সংস্কৃতি মানে কি শুধু শিল্প-সাহিত্য?
Published: 7th, February 2025 GMT
এই রচনা লেখার আইডিয়াটা আমার মনে এসেছে প্রথম আলোতে আমাদের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দুটি বক্তব্য পড়ে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি গ্রন্থাগারের তালিকা ও তথ্য নিয়ে একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, সাংস্কৃতিক বিরোধ থাকলে রাজনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য। অর্থনীতি ও সংস্কৃতি—দুটি ক্ষেত্রেই সমতা না এলে দেশে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু কোনো সরকারই সংস্কৃতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। বাজেটে এ খাতে বার্ষিক বরাদ্দই তার প্রমাণ।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জাতীয় চলচ্চিত্র সম্মেলন ২০২৫-এ আরেকটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়গুলো অদ্ভুতভাবে ভাগ করা হয়েছে। কলোনিয়াল দেশগুলোতে এটা দেখবেন। কোরিয়া, ইরান, ইতালিতে সংস্কৃতি ও ট্যুরিজম মন্ত্রণালয় আলাদা নয়; একসঙ্গে রয়েছে। আমাদেরও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন পুরো কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিকে আনা দরকার।’
ফারুকী ঠিক বলেছেন, নাকি ভুল বলেছেন, তা নিয়ে আমার আজকের কথা নয়; বরং তাঁর কথার সূত্র ধরে এ লেখার অবতারণা।
সংস্কৃতি বলতে আমি বুঝি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন। শুধু সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্র নয়। তিনি যখন অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিকে দুটি খাত হিসেবে দেখছেন, তা নিয়ে একটু আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
আমার কাছে শুধু শিল্প-সাহিত্যই সংস্কৃতি নয় এবং সংস্কৃতির একমাত্র ধারক ও বাহক নয়; বরং আমরা বাংলাদেশি হিসেবে যা শিখি, করি এবং আমাদের কর্মে দেশে ও বিদেশে যা প্রতিফলিত হয়, সেটাই আমাদের সংস্কৃতি, যাকে ইংরেজিতে কালচার বলা যায়। আমরা রাস্তায় থুতু ফেলছি, নাক ঝাড়ছি, কোনায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছি, ট্রাফিক আইন মানছি না, ঘুষ খাচ্ছি, চুরি করছি, একে অপরকে ঠকাচ্ছি, গরিব মানুষদের ক্ষ্যাত মনে করে দাবিয়ে রাখছি—এ সবই আমাদের সংস্কৃতি, কালচার।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গেল সাড়ে পনেরো বছর ব্যাংক ডাকাতি একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। ব্যাংকিং খাত আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যানেল। আমার কাছে মনে হয় অর্থনীতিও একরকমের সংস্কৃতি। আমি কেমন অর্থনীতি চাই বা চাই না, তার ওপর নির্ভর করে আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কৃতি। আমরা একটা গোষ্ঠীকে অতি ধনী হওয়ার অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি, আপামর জনতাকে সারা জীবন গরিব থাকতে বাধ্য করছি এবং মধ্যবিত্তের দিন-এনে-দিন-খাওয়া জীবনকে গ্রহণ করে নিয়ে সেটাই বাস্তব বলে মেনে নিয়ে নির্বিকার দিনাতিপাত করে চলেছি। এটাই আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কৃতি।
আমাদের সরকার সংস্কৃতি বলতে যা বোঝে বা জনমানুষদের যা বোঝা, তার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা কী খাই, কী পরি, কী করি, যা করি তা আইন মেনে করি কি না, নাকি বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে করি—এসবই পরিশেষে এক সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। একটি দেশ বা সমাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে অনেক বছর ধরে। আমাদের জন্য পঞ্চাশ বা পঁচাত্তর বছর কি কোনো এক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না? ইতিহাসের প্রবাহে সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য অনেক স্তম্ভ থাকে; আমাদেরও ছিল—১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪। আমরা কোন সংস্কৃতি গড়তে পেরেছি বা পারব?তাই শুধু সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্র খাতকে সংস্কৃতি বা কালচার মনে করা ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ভাবার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। সংস্কৃতি আরও অনেক বড় এবং এর বিস্তার সর্বব্যাপী। আমাদের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় যদি শুধুই সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্র বা পর্যটনের দেখভাল করার জন্যই কাজ করতে চায়, তাহলে আমাদের এই মন্ত্রণালয়ের নাম নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে।
আসুন ভুটানের উদাহরণ দেখি। এই দেশটি জিডিপির হিসাব করে না, এরা সুখের সূচকের হিসাব করে। এটা তাদের সংস্কৃতি। তাদের সংবিধানে বনায়নের কথা বলা রয়েছে এবং তারা তাদের সংবিধান মেনে বনায়ন বাড়িয়েই চলেছে। এই সংস্কৃতি তাদের সরকার সজ্ঞানে এক কৌশলপত্রে পরিণত করে দেশের মানুষদের সেভাবেই জীবন যাপন করতে উৎসাহিত করছে। আমেরিকার সংস্কৃতি কী? আমেরিকান ড্রিম। তাদের সরকার জনগণদের বলে—তুমি যা হতে চাও, হও। কিন্তু তারা কি যেকোনো উপায়ে তাদের স্বপ্ন পূরণ করে। আইন-আদালত আছে, তা মেনেই স্বপ্ন পূরণ করতে হয়। এদের মতো আরও অনেক দেশ আছে, শহর আছে, যাদের আলাদা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং তা দেশ গড়ায় অবদান রাখছে।
সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্রের চর্চা অবশ্যই সব দেশের সংস্কৃতিতে বা দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। সেটা পুরো সংস্কৃতির একটি অংশ মাত্র। তাই শুধু শিল্প ও সাহিত্যকে সংস্কৃতি বলা ঠিক হবে কি না, ভেবে দেখা দরকার।
আমাদের সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্রকে যদি একটি ইন্ডাস্ট্রি ধরে নিই, যা আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতিতে অবদান রাখে, তাহলে সেই ইডাস্ট্রির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য কী? এই ইন্ডাস্ট্রি জাতীয় জীবনে কী দিতে চায়? এই ইন্ডাস্ট্রির সৃজনশীলতাকে কি আমরা নিয়ন্ত্রণ করব, নাকি সৃজনশীল মানুষদের কল্পনার দ্বার উদাম করে দেব? উপদেষ্টা আসলেই ঠিক বলেছেন—কোনো সরকারই সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। আমাদের উপদেষ্টা আরও একটা উচিত কথা বলেছেন, বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করার প্রয়োজন আছে।
তবে আমাদের সরকার সংস্কৃতি বলতে যা বোঝে বা জনমানুষদের যা বোঝা, তার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা কী খাই, কী পরি, কী করি, যা করি তা আইন মেনে করি কি না, নাকি বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে করি—এসবই পরিশেষে এক সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। একটি দেশ বা সমাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে অনেক বছর ধরে। আমাদের জন্য পঞ্চাশ বা পঁচাত্তর বছর কি কোনো এক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না? ইতিহাসের প্রবাহে সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য অনেক স্তম্ভ থাকে; আমাদেরও ছিল—১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪। আমরা কোন সংস্কৃতি গড়তে পেরেছি বা পারব?
আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলা যায় যে সংস্কৃতি একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর ব্র্যান্ডিং। ব্র্যান্ডিং কী? ধরুন আপনি একটা ক্যাফেতে গিয়ে এক কাপ কফি চাইলেন। কফি বানাতে কফির দানা, দুধ বা ক্রিম ও চিনি মিলিয়ে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কফির কাপটা আপনার সামনে এল। সেখান থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধ বেরোচ্ছে, যা আপনার মন জুড়িয়ে দিচ্ছে—সেটাই ব্র্যান্ডিং।
সংস্কৃতি হচ্ছে, সেই ব্র্যান্ডিং।
ইকরাম কবীর গল্পকার
ই–মেইল: [email protected].
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ত য ও চলচ চ ত র আম দ র স স ক ত এক স স ক ত দ র সরক র উপদ ষ ট চ ত রকল বল ছ ন র জন য আম র ক
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের মাতাল বিমানযাত্রী সহযাত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করলেন
এয়ার ইন্ডিয়ার এক যাত্রীর বিরুদ্ধে আরেক সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বুধবার দিল্লি থেকে ব্যাংককে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এর আগেও ভারতের যাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এটিই প্রথম নয়। তাঁরা একাধিকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। গতকালের ঘটনায় এয়ার ইন্ডিয়া ও ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো অভিযোগের ঘটনা খতিয়ে দেখবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার যে ফ্লাইটে সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করার ঘটনা ঘটেছে, সেটার নম্বর এআই২৩৩৬। ভুক্তভোগী যাত্রীর অভিযোগের পর উড়োজাহাজের ক্রুরা ওই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন।
এক বিবৃতিতে এয়ার ইন্ডিয়া ওই ঘটনাকে ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণ’ বলে মন্তব্য করেছে। এ ঘটনার কথা বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তরকে (ডিজিসিএ) জানিয়েছে তারা এবং অভিযোগ খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়া আরও জানিয়েছে, তাদের ক্রুরা যাত্রীদের কাছে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করছেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী যাত্রীকে ব্যাংককে নামার পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে অনুরোধ করেছেন। তবে ভুক্তভোগী যাত্রী প্রাথমিকভাবে ব্যাংককে অভিযোগ করবেন না বলে জানিয়েছেন।
ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী কে রামমোহন নাইডু বলেছেন, ‘যদি কোনো অন্যায় করা হয়ে থাকে, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ তাঁর মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করবে এবং ফ্লাইট পরিচালনা কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলবে।
ঘটনা খতিয়ে দেখতে এয়ার ইন্ডিয়া একটি স্বাধীন কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। কমিটি ঘটনা যাচাই করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাবে।
এর আগে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আর্য ভোহরা নামের এক ভারতীয় শিক্ষার্থী একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করেছিলেন। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারলাইনস তাঁকে নিষিদ্ধ করে। আর্য ভোহরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওই ঘটনার কয়েক মাস পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। তখন শংকর মিশ্র নামের এয়ার ইন্ডিয়ার এক যাত্রী মাতাল অবস্থায় এক বয়স্ক নারী সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় বেশ সমালোচনা হয়েছিল।