জবরদস্তি করে মুছতে গেলে বুমেরাং হতে পারে
Published: 8th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক একই সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চেরও শীর্ষস্থানীয় নেতা। সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা বামপন্থি এ নেতা লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। দীর্ঘসময় কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত সাইফুল হক জন্মগ্রহণ করেছেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১৯৫৬ সালে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: সরকারের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে আপনার প্রাথমিক মূল্যায়ন কী?
সাইফুল হক: ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পর একটা অস্থির, অনিশ্চিত সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মতো একটা সরকারের ছয় মাস টিকে থাকাকেই আমি বড় সাফল্য বলে মনে করি। এর মধ্যে নানা নাশকতা ছিল; সরকারকে ব্যর্থ করা বা তার বদনাম করার বহু চেষ্টা ছিল। অর্থাৎ নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও সরকার তার কাজ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছে। মোটা দাগে সরকার এখনও সঠিক ধারায় আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, ১৬ বছরের অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া তারা শুরু করেছে; দ্বিতীয়ত, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল একটা অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ লক্ষণীয়; তৃতীয়ত, রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা এগিয়ে যাচ্ছে; একই সঙ্গে সম্ভাব্য দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়েও তারা একটা ধারণা ও প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে তার ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। একটা সাফল্য হলো, ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটা স্পষ্ট ও শক্ত বার্তা দেওয়া গেছে– গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ নতুন এক বাংলাদেশ। সমতা, ন্যায্যতা, সমঅংশীদারিত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে আমরা ভারতসহ সবার সঙ্গে সম্পর্ক চর্চা করব।
সমকাল: কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতা দেখছেন?
সাইফুল হক: ঘাটতি বা দুর্বলতা হলো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের অগ্রাধিকার থাকলেও তা পূরণ হয়নি। অতীতের রাজনৈতিক সরকারের মতো বিশেষ কোনো মহলের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে বাছবিচারহীন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। যে অলিগার্করা অর্থনীতির ওপর চেপে বসেছিল; পুরো না হলেও এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। ফলে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন বা দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। জননিরাপত্তা বিষয়েও আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। এক ধরনের নৈরাজ্য আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি; অন্তর্বর্তী সরকারের সমান্তরাল অনেক সরকার যেন সক্রিয়। একটা ধারণা জনমনে বিরাজমান, একদিকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার, আরেকদিকে আমলাদের সরকার কাজ করছে। একই সঙ্গে ছাত্ররাও যেন আলাদা এক সরকার চালাচ্ছে। সরকারকে মানুষ দুর্বল মনে করছে; কার্যকর সরকার বলে মনে করছে না। সরকারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত কার্যক্ষেত্রে সুফল নিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় মানুষের মনে হতাশা তৈরি হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে– এ ধরনের সরকার দিয়ে হবে না। তাদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন নেই, তবে রাষ্ট্র চালানোর জন্য যে দক্ষতা, সামর্থ্য দরকার, তার ঘাটতি ফুটে উঠছে।
সমকাল: এ পরিস্থিতির কারণেই কি আমরা ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সরকারের সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি?
সাইফুল হক: কোন বিতর্ক?
