ভালোবাসা দিবসের আগেই ব্রেকআপ নাকি পরে, কোনটা ভালো?
Published: 8th, February 2025 GMT
একসময়ের মিষ্টি-মধুর প্রেমের সম্পর্কও নানা কারণে বিষিয়ে ওঠে। তিক্ততা জমে জমে গড়ে ওঠে অভিযোগের পাহাড়। এমন তিক্ততা কাটিয়ে সম্পর্কটা এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠলে বিচ্ছেদই হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন দোদুল্যমান সম্পর্কের মধ্যে অনেকেই আছেন। বিচ্ছেদের পরিকল্পনা করতে গিয়ে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, বিশেষ দিনটির কথা। কিন্তু এই যুগলেরা সম্পর্কটাকে কি ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেনে নেবেন নাকি ইতি টানবেন এখনই?
যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকির সেন্টার কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মরগান কোপ মনে করেন, বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত একজনের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। তাই এটা হুটহাট নেওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নয়। তবে সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত আগেই নিশ্চিত হয়ে থাকলে শুধুই ভালোবাসা দিবস আসছে বলে তা টেনে নেওয়াও অনুচিত।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতেও যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই পক্ষই সন্দিহান, শুধু একটি দিনকে কেন্দ্র করে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোনো অর্থ নেই। যাঁর প্রতি আপনার আর কোনো অনুভূতি কাজ করছে না, তাঁর সঙ্গে ভালোবাসা দিবস কাটানো বরং আপনার জন্য মানসিকভাবে চাপ তৈরি করতে পারবে। তাই এমন ভাঙনের সামনে দাঁড়িয়ে বিশেষ দিনটি নিয়ে পরিকল্পনা করার চেয়ে বিচ্ছেদের পথে এগোনোই ভালো। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, ভালোবাসা দিবসের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ব্রেকআপ করার। এতে দুই পক্ষই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় পান।
প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। তাই বিচ্ছেদের পর নিজেকে বা প্রাক্তনকে অপরাধী না ভেবে বরং সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবুন। অতীতের কথা না ভেবে নিজেকে সময় দিন, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিন, নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন এবং প্রাক্তনের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখুন।
নিজেদের মধ্যে জমা হওয়া ভুল–বোঝাবুঝি অবসানের উপলক্ষও হতে পারে ভালোবাসা দিবস.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত যে পরিবর্তন জরুরি
ধর্ষণ নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত অপরাধ। তবে এটি সামাজিক ও কাঠামোগত সমস্যাও বটে, যা সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্য, লিঙ্গগত বৈষম্য এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইনের শৈথিল্য, বিচারহীনতা, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সামাজিক নীরবতার মতো নানা কারণ কাজ করছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও আইনগত প্রতিকার প্রয়োজন হলেও শুধু এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতীত ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কারণ এটি শুধু অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয় নয়; বরং সমাজে নারীর অবস্থান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কথায় আছে– ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভরতা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। বাংলাদেশে নারীদের একটি বড় অংশ এখনও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। ফলে তারা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক সময় নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েও তা প্রকাশ করতে পারে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, সমান মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে নারীরা অধিক আত্মনির্ভরশীল হবেন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি পাবেন।
গণমাধ্যম ও বিনোদন জগতে নারীদের উপস্থাপনা ধর্ষণের সংস্কৃতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র, নাটক ও বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘বস্তু’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর। যেহেতু মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীদের ইতিবাচক ও মর্যাদাসম্পন্নভাবে উপস্থাপন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো ধর্ষণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়ও ধর্ষণের কাঠামোগত সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে নারীরা অনলাইন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা অনেক সময় সাইবার ব্ল্যাকমেইল ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সূত্রপাত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে, যা তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সাইবার আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা নারীদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন, যা ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী করার প্রবণতা তৈরি করে। এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে ধর্মীয় নেতাদের সচেতন করা ও ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কমিউনিটি পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় ধামাচাপা দেওয়া হয় বা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়, যা অপরাধীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপ, নারীদের স্ব-সহায়ক দল ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে নারীরা সাহসী হয়ে অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবেন এবং সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। পুরুষদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। পুরুষদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।
মো. ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার,
বাংলাদেশ পুলিশ, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি
অব ওয়ারউইকে পিএইচডি গবেষক
emranahmmed1991@gmail.com