সাহসী সাহাবি হজরত যুবাইর (রা.)
Published: 8th, February 2025 GMT
খন্দকের যুদ্ধের সময়ের কথা। মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা মুসলমানদের সঙ্গে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি ভেঙে ফেলে। রাসুল (সা.) তাঁদের অবস্থা জানতে গুপ্তচর হিসেবে কাউকে পাঠাতে চাইলেন। সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে তিনি তিনবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তাদের সংবাদ নিয়ে আসতে পারবে? প্রত্যেকবারই যুবাইর (রা.
রাসুল (সা.) যুবাইর (রা.)-এর উদ্দীপনায় সংকট হয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেক নবীরই একজন ঘনিষ্ঠ অনুসারী থাকে। যুবাইর আমার অনুসারী।
মক্কায় একবার এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে অবিশ্বাসীরা রাসুল (সা.)–কে বন্দী অথবা হত্যা করেছে। খবরটি শোনামাত্র একটি বালক ক্ষিপ্ত হয়ে তলোয়ার হাতে বেরিয়ে পড়ল। ঘটনাটির সত্য–অসত্য নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে হাজির হলো রাসুল (সা.) এর দরবারে। রাসুল (সা.) তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
সে উত্তর দিল, আমি শুনেছি আপনি বন্দী অথবা নিহত হয়েছেন। তাই আমি প্রতিশোধ নিতে বেরিয়েছি।
তাঁর প্রতি বালকটির এমন ভালোবাসা আর সাহস দেখে রাসুল (সা.) অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি বালকটির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
আরও পড়ুনজানাজার নামাজের নিয়ম ও ফজিলত ২৩ নভেম্বর ২০২৩যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) নামে সেই বালকটিই ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের একজন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন।
যুবাইর (রা.)–এর মা হজরত সাফিয়া ছিলেন রাসুল (সা.)–এর ফুপু এবং যুবাইর (রা.)–এর স্ত্রী আসমা বিনতে আবু বকর ছিলেন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)–এর বোন।
অল্প বয়স থেকেই যুবাইর (রা.) ছিলেন খুব দুঃসাহসী। ছোটবেলা থেকেই তিনি বড় বড় পালোয়ান ও শক্তিশালী লোকদের সঙ্গে কুস্তি লড়তেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনন্য। অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে ইসলামের প্রায় সব যুদ্ধেই অসামান্য অবদান রেখেছেন।
বদরের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের আঘাতে যুবাইর (রা.)–র শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। একটি ক্ষতের গভীরতা গর্তের মতো হয়ে যায়। পরে তাঁর ছেলে বলেছিল, আমরা বাবার সেই গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম।
আরও পড়ুনপাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেভাবে এল২৬ ডিসেম্বর ২০২৩উহুদের ময়দানে যখন পরিস্থিতি মুসলিমদের প্রতিকূলে গিয়ে রাসুল (সা.) অরক্ষিত হয়ে পড়েন, সে সময় যে ১৪ জন সাহাবি নিজেদের জীবনের বিনিময়ে রাসুল (সা.)-কে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ করেন যুবাইর (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর এমন দুঃসাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর মা সাফিয়া (রা.)–র অবদান ছিল অনেক।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সা.) মুসলিম সেনাবাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন। সর্বশেষ এবং ছোট দলটিতে ছিলেন রাসুল (সা.) নিজে। এ দলটির পতাকাবাহী ছিলেন যুবাইর (রা.)।
উহুদ যুদ্ধে তাঁর মামা হজরত হামজা (রা.) শাহাদত বরণ করেন তাঁর মা সাফিয়া (রা.) ভাইয়ের কাফনের জন্য দু টুকরো কাপড় নিয়ে আসেন। মামার পাশেই ছিল একজন আনসারি সাহাবির লাশ। একটি লাশের জন্য দুটি কাপড় হবে, আরেকটি লাশ থাকবে কাফনহীন—এ ব্যাপারটি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি দুজনের মধ্যে ভাগ করার জন্য কাপড় দুটি মাপলেন। লটারি করে বিষয়টি সমাধান করে দুজনের জন্য দু টুকরো কাপড় দিয়ে কাফন করলেন।