সমকাল: বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব ঘটানো উচিত নয়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও সমন্বয়করা স্পষ্ট করে বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের বিচার হওয়ার পরই কেবল নির্বাচন হবে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো এ সরকারেরই করা উচিত বলে মনে করেন।
সাইফুল হক: আপনি ঠিক বলেছেন। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। এক ধরনের অবিশ্বাস-সন্দেহও কাজ করছে। তার জন্য দায়ী হলো কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা; রাজনৈতিক দল নয়। দেখা গেছে, সরকার অনেকাংশেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এড়িয়ে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা করছে; কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের প্রয়োজনে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দলগুলোকে ডাকলেও ১০-১৫ মিনিটের এক প্রকার বুড়িছোঁয়ার মতো কথা বলছে। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে দলগুলোর অর্গানিক বা জীবন্ত কোনো বোঝাপড়া বা সংযোগ নেই। অন্যদিকে, কিছু দল ইতোমধ্যে সরকারের গুডবুকে ঢুকে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের কথা উঠলেই তাদের কপালে ভাঁজ পড়ছে। অথচ গত ১৬ বছর ধরে মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ নির্বাচনের অপেক্ষাটা ছয় মাস নয়, ১৬ বছরের। রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অংশ নির্বাচন ও সংস্কারকে মুখোমুখি করতে চায়। এটা ভুল উপস্থাপনা। কেউ বলেনি, যেনতেন একটা নির্বাচন করতে হবে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথাই আমরা বলছি। বিচারের পর নির্বাচন হবে– এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হলো, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি; একটা বিচার সুষ্ঠু ও প্রশ্নহীনভাবে করতে গেলে অবশ্যই সময় লাগে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তড়িঘড়ি বিচার করতে গেলে তা নিয়ে দেশের ভেতরে এবং বাইরেও প্রশ্ন উঠবে। বিচারের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এই ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধের বিচার যেমন প্রতিহিংসার ফল ছিল না; তেমনি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারও দলটির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিহিংসার বিষয় নয়। এটা সবার কাছে প্রতিভাত করতে হলেও বিচারের একটা যৌক্তিক সময় দিতে হবে। যারা বিচারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চান, তারা আসলে এক প্রকার দোষারোপের খেলা খেলছেন। একটা অনিশ্চিত সময় পর্যন্ত সরকারের আয়ু তারা বাড়াতে চান। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার যে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে– এটা তো পরিষ্কার। অহেতুক তার মেয়াদ বাড়াতে গেলে সরকার নানা বিতর্কের মধ্যে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরও বাড়বে; এমনকি এক প্রকার বিরোধিতার মুখেও তারা পড়তে পারে।
সমকাল: ছাত্রদের দল গঠন বিষয়ে আপনার মত কী?
সাইফুল হক: আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, ছাত্ররা দল গঠন করতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করলে তাদের এ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে নতুন দল গঠনে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার মানে সরকার তার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাও হারাবে। যদিও সরকারপ্রধান বলেছেন, সরকারের নিয়োগকর্তা ছাত্ররা, বাস্তবে সব রাজনৈতিক দল তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। সেই হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার সবার সমর্থিত একটি অদলীয় সরকার। এখন ছাত্রদের নতুন দল গঠনে রাষ্ট্র সুযোগ-সুবিধা দিলে আগামী নির্বাচন এ সরকারের অধীনে হবে কিনা– সে প্রশ্নও উঠবে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। আমরা এ ধরনের নতুন কোনো সংকট চাই না। আমরা এখনও এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন চাই। মনে রাখতে হবে, এই সরকার নিরপেক্ষতা হারালে ছাত্রদের প্রস্তাবিত দলও সংকটে পড়বে। অতীতে কোনো কিংস পার্টিকে মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেদিক থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে ছাত্রদের যে সম্ভাবনা আছে, তাও নষ্ট হবে।
