সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উভয় সংকট বলে অভিহিত করেছিল।

এই গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিয়ান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দর-কষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এ বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে।’

দর-কষাকষি শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের পর থেকেই। গণ–অভ্যুত্থানের একটি পক্ষ চেয়েছিল সংবিধান বাতিল করে বিপ্লবী সরকার হোক। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হোক। অন্য পক্ষ এর বিরোধিতা করে বলল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই সরকার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি মেনে নেওয়া হলো এবং যারা বিপ্লবী সরকার গঠনের পক্ষে ছিলেন, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন উপদেষ্টা হিসেবে শপথও নিলেন।

আজ ৮ ফেব্রুয়ারি। অন্তবর্তী সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হলো। ৮ আগস্ট যখন ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা চলছিল। তিন দিন কোনো সরকার ছিল না। পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা।

আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে সরকার যার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ছিল, সেই পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে বলা যাবে না। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়। তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়।  

সরকারের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ‘জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে তারা।’

কিন্তু সাধারণ মানুষ তো অর্থনীতির সূত্র বা দুরাবস্থার কার্যকারণ বুঝতে চাইবে না। তারা দেখতে চাইবে, সারা দিন পরিশ্রম করে যে টাকা উপার্জন করেন, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে কিনা। সন্তানের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ মোটানো যায় কিনা। নিত্যপণ্যের দাম না কমলে জনঅসন্তোষ বাড়বেই।  

সরকারের অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য উদঘাটন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচার। তথ্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে সরকার বেশ কিছু কমিটি গঠন করেছে এবং তারা প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। অভ্যুত্থানের সময়ে গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধবিরোধী ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে।

এ ছাড়া ফৌজদারি আইনেও সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীর নামে মামলা হলেও সেই তুলনায় গ্রেপ্তার হয়েছে কম। ঢালাও মামলার কারণে বিচারপ্রক্রিয়া আরও প্রলম্বিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি শতাধিক বা তারও বেশি মামলা হয় (বেশির ভাগই হত্যা মামলা), তার তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্য জোগাড় করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। কেউ চান সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন। আবার অন্যদের দাবি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সংস্কার করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করুক। এখানে নির্বাচনকে সংস্কারের কিংবা সংস্কারকে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবে সমীচীন নয়।

সরকার যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় অর্থনীতি পেয়েছিল, সেটা কিছুটা শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে পেরেছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংসের কিনার থেকে মোটামুটি উদ্ধার করা গেছে। কমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারেও স্থিতি রক্ষা করা গেছে। তবে সমস্য হলো নতুন বিনিয়োগ নেই। বেকারত্ত বাড়ছে। সামাজিক অপরাধ ও সংঘাতের এটাও কারণ।

তবে শিল্প খাতে অস্থিরতা চলছে। দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁদের মালিকানাধীন অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।

অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। শুরুতে শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্য ও পদবাণিজ্য চলছিল, তা পুরোপুরি রহিত হয়নি। দাবি দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রায়ই জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে। সরকার সিদ্ধান্ত নেয় রাস্তা বন্ধ করার পর, আগে নয়।

আওয়ামী লীগ আমলে স্বাস্থ্য খাত যে শোচনীয় অবস্থায় ছিল,তার উত্তরণ ঘটেনি। একটি উদাহরণ দিই। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব নিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৬ মাস পরও  চিকিৎসার দাবিতে তাদের বার বার রাস্তায় নামতে হচ্ছে।

