অনুমোদন ছাড়াই বাড়তি খরচ, পরিবর্তন নকশায়
Published: 8th, February 2025 GMT
প্রকল্পের সংশোধন অনুমোদন হয়নি। এর আগেই কোনো কোনো খাতে টাকা খরচ হয়ে গেছে। প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করে বাড়তি দরে কাজ শুরু হলেও নেওয়া হয়নি যথাযথ অনুমোদন। এমন আরও কিছু অনিয়ম হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পে।
কোনো কোনো অঙ্গের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব যুক্ত করে প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে ২৫৩ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে এতে। এমনকি প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর।
প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব বা আরডিপিপি নিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্পটির বিভিন্ন অনিয়ম নজরে আসে। এ নিয়ে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রকল্পটির বিভিন্ন অঙ্গের নকশা পরিবর্তন ও ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন ও বর্ধিত দরে কার্যক্রম শুরু এবং সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য ড.
প্রসঙ্গত, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় ছয় বছর ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে আসছে। এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬২০
কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
পরবর্তী সময়ে ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই দুই দফায় এর মেয়াদ বাড়ে। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তাতেও কাজের অগ্রগতি হয় খুব কম। সর্বশেষ এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করতে সংশোধন প্রস্তাব গেছে পরিকল্পনা কমিশনে। এবার মোট ব্যয় কিছুটা কমিয়ে ১ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কোনো কোনো অঙ্গে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়াতে চেয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
অনুমোদন ছাড়া নকশা পরিবর্তন ও বাড়তি ব্যয়
প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন প্রস্তাব বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় অনুমোদন ছাড়াই নকশা পরিবর্তন ও ব্যয় বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রকল্পের বিভিন্ন ডিজাইন পরিবর্তন ও বর্ধিত দরে কার্যসম্পাদন শুরুর আগে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। পানি-সংক্রান্ত প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের আগে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক পিইসি সভায় জানান, প্রকল্পের স্বার্থে নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্তির আগেই কিছু ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি সব ব্যয় অনুমোদিত ডিপিপির সীমার মধ্যেই রয়েছে। তবে কোন কোন খাতে কত টাকার ব্যয় অনুমোদন ছাড়া হয়েছে, তার বিস্তারিত পিইসি সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি।
বৈঠকে প্রকল্পের রিটেইনিং ওয়াল, ফ্লাড ওয়াল ও রেগুলেটর নির্মাণসহ বিভিন্ন অঙ্গের ডিজাইন পরিবর্তন ও ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিরূপণ এবং এসব খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ আছে কিনা, তা যাচাই করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এই কমিটিতে রয়েছেন বাপাউবো, ওয়ারপো এবং আইডব্লিউএমের প্রতিনিধি। এ ছাড়া পরিবর্তিত নকশার বিষয়ে ওয়ারপোর অনাপত্তি সনদ নিয়ে পুনর্গঠিত আরডিপিপিতে তা যুক্ত করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব
পিইসি সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, আড়াই কিলোমিটার রাস্তা উঁচুকরণ ও ১টি ব্রিজের সংস্কারের জন্য মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ২৫৩ শতাংশ বেশি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। সভায় আরও বলা হয়, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, রাস্তা উঁচু করা ও ১টি ব্রিজের সংস্কার তিনটি পৃথক কাজ। এগুলোকে পৃথক অঙ্গ হিসেবে দেখাতে হবে। সাধারণত, একটি প্যাকেজে অনেক কাজ দেখানো হলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রাখার সুযোগ থাকে।
রেগুলেটর নির্মাণকাজের সংখ্যা কমানো হলে সেখানেও ইউনিটপ্রতি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে ১৭৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। ফ্লাড ওয়াল নির্মাণকাজের পরিমাণ কমিয়ে ১৮ দশমিক ৯৬ কিলোমিটারের পরিবর্তে ৬ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১৪৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