সমকাল: গত ছয় মাসে আমরা বিশেষত ছাত্রদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান ছুড়ে ফেলা, জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করতে দেখেছি। ৫ ফেব্রুয়ারি ৩২ নম্বর ঘিরে নতুন এক ইস্যু তৈরি করা হলো। এগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাইফুল হক: প্রথম কথা হলো, ছাত্ররা বা তাদের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ মনে করেন, দেশে একটা বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বিপ্লব হলে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে এ সরকার শপথ নিত না। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সও প্রয়োজন হতো না। সত্য, অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তবে তা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আর আপনি যেসব ইস্যুর কথা বলবেন সেগুলো হলো রাজনৈতিক এজেন্ডা। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা বলি জনযুদ্ধ। কিন্তু সে যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার-এলএফওর অধীনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে। এটা ছিল এক প্রকার দখলদারিত্ব। এবারের অভ্যুত্থান নিয়েও এ ধরনের দখল চেষ্টা চলছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, ছাত্র-তরুণরা গত ১৬ বছর স্বৈরশাসনবিরোধী যে সংগ্রাম হয়েছে, তাকে অস্বীকার করে। এমনকি প্রায় কোটি মানুষের জেল-জুলুম ভোগকে হেয় করে অভ্যুত্থানকে ব্যবহারের মাধ্যমে এক প্রকার রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়েছে। আর এ লক্ষ্যে একটার পর একটা ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। ৫ ফ্রেব্রুয়ারি রাত থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারাদেশে বিভিন্ন ভবন গুঁড়িয়ে দিয়ে যে বুলডোজার রাজনীতি চালু করা হয়েছে, তাও ওই রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টারই অংশ। গত কয়েক মাসে তাদের শব্দ, ভাষা, বাক্যের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-তরুণরা বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। এ ফাঁকটা পূরণ এবং রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার জন্য তারা এসব কাজ করছে। দুর্ভাগ্যবশত সরকারেরও এ ক্ষেত্রে এক প্রকার মদদ কাজ করেছে বলে মানুষ মনে করে। শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ফাঁদে আপনি পা দেবেন কেন? এর জবাবে ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দিতে হবে কেন? আপনি তো ওই বক্তব্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবেন; সে জন্য সভা-সমাবেশ-মিছিল করবেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি ফ্যাসিজম মোকাবিলা করছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে আপনি আরেক ধরনের ফ্যাসিবাদী কৌশল নিতে পারেন না। তা করার মধ্য দিয়ে আপনি কিন্তু ফ্যাসিজমের কোর্টেই খেলছেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি– দেশের বিশালসংখ্যক মানুষ এ আচরণকে গ্রহণ করেনি।
সমকাল: বহির্বিশ্বেও কি ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ভালো কোনো বার্তা দেবে?
সাইফুল হক: একেবারেই না। আমরা দেখেছি, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনা একটা জঙ্গিবাদী অভ্যুত্থান হিসেবে প্রমাণের নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ৩২ নম্বরে জড়ো হওয়া মানুষদের মুখে যেসব স্লোগান শোনা গেছে, সেগুলোও শেখ হাসিনার ওই চেষ্টাকেই সহজ করে দেবে বলে আমার আশঙ্কা।
সমকাল: বিএনপির সঙ্গে আপনারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। বর্তমানে আপনাদের সম্পর্কটা কেমন চলছে?
সাইফুল হক: বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সময় আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, ৫ আগস্টের পর তেমনটা নেই। এমনিতে যোগাযোগ আছে; মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। তবে বিভিন্ন সংকটে আরও যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বা কথাবর্তা দরকার, সে রকম কিছু হয় না। খানিকটা দূরত্বও চলছে বলে আমাদের অর্থাৎ গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা মনে করেন। আগামী নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের কথা বিএনপি বলছে, তবে তা একান্তই বিএনপির চিন্তা। আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের আগে সংসদ নির্বাচনে ঐক্যের প্রশ্নটির সমাধান হতে হবে। আন্দোলনের সময় যে ঐক্য ছিল, তা নির্বাচন নিয়েও তৈরি করা যাবে কিনা– সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। হয়তো ভবিষ্যতে এ নিয়ে পরস্পর আলোচনা হবে।
সমকাল: বিএনপি তো সম্প্রতি সমমনাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। আপনাদের সঙ্গে কি করেছে?
