আমজাদ আলীর বসতবাড়ি ছাড়া কোনো জমি ছিল না। প্যাডেল মেরে রংপুর শহরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পাওয়ায় তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। একবেলা খাবার জুটলেও, আরেক বেলা খাবার জুটত না। ১৫ বছর আগে এমন অবস্থা ছিল তাঁর। কিন্তু কাঁঠালপাতা বিক্রি করে এখন সুখে সংসার চালাচ্ছেন। খড়ের ঘরে জায়গায় আধা পাকা ঘর তুলেছেন। ১৩ শতক জমি কিনেছেন।

আমজাদ হোসেনের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোলাপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আব্বাস আলী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। অভাবের সংসার থাকায় তাঁর লেখাপড়া করা হয়নি। কখনো দিনমজুরি, কখনো রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। ১৫ বছর আগে তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। কোমরে আঘাত পাওয়ায় ভারী কাজ করতে পারেন না। এর পর থেকে গ্রামে ঘুরে কাঁঠালপাতা সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

ইকরচালী হাটের মাংসহাটের মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভ্যানের ওপর কাঁঠালপাতায় ভর্তি। পাশে দাঁড়িয়ে আমজাদ হোসেন। তাঁকে ঘিরে ধরেছেন ছাগল পালনকারীরা। তিনি এক হাতে কাঁঠালপাতার আঁটি দিচ্ছেন, অন্য হাতে টাকা নিচ্ছেন।
সেখানে কথা হয় আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, আগে রংপুর শহরে রিকশা চালাতেন। কিন্তু আয়ের বড় একটা অংশ যাতায়াত ও রিকশামালিককে দিতে হতো। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক আসার পর আয় কমে যায়। এমন অবস্থায় ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে রিকশা চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পান। এরপর তিন চার মাস কোনো কাজ করতে পারেননি। ওই বছরের মে মাসে বাড়ির পাশে সড়কের ধারে থাকা একটি কাঁঠালগাছ ঝড়ে উপড়ে যায়। গ্রামের লোকজন হুমড়ি খেয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যান। ওই মাসেই এক ভ্যান কাঁঠালপাতা হাটে নিয়ে যান। ৫ টাকা মুঠো দরে ৯০০ টাকা বিক্রি করেন। এই আয় তাঁদের চোখ খুলে দেয়। তখন থেকেই কাঁঠালপাতা বিক্রির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কাঁঠালপাতাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পাতা বিক্রি করে দিনে ৬০০ টাকা ৭০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা সংসার খরচ চালানোর পরও সঞ্চয় করেছি। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে আধা পাকা টিনের ঘর করেছি। ৩০ শতক জমি বন্ধক নিয়েছি। কিনেছি ১৩ শতক জমিও। এক ছেলে, এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন স্ত্রী আমিনাকে নিয়ে সুখে আছি।’

এক হাতে চাল-সবজির ব্যাগ, অন্য হাতে একমুঠো কাঁঠালপাতা। হেলেদুলে ইকরচালী হাট থেকে বাড়িতে যাচ্ছিলেন হাজীপাড়া গ্রামের কান্দুরা মিয়া। কথা হলে কান্দুরা মিয়া বলেন, ‘এ্যালা ঘাসের খুব আকাল। তার ওপর চারদিকে ফসলের মাঠ। মানুষ এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা রাখে নাই। ছাগল ছাড়ি দিলে মানুষের খেত খায়। ওই জন্যে ঘরোত বান্ধি পুষি। প্রতিদিন আমজাদের কাছ থাকি কাঁঠালপাতা কিনি খাওয়াই।’

ইকরচালী বাজারে ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমজাদ চাচা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পাতা বিক্রি করেন। আগে ৫ টাকায় পাতা কিনতাম। এখন সেই পাতা ৩০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। মাঠঘাট কমে যাওয়া ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কাঁঠালপাতায় ছাগল পালন করছি।’

পাতা কিনতে আসা জুম্মাপাড়া গ্রামের বাদশা মিয়া বলেন, ‘আগের মতো মাঠ ফাঁকা নেই। জমিগুলোতে বড় বড় আলও নেই। এখন সারা বছর ঘাসের সংকট। তাই বাজারের সঙ্গে ৩০ টাকায় ছাগলের জন্য একমুঠো কাঁঠালপাতা নিলাম।’

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রমজান আলী বলেন, গ্রামগুলোতে আগে আমন ওঠার পর ফাঁকা থাকত মাঠ। সকালবেলা সেই মাঠে দলে দলে ছাগলের পাল নিয়ে যেতেন নারী-পুরুষেরা। সারা দিন মাঠে চরানোর পর বিকেলে গোয়ালে আনা হতো। কিন্তু চাষাবাদ বাড়ায় এখন ফাঁকা নেই মাঠ। ফলে ছাগল পালনে এখন উঠাননির্ভর হয়ে পড়েছে।    

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইফতেখায়ের বলেন, তারাগঞ্জে গাবাদিপশুর তেমন বিচরণভূমি নেই। মাঠ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ঘাসের ওপর। ফলে পরিবর্তন এসেছে ছাগলের খাদ্যাভ্যাসেও। ছাগলের এখন অন্যতম খাবার হচ্ছে ভাত, মাড়, কাঁঠালপাতা ও ভুসি। ঘাসের পরিবর্তে কাঁঠালপাতার চাহিদা বাড়ায় অনেকেই এ পাতা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন স্বাচ্ছন্দ্যে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমজ দ হ স ন এখন স

এছাড়াও পড়ুন:

‘কাঁঠালপাতাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে’

আমজাদ আলীর বসতবাড়ি ছাড়া কোনো জমি ছিল না। প্যাডেল মেরে রংপুর শহরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পাওয়ায় তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। একবেলা খাবার জুটলেও, আরেক বেলা খাবার জুটত না। ১৫ বছর আগে এমন অবস্থা ছিল তাঁর। কিন্তু কাঁঠালপাতা বিক্রি করে এখন সুখে সংসার চালাচ্ছেন। খড়ের ঘরে জায়গায় আধা পাকা ঘর তুলেছেন। ১৩ শতক জমি কিনেছেন।

আমজাদ হোসেনের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোলাপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আব্বাস আলী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। অভাবের সংসার থাকায় তাঁর লেখাপড়া করা হয়নি। কখনো দিনমজুরি, কখনো রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। ১৫ বছর আগে তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। কোমরে আঘাত পাওয়ায় ভারী কাজ করতে পারেন না। এর পর থেকে গ্রামে ঘুরে কাঁঠালপাতা সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

ইকরচালী হাটের মাংসহাটের মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভ্যানের ওপর কাঁঠালপাতায় ভর্তি। পাশে দাঁড়িয়ে আমজাদ হোসেন। তাঁকে ঘিরে ধরেছেন ছাগল পালনকারীরা। তিনি এক হাতে কাঁঠালপাতার আঁটি দিচ্ছেন, অন্য হাতে টাকা নিচ্ছেন।
সেখানে কথা হয় আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, আগে রংপুর শহরে রিকশা চালাতেন। কিন্তু আয়ের বড় একটা অংশ যাতায়াত ও রিকশামালিককে দিতে হতো। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক আসার পর আয় কমে যায়। এমন অবস্থায় ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে রিকশা চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পান। এরপর তিন চার মাস কোনো কাজ করতে পারেননি। ওই বছরের মে মাসে বাড়ির পাশে সড়কের ধারে থাকা একটি কাঁঠালগাছ ঝড়ে উপড়ে যায়। গ্রামের লোকজন হুমড়ি খেয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যান। ওই মাসেই এক ভ্যান কাঁঠালপাতা হাটে নিয়ে যান। ৫ টাকা মুঠো দরে ৯০০ টাকা বিক্রি করেন। এই আয় তাঁদের চোখ খুলে দেয়। তখন থেকেই কাঁঠালপাতা বিক্রির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কাঁঠালপাতাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পাতা বিক্রি করে দিনে ৬০০ টাকা ৭০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা সংসার খরচ চালানোর পরও সঞ্চয় করেছি। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে আধা পাকা টিনের ঘর করেছি। ৩০ শতক জমি বন্ধক নিয়েছি। কিনেছি ১৩ শতক জমিও। এক ছেলে, এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন স্ত্রী আমিনাকে নিয়ে সুখে আছি।’

এক হাতে চাল-সবজির ব্যাগ, অন্য হাতে একমুঠো কাঁঠালপাতা। হেলেদুলে ইকরচালী হাট থেকে বাড়িতে যাচ্ছিলেন হাজীপাড়া গ্রামের কান্দুরা মিয়া। কথা হলে কান্দুরা মিয়া বলেন, ‘এ্যালা ঘাসের খুব আকাল। তার ওপর চারদিকে ফসলের মাঠ। মানুষ এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা রাখে নাই। ছাগল ছাড়ি দিলে মানুষের খেত খায়। ওই জন্যে ঘরোত বান্ধি পুষি। প্রতিদিন আমজাদের কাছ থাকি কাঁঠালপাতা কিনি খাওয়াই।’

ইকরচালী বাজারে ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমজাদ চাচা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পাতা বিক্রি করেন। আগে ৫ টাকায় পাতা কিনতাম। এখন সেই পাতা ৩০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। মাঠঘাট কমে যাওয়া ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কাঁঠালপাতায় ছাগল পালন করছি।’

পাতা কিনতে আসা জুম্মাপাড়া গ্রামের বাদশা মিয়া বলেন, ‘আগের মতো মাঠ ফাঁকা নেই। জমিগুলোতে বড় বড় আলও নেই। এখন সারা বছর ঘাসের সংকট। তাই বাজারের সঙ্গে ৩০ টাকায় ছাগলের জন্য একমুঠো কাঁঠালপাতা নিলাম।’

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রমজান আলী বলেন, গ্রামগুলোতে আগে আমন ওঠার পর ফাঁকা থাকত মাঠ। সকালবেলা সেই মাঠে দলে দলে ছাগলের পাল নিয়ে যেতেন নারী-পুরুষেরা। সারা দিন মাঠে চরানোর পর বিকেলে গোয়ালে আনা হতো। কিন্তু চাষাবাদ বাড়ায় এখন ফাঁকা নেই মাঠ। ফলে ছাগল পালনে এখন উঠাননির্ভর হয়ে পড়েছে।    

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইফতেখায়ের বলেন, তারাগঞ্জে গাবাদিপশুর তেমন বিচরণভূমি নেই। মাঠ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ঘাসের ওপর। ফলে পরিবর্তন এসেছে ছাগলের খাদ্যাভ্যাসেও। ছাগলের এখন অন্যতম খাবার হচ্ছে ভাত, মাড়, কাঁঠালপাতা ও ভুসি। ঘাসের পরিবর্তে কাঁঠালপাতার চাহিদা বাড়ায় অনেকেই এ পাতা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন স্বাচ্ছন্দ্যে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