রাজনৈতিক পরিসরেও কোনো সুসংসদ দেখছি না। ৫ আগস্টের পর অভ্যুত্থানকারী শক্তিগুলোর মধ্যে যেই ঐকসূত্র ছিল, তা অনেকটাই ছিন্ন হয়ে গেছে। মাঠে এক পক্ষ অন্য পক্ষের কঠোর সমালোচনা করছে, যা কখনো কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ আমলের শেষ তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা স্বৈরাতান্ত্রিক কায়দায় দেশ চালিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার ছিল, তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করবে। এই লক্ষ্যে সরকার যে ১১টি কমিশন গঠন করে, বেশির ভাগ কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে কমিশনপ্রধানসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সরকারের আলোচনার কথা রয়েছে।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। কেউ চান সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন। আবার অন্যদের দাবি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সংস্কার করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করুক। এখানে নির্বাচনকে সংস্কারের কিংবা সংস্কারকে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবে সমীচীন নয়।

অন্তর্বর্তী সরকার কোনো পক্ষ নয়। তাদের কাজ সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানো। এই আলোচনা তখনই সফল হবে, যখন রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতৃত্ব ও অন্যান্য অংশীজন খোলামনে আলোচনা করে নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে এটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে। কোনো এক পক্ষ যদি গো ধরে বসে, তাহলে  আলোচনা ওখানেই শেষ।

গত ৫৩ বছরে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় হলো না, তার পেছনে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় আছে। সমস্যাটি কেবল গত ১৫ বছরের নয়। এর আগেও যাঁরা শাসন করেছেন, তাঁরা দেশকে গণতন্ত্র ও সুশাসন উপহার দিতে পারেননি। ফলে তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তা নাকচ করার সুযোগ নেই।

আবার সংস্কারের বিষয়ে যেই সিদ্ধান্তই হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে জনরায়কেও মেনে নিতে হবে। কোনোভাবে নির্বাচনী বৈতরনী পার হয়ে সবকিছু ভুলে যাওয়া এবং স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ চালানোর পরিণতি কী হয় নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।

লেখাটি যখন শেষ করছি, তখনই খবর পেলাম, জাপানি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা আছে। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে।’ তিনি বলেছেন, ‘চলতি বছরের শেষ ভাগে’।

এই সাক্ষাৎকারের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যাদের মনে সংশয় ছিল, তা কেটে যাবে আশা করি।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক সরক র র শ ষ কর ক র কর র জন য ব যবস আওয় ম বছর র চলছ ল আগস ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

জার্মানিতে ৩ বছরে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিধান বাতিল হচ্ছে

জার্মানির নতুন সরকার তিন বছরে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিধান বাতিল করতে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসতে যাওয়া নতুন জোটের চুক্তিপত্রে এমনটাই বলা হয়েছে। 

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর চলতি সপ্তাহে সরকার গঠনের লক্ষ্যে জোট গঠন করে রক্ষণশীল সিডিইউ-সিএসইউ এবং মধ্য বামপন্থি এসপিডি। জোটের চুক্তি অনুযায়ী, নতুন সরকার জার্মানির নাগরিকত্ব আইনে কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।

ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বাধীন বিদায়ী সরকার নাগরিকত্ব আইন সহজ করার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল। এর মধ্যে রয়েছে জার্মান সমাজে একীভূত হওয়ার শর্তসাপেক্ষে তিন বছর জার্মানিতে অবস্থান করা বিদেশিদের নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ। সিডিইউ-সিএসইউর নেতৃত্বাধীন নতুন জোট সরকার এ আইনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বছরের ওই বিধান বতিল করা। তবে নির্বাচনের আগে আলোচনায় আসা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দ্বৈত নাগরিকদের জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করাবিষয়ক কোনো বিধান রাখছে না নতুন সরকার। পাশাপাশি পাঁচ বছর পর নাগরিকত্ব পাওয়ার আইনও বহাল থাকছে।

তিন বছরের এই নাগরিকত্ব পেতে বিদেশিদের সি১ লেভেলের জার্মান ভাষার দক্ষতা এবং জার্মান সমাজে একীভূত হওয়ার জোরালো প্রমাণ উপস্থাপন করার বিধান যুক্ত করা ছিল। সেই সময় থেকেই রক্ষণশীল সিডিইউ-সিএসইউ এই বিধানের সমালোচনা করে আসছিল। সূত্র: ডয়চে ভেলে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