সাইফুল হক: হয়েছে, তবে আমরা তা সংবাদমাধ্যমে দিইনি।
সমকাল: আওয়ামী লীগের নির্বাচন করা নিয়ে কোনো আলোচনা কি আপনারা নিজেদের মধ্যে করেছেন? যেমন বিএনপি অনেকবারই বলেছে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোটে গুঁড়িয়ে দিতে চায়, নিষিদ্ধ করে নয়। আবার ছাত্রনেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
সাইফুল হক: আমি মনে করি, একটা জনসম্পৃক্ত দলকে নিষিদ্ধ করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয় না। কাউকে মুছে ফেলতে চাইলে তাকে আদর্শিক-রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে হবে। জবরদস্তি করে মুছে ফেলতে গেলে ইতিহাস পাল্টা কিন্তু তাদেরই মুছে দেয়। এটা বিশ্ব ইতিহাসের একটা সাধারণ শিক্ষা। ছাত্রলীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এর আগেও কোনো কোনো দল ও সংগঠনকে এভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা অকার্যকর প্রমাণিত। যতক্ষণ নিষিদ্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ দলটির নির্বাচনে কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনার ফল কী দাঁড়াবে তার ওপরেও নির্ভর করে। তবে আওয়ামী লীগের যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদের বিচার হতে হবে। সেটা ছাড়া ওই নেতাদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। আর দলটির মধ্যে যারা কোনো অপরাধে জড়িত নয়, তারা অন্যদের অপরাধ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন, নতুন কী বক্তব্য নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবেন এবং সেটা জনগণের মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয়, এসব বিষয়ই বলে দেবে আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের স্থান কী হবে। এ বিষয়ে আপাতত এটুকুই বলতে পারি।
সমকাল: শেষ কথা হিসেবে কিছু বলবেন?
সাইফুল হক: একদিকে ঝুঁকে যাওয়ার কারণে সরকার আমাদের সমর্থন-সহযোগিতাকে কাজে লাগাতে পারছে না। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে– এমন উপসংহার টানতে চাই না। সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে; কারও বাড়াবাড়ি বা অতিকথনের জন্য অর্জনটা যাতে হাতছাড়া না হয়, সে প্রত্যাশাই আমি করি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত তারা দেবে।
সমকাল: ধন্যবাদ।
সাইফুল হক: সমকালকেও ধন্যবাদ।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর র র জন ত ক সরক র য় সরক র সরক র র র সরক র এ সরক র ১৬ বছর দল গঠন র জন য ক জ কর আম দ র ট র পর কর ছ ন সমক ল অপর ধ র একট ব এনপ আপন র গ রহণ র সময় ধরন র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জবরদস্তি করে মুছতে গেলে বুমেরাং হতে পারে
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক একই সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চেরও শীর্ষস্থানীয় নেতা। সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা বামপন্থি এ নেতা লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। দীর্ঘসময় কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত সাইফুল হক জন্মগ্রহণ করেছেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১৯৫৬ সালে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: সরকারের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে আপনার প্রাথমিক মূল্যায়ন কী?
সাইফুল হক: ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পর একটা অস্থির, অনিশ্চিত সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মতো একটা সরকারের ছয় মাস টিকে থাকাকেই আমি বড় সাফল্য বলে মনে করি। এর মধ্যে নানা নাশকতা ছিল; সরকারকে ব্যর্থ করা বা তার বদনাম করার বহু চেষ্টা ছিল। অর্থাৎ নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও সরকার তার কাজ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছে। মোটা দাগে সরকার এখনও সঠিক ধারায় আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, ১৬ বছরের অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া তারা শুরু করেছে; দ্বিতীয়ত, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল একটা অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ লক্ষণীয়; তৃতীয়ত, রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা এগিয়ে যাচ্ছে; একই সঙ্গে সম্ভাব্য দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়েও তারা একটা ধারণা ও প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে তার ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। একটা সাফল্য হলো, ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটা স্পষ্ট ও শক্ত বার্তা দেওয়া গেছে– গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ নতুন এক বাংলাদেশ। সমতা, ন্যায্যতা, সমঅংশীদারিত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে আমরা ভারতসহ সবার সঙ্গে সম্পর্ক চর্চা করব।
সমকাল: কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতা দেখছেন?