উমর (রা.)–এর শাসনামলে ইয়ারমুক নামে একটি যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে যুবাইর (রা.) অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধে যুবায়ের (রা.) মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। উমর (রা.)–র মৃত্যুর পর শূরা কমিটিতে খলিফা নির্বাচনের জন্য যে ছয়জন সাহাবির নাম ছিল, তাঁদের একজন ছিলেন যুবাইর (রা.)।
ইসলামের ইতিহাসে যুবাইর (রা.)–র অসামান্য অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন।
আরও পড়ুননামাজে অন্য চিন্তা আসবে না অর্থ বুঝে পড়লে১৯ জানুয়ারি ২০২৪উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একজন গেরিলা নেতার ‘জুয়াখেলা’
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ‘তারকা’ গেরিলা নেতা আবদুল্লাহ ওজালান। তুরস্ক সরকারের হাতে মারমারা সাগরে এক দ্বীপে নির্জন কারাবাসে আছেন প্রায় ২৫ বছর। তুরস্কের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার কাছেও তিনি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি সবাইকে বিস্মিত করে স্বজাতির গেরিলাদের প্রতি প্রতিরোধযুদ্ধ থামিয়ে বাহিনী ভেঙে দিতে বলেছেন ওজালান। ওজালান কেন এটা বললেন? তুরস্ক ও আশপাশের অঞ্চলে এর ফলাফল কী হতে পারে, সে বিষয়ে ভাবাচ্ছে দুনিয়ার অনেককে।
চার দশকের গোলাগুলি থামছে
ওজালানকে কুর্দিরা ‘অপো’ বলে ডাকে। কুর্দিদের ভাষায় অপো মানে আংকেল। এ কেবল ওজালানের বয়স ৭৭ হওয়ার কারণে নয়, তাঁর রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব স্বীকৃতিও। ফলে এটা অস্বাভাবিক নয়, ওজালানের আহ্বানের পরই ‘পিকেকে’ নামে পরিচিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি দ্রুত অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, আক্রান্ত না হলে তারা এখন থেকে আর গুলি ছুড়বে না। ওজালানই এই গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।
নেতার আহ্বান পুরোটা এখনই বাস্তবায়ন করেনি পিকেকে। গোলাগুলি থামিয়ে তারা প্রতিপক্ষ তুরস্কের সরকারের প্রতিদান দেখতে চায়। শুরুতেই তারা ওজালানের মুক্তি চেয়েছে। ইঙ্গিত দিয়েছে, ওজালান ফিরে এলেই কেবল তাঁর মতামত শুনে তারা অস্ত্র ছাড়তে পারে।
অনেকেরই কৌতূহল, পিকেকে কিসের বিনিময়ে বা কোন চাপে প্রতিরোধযুদ্ধ থামাচ্ছে? তাদের দলের ভেতর সব সংগঠক এ রকম উদ্যোগে সম্মত হবে কি না?
অস্ত্রবিরতি বনাম রাষ্ট্রীয় দমন–পীড়ন
প্রায় দেড় কোটি কুর্দি আছে তুরস্কে। পুরো জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ ভাগ হবে। তুর্কিদের সামরিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে কুর্দিদের গেরিলাযুদ্ধের বয়স ৪১ বছর হলো। উভয় পক্ষে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছেন দীর্ঘ এই সংঘাতে।
কুর্দিদের হাতে অস্ত্র নেওয়ার পেছনে আদি লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। এখন তারা চাইছে মূলত সিরিয়া-ইরাকসহ আশপাশের কুর্দি অঞ্চল নিয়ে বৃহত্তর এক স্বশাসিত এলাকা, যেখানে তারা নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারবে। বিশেষ করে তুরস্কের সংবিধানে সেই ধারা নিয়ে (অনুচ্ছেদ ৬৬) বিতর্ক বেশ চলমান, যেখানে নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে তুর্কি হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এতে কুর্দিদের জাতীয়তা সাংবিধানিকভাবে অনেকখানে অস্বীকৃত। তারা মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারও চায়।
অস্ত্রবিরতির ঘোষণার আগে এসব বিষয়ে বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা যায়নি। কুর্দি ভাষা ও কুর্দিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার চেষ্টা ১৯৮০ সাল থেকে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়েছে তুরস্কে। তুর্কি জাতিবাদীদের একাংশ বরাবরই বলে, কুর্দিরা হলো ‘পাহাড়ি তুর্কি’ মাত্র।