এ অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে পিইসির সদস্যরা জানতে চাইলে পিইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক বলেন, ভৌত কাজের ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন এবং রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে ব্যয় বাড়ানোর এ প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে।
নির্ধারিত সময়ের পর সংশোধন প্রস্তাব
উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার অন্তত তিন মাস আগে সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদিত সীমা পার হলে তা আর কোনোভাবেই প্রক্রিয়া করার সুযোগ নেই। এ প্রকল্পটির বর্ধিত মেয়াদ পার হওয়ার চার মাস পর গত ১৩ নভেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধন প্রস্তাব পাঠানো হয়।
যা বলছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির নিয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান সমকালকে বলেন, এ প্রকল্পে অনুমোদনের আগে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। সংশ্লিষ্ট নকশা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেছে এবং সে অনুযায়ী ব্যয় হয়েছে।
ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে রিটেইনিং ওয়াল কাজের সঙ্গে সংশোধিত ডিপিপিতে রাস্তা উঁচুকরণ এবং একটি ব্রিজ সংস্কার কাজ যুক্ত করার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুমোদন করেছেন। পরবর্তী অনুমোদনের জন্য যা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, জাতীয় অর্থনীতিতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। নগরীর জলাবদ্ধতা প্রায়ই ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন তৈরি করে। নাগরিক জীবনে চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ গুরুত্ব বিবেচনা থেকেই বড় ব্যয়ের প্রকল্পটি নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা মুক্ত করাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনায় সম্প্রতি জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে একটি সভা হয়। এতে তিনজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী তিন সংস্থাকে নিয়ে বৈঠক করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। গত সপ্তাহে জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন চারজন উপদেষ্টা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নকশ প রকল প প য় প রকল প প রকল প র য ক ত কর উপদ ষ ট ত ব কর র নকশ
এছাড়াও পড়ুন:
বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া চ্যানেলে অভিযান, ১৮ জলদস্যু আটক
কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া চ্যানেলে অভিযান চালিয়ে লুট করা মাছসহ ১৮ জলদস্যুকে আটক করেছে কোস্টগার্ড।
শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) তাদের আটক করা হয়। এ সময় ‘এফবি মায়ের দোয়া ১৭৯’ নামে একটি মাছ ধরার ট্রলার জব্দ করা হয়, যেখানে লুট করা মাছ ছিল। পরে জব্দকৃত মাছ উন্মুক্ত নিলামে তোলা হলে মাছ ব্যবসায়ী নাছির উদ্দীন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় মাছগুলো ক্রয় করেন।
কক্সবাজার সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুজয় পাল এ তথ্য জানিয়েছেন।
কোস্টগার্ড জানায়, গত বুধবার রাতে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের অদূরে সাগরে মাছ ধরার সময় একটি মাছ ধরার ট্রলার জলদস্যুর কবলে পড়ে। এ সময় জলদস্যুরা ওই ট্রলারের জেলে বেলালকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং অন্য জেলেদের হত্যার হুমকি দিয়ে ট্রলারটিতে থাকা মাছ, ব্যবহৃত মোবাইল ও নগদ টাকা লুট করে নেয়। এরপর দস্যুরা ট্রলারের ইঞ্জিন ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায়।
পরে দস্যুদের কবলে পড়া জেলেরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিলে মহেশখালী থেকে অন্য একটি ট্রলার গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে জলদস্যুদের আটক করে কোস্টগার্ড।
কক্সবাজার ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন জানান, গত তিন মাসে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ৫০টির বেশি মাছ ধরার ট্রলার জলদস্যুর কবলে পড়েছে। দস্যুবাহিনীর গুলিতে এক জেলে নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপকে জলদস্যুরা প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে, আর কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে জলদস্যুদের লুট করা মাছ কিনে নিচ্ছেন। তিনি জলদস্যুদের পাশাপাশি এই অসাধু ব্যবসায়ী ও দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
আটক ১৮ জলদস্যুকে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
ঢাকা/তারেকুর/টিপু