সাইফুল হক: ঘাটতি বা দুর্বলতা হলো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের অগ্রাধিকার থাকলেও তা পূরণ হয়নি। অতীতের রাজনৈতিক সরকারের মতো বিশেষ কোনো মহলের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে বাছবিচারহীন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। যে অলিগার্করা অর্থনীতির ওপর চেপে বসেছিল; পুরো না হলেও এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। ফলে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন বা দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। জননিরাপত্তা বিষয়েও আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। এক ধরনের নৈরাজ্য আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি; অন্তর্বর্তী সরকারের সমান্তরাল অনেক সরকার যেন সক্রিয়। একটা ধারণা জনমনে বিরাজমান, একদিকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার, আরেকদিকে আমলাদের সরকার কাজ করছে। একই সঙ্গে ছাত্ররাও যেন আলাদা এক সরকার চালাচ্ছে। সরকারকে মানুষ দুর্বল মনে করছে; কার্যকর সরকার বলে মনে করছে না। সরকারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত কার্যক্ষেত্রে সুফল নিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় মানুষের মনে হতাশা তৈরি হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে– এ ধরনের সরকার দিয়ে হবে না। তাদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন নেই, তবে রাষ্ট্র চালানোর জন্য যে দক্ষতা, সামর্থ্য দরকার, তার ঘাটতি ফুটে উঠছে।
সমকাল: এ পরিস্থিতির কারণেই কি আমরা ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সরকারের সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি?
সাইফুল হক: কোন বিতর্ক?
সমকাল: বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব ঘটানো উচিত নয়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও সমন্বয়করা স্পষ্ট করে বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের বিচার হওয়ার পরই কেবল নির্বাচন হবে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো এ সরকারেরই করা উচিত বলে মনে করেন।
সাইফুল হক: আপনি ঠিক বলেছেন। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। এক ধরনের অবিশ্বাস-সন্দেহও কাজ করছে। তার জন্য দায়ী হলো কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা; রাজনৈতিক দল নয়। দেখা গেছে, সরকার অনেকাংশেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এড়িয়ে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা করছে; কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের প্রয়োজনে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দলগুলোকে ডাকলেও ১০-১৫ মিনিটের এক প্রকার বুড়িছোঁয়ার মতো কথা বলছে। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে দলগুলোর অর্গানিক বা জীবন্ত কোনো বোঝাপড়া বা সংযোগ নেই। অন্যদিকে, কিছু দল ইতোমধ্যে সরকারের গুডবুকে ঢুকে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের কথা উঠলেই তাদের কপালে ভাঁজ পড়ছে। অথচ গত ১৬ বছর ধরে মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ নির্বাচনের অপেক্ষাটা ছয় মাস নয়, ১৬ বছরের। রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অংশ নির্বাচন ও সংস্কারকে মুখোমুখি করতে চায়। এটা ভুল উপস্থাপনা। কেউ বলেনি, যেনতেন একটা নির্বাচন করতে হবে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথাই আমরা বলছি। বিচারের পর নির্বাচন হবে– এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হলো, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি; একটা বিচার সুষ্ঠু ও প্রশ্নহীনভাবে করতে গেলে অবশ্যই সময় লাগে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তড়িঘড়ি বিচার করতে গেলে তা নিয়ে দেশের ভেতরে এবং বাইরেও প্রশ্ন উঠবে। বিচারের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এই ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধের বিচার যেমন প্রতিহিংসার ফল ছিল না; তেমনি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারও দলটির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিহিংসার বিষয় নয়। এটা সবার কাছে প্রতিভাত করতে হলেও বিচারের একটা যৌক্তিক সময় দিতে হবে। যারা বিচারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চান, তারা আসলে এক প্রকার দোষারোপের খেলা খেলছেন। একটা অনিশ্চিত সময় পর্যন্ত সরকারের আয়ু তারা বাড়াতে চান। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার যে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে– এটা তো পরিষ্কার। অহেতুক তার মেয়াদ বাড়াতে গেলে সরকার নানা বিতর্কের মধ্যে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরও বাড়বে; এমনকি এক প্রকার বিরোধিতার মুখেও তারা পড়তে পারে।
সমকাল: ছাত্রদের দল গঠন বিষয়ে আপনার মত কী?