এসব অতীত অভিজ্ঞতার পরও যে ওজালান পিকেকেকে অস্ত্র ত্যাগ করতে বলছেন, সেটা হয়তো গোপন কোনো আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঘটছে। এমনও ভাষ্য রয়েছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর সেখানে তুরস্কের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে কুর্দিদের আন্তসীমান্ত সামরিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ছে বলেই ওজালান নতুন অবস্থান নিলেন।
তবে পিকেকে যখন তুরস্কের ভেতরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে, তখনো সিরিয়ায় এরদোয়ানের সৈনিকেরা সেখানকার কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। সিরিয়ায় ক্ষমতা দখলকারীদের তুরস্ক সরকার বারবার বলছে দেশটির কুর্দিদের রাজনৈতিক-সামরিক কাঠামো গুঁড়িয়ে দিতে।
তুরস্কের জন্য সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা একটা ঐতিহাসিক সুযোগ। যেহেতু ইরাক ও সিরিয়ায় ঢুকেও তুর্কির বাহিনী হামলা চালাতে পারছে, সে কারণে ইতিহাসে এই প্রথম কুর্দিরা সব সীমান্তে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় আছে। এই সুযোগে অনেক কম ছাড় দিয়েও হয়তো পিকেকেকে গেরিলা যুদ্ধ থেকে বের করে নিয়ে আসা যেতে পারে।
আঙ্কারায় সরকারি কর্তৃপক্ষের অনেকের মুখেই হঠাৎ কুর্দি ও তুর্কিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বারবার প্রচারিত হচ্ছে। প্রচারণা এমনভাবে হচ্ছে, যেন মনে হয়, কুর্দি সমস্যার কারণ পিকেকের সশস্ত্রতা ও ওজালানের ক্যাডাররা নেতার অনুরোধ রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চার দশক আগে কেন কুর্দিরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, সেই আলাপ উধাও করে দেওয়া হয়েছে।
ওজালানের একতরফা প্রস্তাবের মধ্যে দমন-পীড়নের কৌশল বেশ ভালোভাবেই চলছে। সেটা এ কারণে যে সব মতাদর্শের কুর্দিরা যেন ভাবতে বাধ্য হয়, এই অসহনীয় অবস্থা থেকে আত্মসমর্পণও ভালো। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহেও ৫১টি শহরজুড়ে এক অভিযানের মধ্য দিয়ে পিকেকের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২৮২ জনকে আটক করা হয়েছে। গত নির্বাচনে বিজয়ী কুর্দি জনপ্রতিনিধিদের অনেককে নানা অজুহাতে নির্বিঘ্নেই কারাগারে রেখে দিতে পারছে তুরস্কের সরকার।
ওজালান অস্ত্র ছাড়তে চান কেন
কুর্দি জাতিসত্তা তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশাপাশি ইরাক ও ইরানেও আছে বড় সংখ্যায়। আলাদা আলাদা রাজনৈতিক-সামরিক কাঠামো থাকলেও ঐতিহাসিকভাবে সব সীমান্তের কুর্দিরা আত্মরক্ষায় একটা যোগসূত্র রাখে। তা ছাড়া সব জায়গায় তারা স্বশাসনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
তুরস্কে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রশ্নে তুর্কি জনমত বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত। জাতিগত ও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এবং সামরিক আমলাতন্ত্র এ বিষয়ে ছাড় দিতে অনিচ্ছুক। তাদের কাছে ইরাক-সিরিয়া-তুরস্কের কুর্দি অঞ্চল হলো সন্ত্রাসী এক করিডর।
কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের এ রকম দলগুলো সম্প্রতি কুর্দিদের সঙ্গে আপস রফায় আসতে চাইছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়ের হলো, ডানপন্থী ন্যাশনাল মুভমেন্ট পার্টির ডেভলেট বাচ্চিলির ভূমিকা। এতকাল সামরিকভাবে কুর্দিদের দমনের কথা বললেও এখন তিনিই প্রধানত পিকেকের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তাঁর পাশে আছেন পার্লামেন্টের স্পিকার নুমান কুরতোমুশও। শান্তির সপক্ষে শেষের জনের আগ্রহে মনে হচ্ছে এরদোয়ানও এ বিষয়ে উৎসাহী। কারণ, উভয়ে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের সঙ্গে তুরস্কের রাজনীতির এই নাটকীয় পরিবর্তনের গভীর যোগ আছে বলেই সবাই বলছেন।
পিকেকে এটা নিশ্চিতভাবে খেয়াল করছে, তুরস্কের মদদপুষ্ট দামেস্কের ক্ষমতা দখলকারীরা নতুন সরকারে সেখানকার কুর্দিদের আমন্ত্রণ জানায়নি। অথচ তারাও আসাদবিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম শক্তি। মূলত আঙ্কারার চাপেই এটা ঘটল।
