে এখনও (ভালো করার সামর্থ্য) আছে।”

ঢাকা/নাভিদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