সাইফুল হক: আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, ছাত্ররা দল গঠন করতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করলে তাদের এ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে নতুন দল গঠনে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার মানে সরকার তার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাও হারাবে। যদিও সরকারপ্রধান বলেছেন, সরকারের নিয়োগকর্তা ছাত্ররা, বাস্তবে সব রাজনৈতিক দল তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। সেই হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার সবার সমর্থিত একটি অদলীয় সরকার। এখন ছাত্রদের নতুন দল গঠনে রাষ্ট্র সুযোগ-সুবিধা দিলে আগামী নির্বাচন এ সরকারের অধীনে হবে কিনা– সে প্রশ্নও উঠবে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। আমরা এ ধরনের নতুন কোনো সংকট চাই না। আমরা এখনও এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন চাই। মনে রাখতে হবে, এই সরকার নিরপেক্ষতা হারালে ছাত্রদের প্রস্তাবিত দলও সংকটে পড়বে। অতীতে কোনো কিংস পার্টিকে মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেদিক থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে ছাত্রদের যে সম্ভাবনা আছে, তাও নষ্ট হবে।
সমকাল: গত ছয় মাসে আমরা বিশেষত ছাত্রদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান ছুড়ে ফেলা, জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করতে দেখেছি। ৫ ফেব্রুয়ারি ৩২ নম্বর ঘিরে নতুন এক ইস্যু তৈরি করা হলো। এগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাইফুল হক: প্রথম কথা হলো, ছাত্ররা বা তাদের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ মনে করেন, দেশে একটা বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বিপ্লব হলে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে এ সরকার শপথ নিত না। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সও প্রয়োজন হতো না। সত্য, অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তবে তা হচ্ছে একটা রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আর আপনি যেসব ইস্যুর কথা বলবেন সেগুলো হলো রাজনৈতিক এজেন্ডা। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা বলি জনযুদ্ধ। কিন্তু সে যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার-এলএফওর অধীনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে। এটা ছিল এক প্রকার দখলদারিত্ব। এবারের অভ্যুত্থান নিয়েও এ ধরনের দখল চেষ্টা চলছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, ছাত্র-তরুণরা গত ১৬ বছর স্বৈরশাসনবিরোধী যে সংগ্রাম হয়েছে, তাকে অস্বীকার করে। এমনকি প্রায় কোটি মানুষের জেল-জুলুম ভোগকে হেয় করে অভ্যুত্থানকে ব্যবহারের মাধ্যমে এক প্রকার রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়েছে। আর এ লক্ষ্যে একটার পর একটা ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। ৫ ফ্রেব্রুয়ারি রাত থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারাদেশে বিভিন্ন ভবন গুঁড়িয়ে দিয়ে যে বুলডোজার রাজনীতি চালু করা হয়েছে, তাও ওই রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টারই অংশ। গত কয়েক মাসে তাদের শব্দ, ভাষা, বাক্যের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-তরুণরা বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। এ ফাঁকটা পূরণ এবং রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার জন্য তারা এসব কাজ করছে। দুর্ভাগ্যবশত সরকারেরও এ ক্ষেত্রে এক প্রকার মদদ কাজ করেছে বলে মানুষ মনে করে। শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ফাঁদে আপনি পা দেবেন কেন? এর জবাবে ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দিতে হবে কেন? আপনি তো ওই বক্তব্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবেন; সে জন্য সভা-সমাবেশ-মিছিল করবেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি ফ্যাসিজম মোকাবিলা করছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে আপনি আরেক ধরনের ফ্যাসিবাদী কৌশল নিতে পারেন না। তা করার মধ্য দিয়ে আপনি কিন্তু ফ্যাসিজমের কোর্টেই খেলছেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি– দেশের বিশালসংখ্যক মানুষ এ আচরণকে গ্রহণ করেনি।
সমকাল: বহির্বিশ্বেও কি ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ভালো কোনো বার্তা দেবে?