এরদোয়ান সব দেশে কুর্দিদের একঘরে করতে ইচ্ছুক। এ ছাড়া গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের বর্বরতা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থনও পিকেকের মতো মধ্যপ্রাচ্যের গেরিলা দলগুলোর জন্য অনেক নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তুরস্কের সরকার এ অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ নিতে তৎপর। বিশেষ করে ভবিষ্যতে যাতে কুর্দিদের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সুসম্পর্ক গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে তুরস্কের নীতিনির্ধারকেরা সতর্ক।
ইসরায়েল ইতিমধ্যে দক্ষিণ সিরিয়ায় একটা ‘বাফার জোন’ গড়েছে এবং এই এলাকায় তারা কুর্দিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে প্রভাবের বল বাড়াতে চায়। তবে ঐতিহাসিকভাবে পিকেকে এবং ওজালান উভয়ে ইহুদি জাতিবাদের কট্টরবিরোধী। প্রথম দিকে পিকেকের গেরিলাদের পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) প্রশিক্ষণও দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবছে
ওয়াশিংটনে নতুন সরকার আসার সঙ্গে কুর্দি অঞ্চলের বর্তমান ঘটনাবলির কোনো সংযোগ রয়েছে কি না, সেটা অনেকের কাছে অনুসন্ধানের এক বিষয় হয়ে উঠেছে এখন। কুর্দি প্রশ্নে তারা এক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দিদের দাবিদাওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে সহানুভূতি দেখিয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্প আমলে ওয়াশিংটনের নীতি-কৌশলের অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছে।
ওজালানের ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সিরিয়ার কুর্দিদেরও তারা অস্ত্র ছাড়তে বলবে কি না, সেটা অস্পষ্ট। সেটা সহজও হবে না। কারণ, এখানকার কুর্দিরা ময়দানে আইএসের অস্ত্রধারীদের মুখোমুখি রয়েছে।
কুর্দিদের হাতে কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধা আটক আছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন এবং সেখানে ইরানের অনুপস্থিতি আইএসের গতিশীলতা বাড়িয়েছে পুরো অঞ্চলজুড়ে, যা আবার একই সঙ্গে স্থানীয় কুর্দি মিলিশিয়াদের রক্ষণশীল অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। সিরিয়ায় প্রায় দেড় হাজার যোদ্ধা আছেন আইএসের এখনো। ওজালানের অস্ত্র ছাড়ার আহ্বান তাঁদের জন্য বেশ স্বস্তির।
পিকেকে অস্ত্রসমর্পণ করলে নিশ্চিতভাবে সেটা সিরিয়ার কুর্দি প্রতিরোধও দুর্বল করবে এবং তাদেরও রাজনৈতিক-সামরিকভাবে অনেকখানি নমনীয় ভূমিকা নিতে হবে সামনের দিনগুলোতে। কিন্তু সিরিয়া-ইরাকে আইএস এবং তুরস্কের বর্তমান সামরিক নীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেসব জায়গার কুর্দিদের পক্ষে ওজালানের একতরফা যুদ্ধবিরতি অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই।
সিরিয়ার কুর্দি সশস্ত্র দল এসডিএফের কমান্ডার মজলুম কোবানি ইতিমধ্যে বলেছেনও, পিকেকে যা ভাবছে, সেটা তুরস্কের ভূখণ্ডে প্রযোজ্য হবে। বাকি কুর্দি বিশ্বের জন্য তা অনুসরণের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ইরাকের কুর্দি নেতৃত্ব এই উদ্যোগ সমর্থন করছে। এমনকি কৌতূহলোদ্দীপকভাবে ওজালানের ঘোষণায় পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রও খুশি বলে জানা গেছে। ওজালানের ঘোষণা এভাবে বিশ্বের বহু জায়গার গেরিলা জগতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের এত দিনকার বিশ্বাস, পিকেকে ও সিরিয়ার সশস্ত্র কুর্দিদের একটা প্রভাব রয়েছে বেলুচদের সশস্ত্রতায়। এখন যেহেতু কুর্দিরা অস্ত্রের ওপর আস্থা হারাচ্ছে, হয়তো বেলুচদের ওপরও তার প্রভাব পড়বে। এর বাইরে ধারাবাহিকভাবে লিবিয়া, সিরিয়া, লেবাননে নৈরাজ্যকর অবস্থায় ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বিশেষভাবে খুশি। কারণ, অতীতে বিভিন্ন দেশের প্রগতিবাদী আদর্শের গেরিলা নেতাদের পলাতককালের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো এসব দেশ।
হয়তো অনেকের মনে আছে, ওজালানকে ১৯৯৯ সালে তুরস্ক যে হাতে পায়, সেটা ইসরায়েলের গোয়েন্দা সহায়তাতেই। সিআইএ, এমআইটি ও মোসাদ মিলে ওজালানকে আটক করতে পেরেছিল। এমনকি কুর্দি দমনাভিযানে ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলকে উন্নত অনেক সামরিক প্রযুক্তি দিয়েছিল তেল আবিব সরকার।
ওজালান ছাড়া পাচ্ছেন কবে
২০১৩ সালেও তুরস্কে এখনকার মতোই একটা শান্তি উদ্যোগ আড়াই বছর চলার পর থেমে যায়। তার দুই বছর পর অতীতের চেয়েও ব্যাপক হারে সহিংসতা বাড়ে। সে কারণেই হয়তো এবার সব পক্ষ আশাবাদ ছড়াচ্ছে কম কম। তবে শিগগির যা হতে পারে মনে হচ্ছে, তুরস্ক সরকার ওজালানকে ছেড়ে দেবে এবং তিনি পিকেকের কংগ্রেসে নিজস্ব চিন্তা তুলে ধরবেন। পর্দার অন্তরালে এ রকম একটা সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনা বেশ এগিয়েছে বলেই মনে হয়।
তবে মুক্তির পর সরকারি দিক থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রাপ্তি ছাড়া সামগ্রিক বিরূপ পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ওজালান অস্ত্রসমর্পণের আহ্বান জানালে, সেটা পুরো পিকেকে মেনে না–ও নিতে পারে। আর সামান্য হলেও কিছু স্বায়ত্তশাসনের ভেতর দিয়ে এটা হলে পুরো ঘটনাপ্রবাহ থেকে এরদোয়ান ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন।
গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনে খারাপ ফলের পর এটা তাঁর দলের জন্য বাড়তি অক্সিজেন হিসেবে কাজ করবে। সেই সুযোগে বর্তমান আইন সংশোধন করে এরদোয়ান তিন বছর পর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও প্রার্থী হয়ে যেতে পারেন। এ রকম সংশোধনের জন্য ৩৬০ জন এমপির সমর্থন দরকার। এরদোয়ানের দল এ কে পার্টির আছে ৩২১ জন। কুর্দিদের সঙ্গে সফল সমঝোতা হলে অন্য অনেক দল এরদোয়ানকে আরেক দফা নির্বাচন করার সুযোগ করে দিতে রাজি হতে পারে।
প্রশ্ন হলো, সম্ভাব্য সমঝোতায় কী থাকছে? কুর্দি-প্রতিবাদীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সেই ‘সন্ত্রাস দমনের প্রয়োজনে’ এত দিন নাগরিক সমাজে অনেকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ হয়েছে। এখন কী পাওয়ার বিনিময়ে ওজালান আগবাড়িয়ে এর সমাধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন, সেটা দেখতে সবাই বেশ আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে।
সবচেয়ে খারাপ বিকল্প হলো, একদম কোনো প্রাপ্তি ছাড়া কুর্দিদের অস্ত্রত্যাগ। তবে সেটাও এভাবে পরোক্ষে সমাজের জন্য লাভ বয়ে আনতে পারে যে এ রকম একতরফা ছাড় তুরস্কজুড়ে কৃত্রিম সামরিকায়ন ও দমন–পীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করার যুক্তি তৈরি করবে। এতে দেশটিতে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে এবং সেটা কুর্দিদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগও বাড়াবে।
বিষয়টা উল্টোভাবেও সত্য। কুর্দি–সমস্যার সমাধান তুরস্কে গণতান্ত্রিক সংস্কারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এক বিষয়। ওজালান কুর্দিদের অস্ত্র ছাড়াতে পারলে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দায় চাপবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের ওপর। অস্ত্রহীন কুর্দিরা এভাবে তুরস্কে জাতিগত সম্পর্ক সংস্কারের অনেক গণতান্ত্রিক মিত্র পেতে পারে। কুর্দিবান্ধব পিপলস ইকুইটি অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক পার্টিও এই সুযোগে বিকশিত হতে পারে আরেক ধাপ।
কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে ওজালানের দিক থেকে এসবই হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় এক ‘জুয়াখেলা’। ভূরাজনৈতিক নতুন বাস্তবতা তাঁকে হয়তো এ রকম ঝুঁকি নিতে বাধ্য করেছে।
আলতাফ পারভেজ গবেষক ও লেখক