সাইফুল হক: একেবারেই না। আমরা দেখেছি, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনা একটা জঙ্গিবাদী অভ্যুত্থান হিসেবে প্রমাণের নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ৩২ নম্বরে জড়ো হওয়া মানুষদের মুখে যেসব স্লোগান শোনা গেছে, সেগুলোও শেখ হাসিনার ওই চেষ্টাকেই সহজ করে দেবে বলে আমার আশঙ্কা।
সমকাল: বিএনপির সঙ্গে আপনারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। বর্তমানে আপনাদের সম্পর্কটা কেমন চলছে?
সাইফুল হক: বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সময় আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, ৫ আগস্টের পর তেমনটা নেই। এমনিতে যোগাযোগ আছে; মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। তবে বিভিন্ন সংকটে আরও যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বা কথাবর্তা দরকার, সে রকম কিছু হয় না। খানিকটা দূরত্বও চলছে বলে আমাদের অর্থাৎ গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা মনে করেন। আগামী নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের কথা বিএনপি বলছে, তবে তা একান্তই বিএনপির চিন্তা। আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের আগে সংসদ নির্বাচনে ঐক্যের প্রশ্নটির সমাধান হতে হবে। আন্দোলনের সময় যে ঐক্য ছিল, তা নির্বাচন নিয়েও তৈরি করা যাবে কিনা– সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। হয়তো ভবিষ্যতে এ নিয়ে পরস্পর আলোচনা হবে।
সমকাল: বিএনপি তো সম্প্রতি সমমনাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। আপনাদের সঙ্গে কি করেছে?
সাইফুল হক: হয়েছে, তবে আমরা তা সংবাদমাধ্যমে দিইনি।
সমকাল: আওয়ামী লীগের নির্বাচন করা নিয়ে কোনো আলোচনা কি আপনারা নিজেদের মধ্যে করেছেন? যেমন বিএনপি অনেকবারই বলেছে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোটে গুঁড়িয়ে দিতে চায়, নিষিদ্ধ করে নয়। আবার ছাত্রনেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।
সাইফুল হক: আমি মনে করি, একটা জনসম্পৃক্ত দলকে নিষিদ্ধ করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয় না। কাউকে মুছে ফেলতে চাইলে তাকে আদর্শিক-রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে হবে। জবরদস্তি করে মুছে ফেলতে গেলে ইতিহাস পাল্টা কিন্তু তাদেরই মুছে দেয়। এটা বিশ্ব ইতিহাসের একটা সাধারণ শিক্ষা। ছাত্রলীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এর আগেও কোনো কোনো দল ও সংগঠনকে এভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা অকার্যকর প্রমাণিত। যতক্ষণ নিষিদ্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ দলটির নির্বাচনে কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনার ফল কী দাঁড়াবে তার ওপরেও নির্ভর করে। তবে আওয়ামী লীগের যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদের বিচার হতে হবে। সেটা ছাড়া ওই নেতাদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। আর দলটির মধ্যে যারা কোনো অপরাধে জড়িত নয়, তারা অন্যদের অপরাধ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন, নতুন কী বক্তব্য নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবেন এবং সেটা জনগণের মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয়, এসব বিষয়ই বলে দেবে আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের স্থান কী হবে। এ বিষয়ে আপাতত এটুকুই বলতে পারি।
সমকাল: শেষ কথা হিসেবে কিছু বলবেন?
সাইফুল হক: একদিকে ঝুঁকে যাওয়ার কারণে সরকার আমাদের সমর্থন-সহযোগিতাকে কাজে লাগাতে পারছে না। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে– এমন উপসংহার টানতে চাই না। সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে; কারও বাড়াবাড়ি বা অতিকথনের জন্য অর্জনটা যাতে হাতছাড়া না হয়, সে প্রত্যাশাই আমি করি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত তারা দেবে।
সমকাল: ধন্যবাদ।
সাইফুল হক: সমকালকেও ধন্যবাদ।